শ্রীরামকৃষ্ণ (Shri Ramakrishna)
প্রথম পাতা » জীবনী » শ্রীরামকৃষ্ণ (Shri Ramakrishna)শ্রীরামকৃষ্ণ
(১৮৩৩-১৮৮৬)
ছেলে বড় হল। পাঁচ বছরে পড়ল গদাধর। কামারপুকুর গ্রামের লাহাবাবুদের বাড়ির নাটমন্দিরে পাঠশালা। বাবা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় ছেলে গদাধরকে সেই পাঠশালায় ভর্তি করিয়ে দিলেন। কিন্তু পড়াশোনায় খুব বেশি মন নেই গদাধরের। শুধু বাংলাটা পড়তে ভাল লাগে। অংক কষতে গেলেই মাথা গুলিয়ে যায়। বামুনের ছেলে। ছোটবেলাতেই মুখে মুখে শিখেছে। দেবদেবীর প্রণাম মন্ত্র। সেগুলো কিন্তু সে বেশ গড়গড়িয়ে বলে যেতে পারে। তার কিছুদিন পরেই রামায়ণ পড়তে পারে সুর করে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গলার সুর এবং বলার ভঙ্গিও তার সুন্দর হয়েছে। তাই মধুযোগীর বাড়িতে তার রামায়ণ পড়া শুনতে ভিড় জমে যায়।
একদিন বিকেলবেলা সে রামায়ণ পাঠ করছে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও শুনছে মনোযোগ। দিয়ে। কাছেই আমগাছের ওপর বসে ছিল একটা হনুমান। সে লাফ দিয়ে ঠিক গদধরের কাছে এসে পড়ল। তারপর পা জড়িয়ে ধরল গদাধরের। হইচই করে উঠল সবাই। কেউ বা ভয় পেয়ে উঠে চলে গেল। কিন্তু গদাধর একটুও নড়ল না। সে হনুমানের মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দিল। বুঝি শ্রীরামচন্দ্রের আশীর্বাদ পেয়েই খুশী হয়ে রামভক্ত হনুমান আবার লাভ দিয়ে গাছে উঠে গেল।
অদ্ভুত ছেলে গদাধর! সব সময়েই ভাবাবেশে মত্ত হয়ে থাকে। পথে পথে ঘুরে গান করতে করতে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায়। লোকজন ছুটে এসে মাথায় ও মুখে জল ছিটিয়ে তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনে।
কামারপুকুর থেকে দু’মাইল দূরে আনুড় গ্রাম। সেখানে বিরাট এক গাছের তলায় আছে বিশালাক্ষীর থান। গাঁয়ের মেয়েরা দল বেঁধে চলেছে সেই বিশালাক্ষী দেবীর পূজা দিতে। হঠাৎ কোত্থেকে ছুটে এসে গদাধর সেখানে সেই দলে ঢুকে পড়ল। গাঁয়ের মেয়েরা ভাবল, যাক ভালই হয়েছে। গদাইয়েরও গান গেয়ে খুব আনন্দ। বাবার কাছ থেকে শেখা দেবতার ভজন কি সুন্দর গায়।
কিন্তু বিশালাক্ষী থানের কাছাকাছি যেতেই তার গান থেমে গেল। দু’চোখ বেয়ে পড়তে লাগল জলের ধারা। প্রসন্ন বলে মেয়েটি এগিয়ে এসে তাকে ধরতেই তার কোলে অবসন্ন হয়ে ঢলে পড়ল। গদাইয়ের জ্ঞান হতেই সে বলল, ওরে গদাইকে কিছু খেতে দে।
কিন্তু কি খেতে দেবে গদাইকে? কারুর সঙ্গে ভোগের সামগ্রী ছাড়া যে আর কিছু নেই। প্রসন্ন বলল, ভোগের জিনিসই আলাদা করে ওকে দে। ওকে খাওয়ালেই তোদের পুণ্যি হবে।
অনেকে পূজার জন্য আনা নৈবেদ্য থেকে কলা, দুধ ও বাতাসা গদাইয়ের মুখে তুলে দেয়।
বড় খামখেয়ালী ছেলে গদাধর। পড়াশুনা মোটেই করছে না। শুধু আড্ডা দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। দল বেঁধে ছেলেদের সঙ্গে যাত্রা করে। কখনো সাজে কৃষ্ণ, কখনো শিব।
দেখতে দেখতে বড় হতে লাগল গদাধর। দাদা রামকুমার বলেন, গাঁয়ে ওর লেখাপড়া কিছু হবে না। আমি ওকে কলকাতায় নিয়ে যাব। লেখাপড়া শেখাব।
রামকুমার কলকাতায় ঝামাপুকুরে থাকেন। সেখানে একটা টোল খুলেছেন। সেখানেই ছোটভাইকে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু সে গা ছেড়ে যেতে চায় না।
১৮৩৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি এই কামারপুকর গ্রামে জনা হয়েছে গদাধরের। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখেছে এখানকার পথ-ঘাট, পুকুর, মা-বাবা ও গাঁয়ের লোকজনদের। এসব ছেড়ে যেতে কি ভাল লাগে।
পৈতে হয়েছে। দাই-মা ধনী কামারনীর আদর পেয়েছে। মা চন্দ্রমণির দিকে যেমন টান, ধনী কামারনীর দিকেও টান তার কম নয়। বাবাকেও ভালবাসে খুব। কিন্তু সাত বছর বয়সেই বাবাকে হারাতে হল হঠাৎ। ছিলিমপুরে থাকেন বাবার ভাগনে রামাদ। তার বাড়িতে দুর্গাপূজায় পুরোহিত হয়ে পূজা করতে গিয়েছিলেন ক্ষুদিরাম। সেখানেই ভাসানের দিন রাত্রিবেলায় মারা গেলেন। সেই খবর পেয়ে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল গদাধর।
এবার গ্রাম ছাড়তেই হবে গদাধরকে। বাবার শ্রাদ্ধ শান্তি হয়ে যাবার পরই রামকুমার তাকে কলকাতা যাবার জন্য তৈরী হতে বললেন। সে কথা শুনে গদাধরের মন খারাপ হয়ে গেল। ভাগনে হৃদয় তারই সমবয়সী। ক্ষুদিরামের শ্রাদ্ধের সময় এসেছে। তার সঙ্গে গাঁয়ের পথে পথে ঘুরে বেড়ায় গদাধর।
একদিন বেড়াতে বেড়াতে একটু দূরেই চলে গেল। গা ছাড়িয়ে মাঠ, জমি। বেশ লোকের ভিড়। কয়েকজন লোক জমি ভাগাভাগি করছে। মাপছে দড়ি ফেলে। তাতেও হল না। লেগে গেল তাদের মধ্যে ঝগড়া, তারপর হাতাহাতি। খুড়ো আর ভাইপোর মধ্যে বিবাদ। দুজনেই পণ্ডিত। অথচ কি মারামারি করল তারা। গদাধর ভাবল, ছিঃ, লেখাপড়া শিখেও মানুষ এমন হয়! এমন বিষয়-সম্পত্তিকে ধিক্।
গদাধরের মনটা খারাপ হয়ে গেল ভীষণ।
রামকুমার গদাধরকে নিয়ে কলকাতায় এলেন। মধ্য কলকাতায় ঝামাপুকুরে অনেক রকম পুঁথি আছে টোলে। সেগুলো নেড়েচেড়ে দেখে গদাধর। রামকুমার বললেন, এসব পড়ে এখন লাভ নেই। ইস্কুলে তোকে ভর্তি করিয়ে দেব। সেখানেই পড়বি।
গদাধর ঠোঁট উলটিয়ে বলল, আমি পড়বই না স্কুলে।
রামকুমার জিজ্ঞেস করলেন, কেন?
গদাধর জবাব দিল, চালকলা বাঁধা বিদ্যা শিখতে চাই না।
–তবে কি চাস?
–আমি চাই এমন বিদ্যা শিখতে যাতে সত্যিকারের কোন লাভ হয়। মানুষের জীবন ধন্য হয়।
রামকুমার ভাবলেন, ছোট ভাইটার মাথা নিশ্চয় খারাপ হয়ে গিয়েছে। লেখাপড়া যখন করবে না তখন দেবসেবাই করুক। তাই বললেন, ব্রাহ্মণের সন্তান, পূজার মন্ত্র তন্ত্র ভাল করে শিখে নে। ব্যাকরণ, শাস্ত্র এসব পড়াশুনা কর।
গদাধর তাতে কোন আপত্তি করে না। পূজার মন্ত্রের বই নাড়াচাড়া করে। রামকুমার টোলে পড়ানো ছাড়া যজমানদের বাড়িতে পূজাও করেন। গদাধরও সঙ্গে যায়। যতক্ষণ দাদা পূজা করেন সব কিছু দেখে গদাধর পূজা মন্ত্র ও আয়ত্ত করে। ঘরে ফিরে এসে পূজার মন্ত্র ও নিয়মকানুন লেখা বই ও দেখে নেয়। কয়েকদিনের মধ্যে তার অনেক কিছু শেখা হয়ে যায়।
ঝামাপুকুরের পিতাম্বর মিত্তির বাড়ির বিগ্রহের পুরোহিত ছিলেন রামকুমার। একদিন অসুস্থ হয়ে পড়ায় যেতে পারলেন না। তিনি গদাধরকে বললেন, তুই একটু পুজোটা করে দিয়ে আসবি?।
গদাধর বেশ খুশিমনেই গেল। পূজা করল। তার পূজা দেখে বাড়ির গিন্নিরা ও মেয়েরা কী খুশী। কি সুন্দর মন্ত্রপাঠ করে গদাধর। পূজা করতে করতে সে কখনো যেন তন্ময় হয়ে যায়। মেয়েরা বেশি করে চাল কলা ও নৈবেদ্যর ডালি তাকে দিয়ে দেয়। গদাধর আপত্তি জানিয়ে বলে, এত দিচ্ছ কেন?
মেয়েরা ভক্তিতে গদগদ হয়ে প্রমাণ করে তাদের নবীন পূজারীকে। এরপর থেকে মিত্রবাড়ির নিয়মিত পূজারী হয়ে গেল গদাধর।
গদাধরের কিন্তু ওসবের দিকে কোন লাভ নেই। মাঝে মাঝে যজমানের বাড়ি থেকে পাওয়া সব কিছু পথের এক ভিখারীকে দিয়ে দেয়। এজন্য দাদার ভৎর্সনাও শুনতে হয় গদাধরকে। গদাধর বলে আমাদের তো অনেক আছে, ওদের যে কিছুই নেই। মনে মনে রামকুমার ভাবেন, গরীবের ঘরে জন্ম হলেও রাজার মন নিয়ে গদাধর জন্মেছে।
বড় হয়ে উঠছেন গদাধর। দেখতে তাঁকে ভক্তিমান ব্রাহ্মণ বলেই মনে হয়। কিন্তু কেমন যেন উদাস উদাস ভাব।
রামকুমার খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। গদাধরের ভবিষ্যৎ কি হবে?
এমন সময় এক সুযোগ এসে গেল তাদের সামনে।
কলকাতার জানবাজারের রানী রাসমণি মন্দির স্থাপন করলেন দক্ষিণেশ্বরে। সে অতি বিচিত্র কাহিনী। কাশীতে অন্নকূট উৎসব করার জন্য বিরাট বিরাট নৌকায় বহু খাদ্যসামগ্রী ও লোকজন নিয়ে জনপথে চলেছিলেন রানী রাসমণি। রাত্রে স্বপ্ন দেখলেন। জগজ্জননী মূর্তিমতী হয়ে তাঁকে বললেন, ওরে তোর কাশী যাওয়ার দরকার নেই। গঙ্গার তীরে এখানেই মন্দির তৈরী করে আমাকে প্রতিষ্ঠা কর। আমাকে অন্নভোগ দে।
রাসমণির আর কাশী যাওয়া হল না। গঙ্গার তীরে দক্ষিণেশ্বরে মন্দির নির্মাণ করলেন। খরচ হল নয় লাখ টাকা। নবরত্ন বিশিষ্ট কালী মন্দির, উত্তর ভাগে রাধাগোবিন্দ মন্দির, পশ্চিমে গঙ্গার তীর জুড়ে দ্বাদশ শিবের মন্দির। মূর্তিও তৈরী হল। মূর্তি ছিল বাক্সের মধ্যে। দেখা গেল মূর্তি ঘামছে। রাত্রে স্বপ্ন দেখলেন রাণীমা। ভবতারিণী কালী বলছেন, আমাকে আর কতদিন এভাবে কষ্ট দিবি? এবার আমায় মুক্তি দে।’
১২৬১ সালে বারোই জ্যৈষ্ঠ স্নানযাত্রার দিনে মন্দিরে মূর্তি প্রতিষ্ঠা হল। কিন্তু মায়ের অন্নভোগ দেওয়ার কি হবে? মার যে অন্নভোগ দেবার অধিকার তোমার নেই। কারণ তুমি যে জেলের মেয়ে।
দেবীকে ভোগ দেবো, তাতেও জাতবিচার? রানীর হৃদয় ব্যথায় ভরে উঠল। রানীর জামাতা মথুরামমোহন সব কিছু দেখাশুনা করতেন। তিনি নানা দেশের পণ্ডিতদের কাছে। বিধান নিতে ছুটলেন। কিন্তু সব পণ্ডিতেরই এক কথা। অচ্ছুৎ রামকুমারের কাছে। রামকুমার বিধান দিলেন মন্দিরের যাবতীয় সম্পত্তি যদি রানী কোন ব্রাহ্মণকে দান করেন তবেই অন্নভোগ দেওয়া চলতে পারে।
রানী অকূলে যেন কূল পেলেন। তিনি ঠিক করলেন গুরুর নামে মন্দির দান করবেন। কিন্তু গুরুর বংশের কেউ পুরোহিত হয় এ তার কাম্য নয়। কারণ তাঁরা সকলেই অশাস্ত্রজ্ঞ এবং আচারসর্বস্ব। অন্য সৎ ব্রাহ্মণও পাওয়া গেল না। অন্য কেউ মন্দিরের পূজা করতে রাজী হলেন না।
মন্দির প্রতিষ্ঠা-উৎসবের দিন রামকুমার এলেন গদাধরকে সঙ্গে নিয়ে। বিরাট আয়োজন কালীবাড়িতে। যাত্রাগান, কালীকীর্তন, ভাগবত পাঠ। মহা ধূমধাম কাণ্ড। সকাল থেকে চলছে খাওয়া-দাওয়া আহূত কে অনাহূত, কার কি জাত তার খোঁজ-খবরও করে না কেউ।
গদাধর কিন্তু কিছুই খেলেন না। বাজার থেকে মুড়ি কিনে খেয়ে সারাদিন কাটিয়ে দিলেন। রাত্রিবেলা রামকুমার গদাধরকে জিজ্ঞেস করলেন, এখনকার ভোগের প্রসাদ তুই নিলিনে কেন? ব্রাহ্মণের হাতে রাধা মাকে নিবেদন করা ভোগ আমি নিলাম, তুই নিলি না কেন?
গদাধর জবাব দিলেন, এমনি নেইনি।
রামকুমার অবাক হলেন। অথচ এই গদাধরই ছোটবেলায় ধনী কামারনীর কাছ থেকে ভিক্ষা নিয়েছেন। শিয়র গ্রামের রাখালদের সঙ্গে বসে খেয়েছিল। খেয়েছিল ছুতোর বাড়ির বউয়ের হাতে খিচুড়ি রান্না। চিনিবাস শাখারীর হাতে মিষ্টি। আনুড়ে বিশালাক্ষী মায়ের থানে নানা জাতের মেয়েদের দেওয়া পূজার প্রসাদ খেয়েছিল। তখন তো জাতবিচার করেনি। আশ্চর্য!
কারণ জিজ্ঞেস করলে গদাধর জবাব দিলেন, ওরা দিয়েছিল অতি যত্নের বিদুরের খুদ। কিন্তু এ যে হেলায় ফেলায় দেওয়া দুর্যোধনের রাজভোগ।
জবাব শুনে অবাক হয়ে গেলেন রামকুমার। বাঃ, রামায়ণ মহাভারত পড়ে আর টোলের নানা বই ঘাটাঘাটি করে অনেক কিছু তো এ বয়সে গদাধর শিখে ফেলেছে।
রামকুমার বললেন, তা হলে কি করতে বলিস আমাকে? ঝামাপুকুরে ফিরে যাব? রাণীমা যে আমাকে এখানে পুরোহিত করতে চান। সে কাজ তা হলে নেব না?
গদাধর বললেন, কথা যখন দিয়েছ তখন ছাড়বে কেন? আর তোমার টোলও তো প্রায় উঠেই গেছে। তুমি এখানেই থাক।
–তুইকি করবি?
–আমিও থাকবো তোমার কাছে। এখানে খাবো না।
-–এখানকার কিছু না খেতে চাস আমি পয়সা দেবো, বাজার থেকে চাল ডাল কিনে রান্না করে খাস।
গদাধর তাতেই রাজী হলেন।
দিন কাটতে লাগল ভালভাবেই। একদিন ভাগনে হৃদয় সেখানে এসে হাজির হল। গদাধরের প্রায় সমবয়সী। হৃষ্টপুষ্ট চেহারা। বলল, বর্ধমানে গিয়েছিলেন চাকরির খোঁজে। হল না। শুনলাম, তোমরা দু’মামাই আছো দক্ষিণেশ্বরে! তাই চলে এলাম।
রামকুমার বললেন, বেশ, থাক্ এখানে। একটা কিছু হবেই। তুই থাকলে গদাধরেরও সুবিধা হবে।
মথুরবাবু মাঝে মাঝে এসে মন্দিরের কাজ দেখাশুনা করেন। গদাধর কিন্তু ঢুকিয়ে দেবেন মথুরবাবু। পরের দাসত্ব করতে তার ভাল লাগে না।
গদাধর মাটি দিয়ে শিব গড়ে পূজো করেন। নিজেই পূজা করে বাতাসা ভোগ দিয়ে হৃদয়কে প্রসাদ দেন। গদাইয়ের হাতে গড়া শিবমূর্তি একদিন মথুরবাবু দেখতে পেলেন। কি অপূর্ব মূর্তি। গদাধর তখন কাছে ছিলেন না। জিজ্ঞেস করলেন হৃদয়কে, এ মূর্তি কে গড়েছে?
হৃদয় বলল, গদাই মামা।
–আমাকে দিতে পার এ মূর্তি?
–হ্যাঁ। নিয়ে যান। ছোটমামা এরকম মূর্তি অনেক গড়তে পারে।
মথুরামোহন সেই মূর্তি নিয়ে গেলেন জানবাজারের বাড়িতে। রাসমণিকে দেখিয়ে বললেন, দেখুন মা, পুরুত ঠাকুরের ছোটভাই গড়েছে।
রাসমণি বললেন, বাঃ বেশ তো। ওঁকে আমাদের মন্দিরের বিগ্রহের সাজনদার করলে বেশ হয়।
মথুরামোহন বললেন, আচ্ছা, আমি বলে দেখি পুরুত ঠাকুরকে।
পরদিন মথুরামোহন দক্ষিণেশ্বরে এসে রামকুমারকে ব্যাপারটা জানালেন। রামকুমার বললেন, গদাই যা খামখেয়ালী ছেলে। আমার কথা কি শুনবে? আপনি বললে যদি রাজী হয়।
মথুরামোহন তখন ডেকে পাঠালেন গদাধরকে। গদাধর ভয়ে ভয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন মথুরাবাবুর সামনে। মথুরাবাবু বললেন, তুমি ঘুরে ঘুরে বেড়াও কেন? তোমার মনের মতো একটা কাজ দিলে করবে?
–কি কাজ?
–মা ভবতারিণীকে তুমি নিজের মতো করে সাজাবে।
ভয়ে কুঁকড়ে উঠলেন গদাধর। বললেন, একা সাহস হয় না সেজবাবু। ঘরে সব দামী দামী জিনিস। সঙ্গে হৃদয় থাকে তো পারি।
–বেশ তো। সে তোমার সাগরেদ থাকবে। কাজ করবে দু’জনে মিলে। মনের মতো কাজ পেয়ে খুশীই হলেন গদাধর।
জন্মাষ্টমীর পরদিন নন্দোৎসব। রাধা-গোবিন্দের মন্দিরে বিশেষ পূজা ও ভোগ অনুষ্ঠান। সেই বিগ্রহের পূজারী ক্ষেত্ৰনাথ। দুপুরে পূজোর পর পাশের ঘরে শয়ন দিতে নিয়ে যাচ্ছেন রাধা-গোবিন্দকে। হঠাৎ পা পিছনে ক্ষত্ৰনাথ পড়ে গেলেন। হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে গেল গোবিন্দের একটি পা।
মন্দিরে হইচই পড়ে গেল। হায়, একি অঘটন।
রানী রাসমণিকে খবর পাঠানো হল। তিনি মথুরামোহনকে বললেন, পণ্ডিতদের কাছ থেকে বিধি নাও, কি ভাবে ঐ বিগ্রহের পূজা করা হবে?
মথুরামোহন অনেক পণ্ডিতের সঙ্গেই পরামর্শ করলেন। তারা বললেন, ঐ বিগ্রহকে গঙ্গায় বিসর্জন দিতে হবে। তার জায়গায় বসাতে হবে নূতন মূর্তি।
কিন্তু রাণীর মন তাতে সায় দিল না। সে গোবিন্দকে এতদিন গৃহদেবতা রূপে পূজা করা হয়েছে, তাকে বিসর্জন দিতে হবে?
গদাধরের কানে সে কথা যেতেই তিনি বললেন, সে কি কথা। কোন জামাইয়ের যদি ঠ্যাং ভেঙ্গে যায়, তাতে কি ফেলে দিতে হবে, না চিকিৎসা করাতে হবে। গোবিন্দ গৃহদেবতা, নিতান্ত আপন। সেই আপনজনকে ফেলে দেব কেন? আমিই ঠাকুরের পা জোড়া লাগিয়ে দিচ্ছি।
একথা শুনে রাসমণির মনের চিন্তা দূর হয়ে গেল। তিনি বললেন, ছোট ভট্টাচার্য যা বলেছেন তাই ঠিক।
গদাধর মাটি দিয়ে সুন্দরভাবে জুড়ে দিলেন গোবিন্দের পা। বোঝাই গেল না যে পা ভেঙ্গে গিয়েছিল। সেই মূর্তিই সিংহাসনে বসানো হল।
ক্ষেত্ৰনাথ পুরোহিতের কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন। গদাধরকে নিযুক্ত করা হল রাধাগোবিন্দ মন্দিরের পুরোহিত। গদাধর কোন আপত্তি করলেন না। মতিগতি দিন দনি একটু ভাল হচ্ছে তার। নিজেই একদিন বললেন, আমাকে দীক্ষা দাও।
কেনারাম ভট্টাচার্য নামে এক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণকে এনে গদাধরকে দীক্ষা দেওয়া হল। তারপর থেকে পূজার দিকে খুব মন দিলেন গদাধর। রামকুমার ভাবলেন, গদাইয়ের হাতে ভবতারিণীর পূজার ভার দিয়ে কিছুদিনের জন্য দেশ থেকে ঘুরে আসি। তাই গদাধরকে শক্তি পূজার ভার দিয়ে কিছুদিনের জন্য দেশ থেকে ঘুরে আসি। তাই গদাধরকে শক্তি পূজার পদ্ধতি শেখাতে লাগলেন।
গদাধর এখন আগের চেয়ে অনেক সংযত ও ধীরস্থির। কিছুদিন পর ভবতারিণীর পূজার ভার গদাইয়ের আর রাধাগোবিন্দের পূজার ভার হৃদয়ের হাতে দিয়ে রামকুমার দেশের দিকে রওনা হয়ে গেলেন। কিন্তু বিধির কি আশ্চর্য লীলা! রামকুমার বাড়িতে গিয়ে পৌঁছতে পারলেন না। পথেই অসুস্থ হয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। সেখানেই মারা গেলেন।
সে খবর শুনে কি কান্নাই না কেঁদেছিলেন গদাধর।
তারপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে।
দেশ থেকে ঘুরে এসে ভবতারিণীর পূজায় মন দিয়েছেন গদাধর। কিন্তু পূজার ধরন ধারণ যেন পালটে গেছে অনেক। হৃদয় অবাক হয়ে গেল তার ছোটমামার হাবভাব দেখে। একদিন দেখল গদাধর মায়ের মূর্তির হাত টিপে দেখলেন তারপর ছুটে চলে গেলেন বাইরে। ভূত প্রেত সাপ নেউলের ভয় নেই। পঞ্চবটী বনের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। পরনের কাপড় খুলে গেল, গলার পৈতে লুটোপুটি খেতে লাগল মাটিতে।
আর একদিন দেখল হৃদয়, গদাধর মা কালীর মূর্তির সামনে বসে কাঁদছেন। বলছেন, মা গো রামপ্রসাদকে তুই দেখা দিয়েছিস, আমাকে দেখা দিবি না কেন?
হৃদয় একদিন জিজ্ঞেস করল, মামা, এসব টং করো কেন?
গদাধর জবাব দিলেন, ওসব ঢং নয় রে। মাকে পেতে হলে পাশমুক্ত হতে হবে। অষ্ট পাশ। ক্ষুধা, লজ্জা, কুল, শীল, ভয়, মান, জাত, দম্ভ এসব ছাড়তে হয়।
পঞ্চবটিতে সারারাত পঞ্চমুণ্ডিত আসনে বসে ধ্যান করেন গদাধর। রাত্রি শেষে বেরিয়ে আসেন। পা টলছে মাতালেন মত। মন্দির খুলতে না খুলতেই ঢুকে পড়লেন ভেতরে। বিগ্রহের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, দেখা দিবি না? বেশ, চাই না দেখতে। রাক্ষসী তুই তাই তো রক্ত মেখে মুণ্ডুমালা গলায় রাকিস। আরো খাবি রক্ত?
মন্দিরের দেওয়ালে ঝুলছে বলির খাড়া। সেই খাড়াটি নিয়ে নিজের গলা কাটবার জন্য তুলে ধরলেন। মন্দিরের আঙিনায় তখন ভিড় জমে গেছে। কিন্তু কেউ হঠাৎ প্রতিমার পায়ের কাছে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন গদাধর। ধরাধরি করে অচেতন গদাধরকে নিয়ে যাওয়া হল তার ঘরে। পরের দিনও নয়। সময় সময় একটু জ্ঞান হয় আর কি যেন বিড় বিড় করে বলেন। আবার জ্ঞান হারিয়ে যায়।
মথুরাবাবু আর রাসমণি দেখতে এলেন। রাণী শিয়রে বসলেন হাতে পাখা নিয়ে। মুখে চিন্তার রেখা। আহা, কি হবে বাছাধনের। ঘুমের ঘোরেই গদাধর বলেন, মা এলি! মাগো!
উথলে ওঠে রাসমণির মাতৃস্নেহ। অচেতন গদাধরের মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিয়ে বলেন, এই যে বাবা আমি। গদাধর মুখ তুলে তাকান। দেখেন শিয়রে রানী রাসমণি! প্রকৃতিময়ী মাতৃমূর্তি!
একদিন পূজায় বসেছেন গদাধর। প্রতিমার পায়ে পুপুঞ্জলি দিতে গিয়ে ফুলবেলপাতা নিজের মাথায় দিয়ে বসলেন। হেসে উঠলেন হিহি করে। মূর্তির দিকে তাকিয়ে দেখলেন গদাধর। মূর্তি কোথায়? সশরীরে জগজ্জননী বসে আছেন। সামনে সাজানো ভোগ খাচ্ছেন বসে বসে।
একদিন দেরি হয়ে গেল পূজা করতে। ভোগের থালা থেকে এক মুঠো অন্ন তুলে ধরলেন গদাধর প্রতিমার সামনে। বললেন, নে নে, খা। খিদে পেয়েছে বুঝিখুব?
মন্দিরের একটু দূরেই যে পঞ্চবটী, সেখানে আমলকী গাছের তলায় আসন পাতলের গদাধর। নিরিবিলি, বসে মায়ের ধ্যান করবেন।
কিন্তু গরু ছাগলে বড় উৎপাত করে। গাছগাছালি খেয়ে ফেলে। তাই গদাধর বাগানের মালী হরিকে বললেন, জায়গাটা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে দে না একটু।
হরি বলল, অনেক বাঁশ দড়ি পেরেক লাগবে যে। পাব কোথায়? গদাধর বললেন, তা হলে থাক।
কিন্তু সেদিনই কিছুক্ষণ পরে বান এলো গঙ্গায়। মন্দিরের ঘাটে কোত্থেকে বানের জলে বাঁশ কাঠ দড়ি ভেসে এলো।
বেড়া দেওয়ার সমস্যা মিটে গেল। কিন্তু নালিশ এলো রানী ও মথুরামোহনের কাছে। ছোট পুরুতঠাকুর অনেক রকম পাগলামী করছে। পঞ্চবটীতেও জায়গা দখল করার মতলব আঁটছে।
রানীমা ও মধুরামোহন দু’জনেই এলেন তদন্ত করতে। গোমস্তারা বলল ছোট ভট্টাচার্যকে না তাড়ালে মন্দিরের সুনাম নষ্ট হয়ে যাবে। রানী সবার কথা শুনলেন, শুনলেন জলে ভেসে আসা কাঠ, বাঁশ দড়ির কথা। বললেন, বেশ আসি সব দেখছি।
সেদিন দক্ষিণেশ্বরেই রইলেন রানী। দুপুরের পূজার পর মন্দিরে এলেন। গদাধরকে বললেন, একটু মায়ের নাম শোনাও বাবা।
গদাধর গান ধরলেন। চোখ বুজে শুনতে লাগলেন রানী। হঠাৎ এক সময় রানীর গালে এক চর বসিয়ে দিলেন। ধমক দিয়ে বললেন, এখানেও বিত্ত বিষয় নিয়ে ভাবনা।
চারদিক থেকে হইহই করে উঠল রানীর দাসীরা, খাসাঞ্চী, গোমস্তারা। তুমি একি করলে পুরুত ঠাকুর? গদাধর বললেন, আমি কি করব? মা যা করান আমি তাই করি।
মথুরামোহন ছুটে এসে বললেন, না, আর সহ্য করা যায় না। রানীমা বললেন, আমারই দোষ, আমি মন্দিরে বসে হাইকোর্টের মামলার কথা ভাবছিলুম। ওর হাত দিয়ে মা শাসন করেছেন আমাকে।
সবাই অবাক বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল।
পরদিন চলে গেলেন রাণীমা ও মথুরামোহন। বলে গেলেন, যতদিন ছোট ভট্টাচার্য স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে না আসেন ততদিন অন্য পুরোহিত পূজা করবেন। তার ওপর যেন কোন চাপ না দেওয়া হয়।
ছ’বছর পরে কামারপুকুরে ফিরে এলেন গদাধর। মা চন্দ্রমণির বয়স ষাটের ওপর। মাকে শিশুর মতো জড়িয়ে ধরল। কে বলবে গদাধর এখন চব্বিশ বছরের যুবক। তিনি যেন এখনো সেই চঞ্চল বালক।
সিয়রে হৃদয়ের বাড়িতে গেলেন গদাধর। সেদিন সেখানে গানের আসর বসেছিল। একটি স্ত্রীলোকের কোলে ছিল একটি ফুটফুটে মেয়ে। টুলটুল করে তাকিয়ে চারদিক দেখছিল। স্ত্রীলোকটি রহস্য করে জিজ্ঞেস করল মেয়েটিকে, বিয়ে করবি? মেয়েটি ঘাড় নাড়ল? কাকে বিয়ে করবি এত লোকের মধ্যে? মেয়েটি গদাধরকে দেখিয়ে বলল, ঐ যে!
মেয়েটি জয়রামবাটির রামচন্দ্র মুখুজ্যের মেয়ে সারদামণি। একদিন শুভলগে গদাধরের সঙ্গে ওরই বিয়ে হল। প্রায় দু’বছর কামারপুকুরে থাকার পর দক্ষিণেশ্বরে ফিরলেন। মা কালীর পূজার ভার আবার তারই ওপর পড়ল।
রানী রাসমণির অসুখ। হঠাৎ একদিন পড়ে গিয়ে কোমরে ব্যথা পেলেন। শয্যাশায়ী হলে একেবারে।
মনে শান্তি নেই রাসমণির। দক্ষিণেশ্বরের পূজোর খরচ চালানোর জন্য দু’লাখ চব্বিশ হাজার টাকায় জমিদারি কিনেছেন। কিন্তু সেই সম্পত্তি এখনো দেবোত্তর করেননি। তাঁর চার মেয়ের মধ্যে দু’মেয়ে শুধু বেঁচে আছে। সেই দুই মেয়ে সই করে দিলেই সব গোল চুকে যায়। কিন্তু বড় মেয়ে পদ্মমণি কিছুতেই সই দিল না। রাণী ভাবনায় পড়লেন। হঠাৎ যেন দেখলেন, গদাধর তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন, নাই বা সই করল, মেয়ে কি মায়ের সঙ্গে মামলায় জিততে পারবে?
অভয় পেলেন রাসমনি। আঠারোশো একষট্টি সালের আঠারোই ফেব্রুয়ারি সেই সম্পত্তির দানপত্র রেজিষ্ট্রি হয়ে গেল।
পরের দিন রাসমণি বললেন, আমাকে কালীঘাটে নিয়ে চল। সেখানেই মায়ের কাছে শেষ নিঃশ্বাস ফেলব।
বিছানা সাজিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী রানীর দেহ আনা হল আদিগঙ্গার তীরে। অমাবস্যার অন্ধকার রাতে রানীর পুণ্যাত্মা দেহ ছেড়ে চলে গেল। দক্ষিণেশ্বরে ঘরের বারান্দায় অস্থির ভাবে পায়চারি করেছিলেন গদাধর। হঠাৎ বলে উঠলেন, চলে গেল রে, চলে গেল রাসমণি। মায়ের অষ্টনায়িকার এক নায়িকা।
একদিন সকালবেলা বাগানে ফুল তুলছেন গদাধর। এমন সময় বকুলতলার ঘাটে একটি নৌকা এসে ভিড়ল। এক সুন্দরী স্ত্রীলোক নামলেন নৌকা থেকে। পরনে গেরুয়া শাড়ি, হাতে ত্রিশূল। বয়স হয়েছে ভৈরবীর। কিন্তু কী রূপের ছটা। গদাধরকে বললেন, এই যে বাবা, তুমি এখানে। জানি তুমি গঙ্গাতীরে আছ। তাই তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।
শুনে গদাধর অবাক। তুমি আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছ মা?
মা মহামায়াই পাঠিয়ে দিলেন।
পঞ্চবটীতে ভৈরবীর থাকবার ব্যবস্থা হল। তিনি সেখানে থাকেন। তার ঝোলায় আছে তন্ত্রশাস্ত্র, গীতা, ভাগবত। গদাধরকে পড়ে শোনান। নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। শাস্ত্রে অগাধ জ্ঞান ভৈরবীর। কিন্তু নানা লোকের মনে নানা রকম সন্দেহ। সুন্দরীর ভৈরবী কি রম্ভা মেনকার মত গদাধরের মনের পরিবর্তন ঘটাতে এসেছেন?
কিন্তু কিছুদিন পরেই দেখা গেল, ভৈরবী এসেছেন গদাধরের প্রকৃত রূপ উদঘাটনের জন্য। তিনি বললেন, গদাধর মানব দেহধারী শ্রীরামচন্দ্র। তান্ত্রিক মতে শক্তি-দীক্ষা তিনি দিলেন গদাধরকে।
একদিন মড়ার মাথার খুলিতে মাছ বেঁধে ভোগ সাজালেন। কালীকে নিবেদন করে গদাধরকে বললেন, প্রসাদ নাও। গদাধর নির্বিবাদে প্রসাদ গ্রহণ করলেন।
ভৈরবী বললেন, এবার বৈষ্ণবমতে সাধনা কর বাবা। চারটি বেদ, আঠারোটি পুরাণ, চৌষট্টি তন্ত্রে যে রাস মেলে না, তাই মেলে না, তাই মেলে বৈষ্ণব মতে সাধনায়।
গদাধর রাজী হলেন। কী অপূর্ব যোগাযোগ! সেই সময়ে এলেন বেদান্তপন্থী অদ্বৈতবাদী সন্ন্যাসী পরমহংদেবের দল। তাঁদের সঙ্গে করেন শাস্ত্র আলোচনা। অতি সহজভাবে গভীর তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করলেন। সাধুরা খুশী হলে আশীর্বাদ করে গদাধরকে বললেন, তুমি ধর্মের সারমর্ম বুঝেছ। তুমি পরমহংস।
কিছুদিন পর এলেন সন্ন্যাসী তোতাপুরী। পাঞ্জাবের লুধিয়ানায় তার মঠ। চল্লিশ বছর সাধনা করেছেন। বেরিয়েছেন তীর্থ দর্শনে। তাঁকে দেখে গদাধর ভক্তিভরে প্রণাম করলেন। যেন কতকালের পরিচিত। গদাধর বললেন, আমাকে দীক্ষা দিন।
তোতাপুরী বললেন, দিতে রাজী আছি, কিন্তু তোমাকে গৈরিক বস্ত্র পরতে হবে। গদাধর বললেন, গৈরিক পরতে পারব না। ছোটবেলাতেই মায়ের কাছে কথা দিয়েছি। সন্ন্যাসী না সেজেও আমি সন্ন্যাস নেব।
তোতাপুরী ভাবলেন, মনে যার রং ধরেছে, তার দেবহারণের রং বিচার করে লাভ নেই। তাই তিনি গদাধরকে দীক্ষা দিলেন। বললেন, আজ তোমার নতুন জন্মলাভ হল। তোমার নাম এখন হবে রামকৃষ্ণ আর পদবী হবে পরমহংস। পরমহংস কাকে বলে জান তো? দুধে জলে এক সঙ্গে থাকলেও যিনি হাসের মত জলটি ছেড়ে দুধটি নিতে পারেন, তিনিই পরমহংস।
তোতাপুরী বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। কদিন পরেই এলেন গোবিন্দ রায়। জাতে ক্ষত্রিয়। কিন্তু মুসলমান হয়েছেন। আরবী ফারসীতে পণ্ডিত। রামকৃষ্ণ তাকে বললেন, আমি মুসলমান ধর্মমতে সাধন ভজন করব। কত মানুষ কত পথে সাধনা করে বাঞ্ছিত ধামে গিয়ে পৌঁছায়। আমি এই পথটাকে বাদ দেব কেন?
গোবিন্দ রায় দীক্ষা দিলেন রামকৃষ্ণকে। কাছা খুলে ফেললেন। কাপড় পরলেন লুঙ্গির মত করে। পাঁচ বেলা নামাজ পড়তে লাগলেন। একদিন মুসলমানদের রান্নার মত রান্না করিয়ে খেলেন।
একদিন ভাবাবিষ্ট অবস্থায় রামকৃষ্ণ দেখলেন গৌরবর্ণ সুপুরুষ যীশুখ্রীস্ট এসে তাঁর সামনে দাঁড়িয়েছেন। যীশুর ভজনা করতে করতে তিনি সমাধিস্থ হয়ে গেলেন।
মা চন্দ্রমণিও ছেলে গদাধরকে দেখবার জন্য দক্ষিণেশ্বরে এলন। তিনি নহবতের ঘরে থাকেন। ছেলের সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হয়। কিছুদিন পর স্ত্রী সারদামণিরও এসে হাজির হলেন। রামকৃষ্ণ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি গো, তুমি কি আমাকে সংসার পথে টেনে নিতে এসেছ?
সারদা জবাব দিলেন, না। তোমার ইষ্টপথে সাহায্য করার জন্যই আমি এসেছি।
ঠাকুর রামকৃষ্ণের শিক্ষায় শ্রীমতী সারদা সুনিপুণা হতে লাগলেন। প্রকাশ পেতে লাগলেন জগতের মঙ্গলসাধিকা শক্তিরূপে।
চন্দ্রমণির বয়স অনেক হয়েছিল। শেষ বয়সে ছেলেকে দেখবার আকাঙ্খা হয়েছিল ভিষণ 1 সে আশা তাঁর পুরণ হল। একদিন দক্ষিণেশ্বরেই রোগশয্যায় পুত্রকে শিয়রে রেখে মা চোখ বুজলেন।
রামকৃষ্ণ স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। দক্ষিণেশ্বরও হয়ে উঠেছে তীর্থভূমি। সেখানে মাঝে মাঝেই এসে উপস্থিত হন কত সাধুপুরুষ, কত গুণী জ্ঞানী। বিখ্যাত মানুষ। তিনিও মাঝে মাঝে বিখ্যাত মানুষদের বাড়ি যান। একদিন গেলেন মহষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি। খ্রীষ্টধর্মের বন্যায় যখন দেশটা ডুবে যাবার উপক্রম হয়েছিল। তখন ব্রাহ্মণধর্মের জীবন তরণী ভাসিয়ে বহু মানুষকে উদ্ধার করেছেন। দেবেন্দ্রনাথকে রামকৃষ্ণ বললেন, তুমি তো পাকা খেলোয়াড় হে। একসঙ্গে দু’খানা তলোয়ার ঘোরাও, একটি কর্মের আর একটি জ্ঞানের।
ব্রাহ্মণধর্মের অন্যতম প্রবর্তক কেশবচন্দ্র সেনের বাড়িও গেলেন একদিন। সেখানে গিয়ে গান করতে করতে রামকৃষ্ণ সমাধিস্থ হয়ে পড়লেন। আর একদিন গেলেন বিদ্যাসাগরের বাড়িতে। বললেন, এতদিন খাল বিল দেখেছি, এবার সাগর দেখলুম। বিদ্যাসাগর হেসে বললেন, তবে নোনা জল খানিকটা নিয়ে যান। রামকৃষ্ণ বললেন, না গো! নোনা জল কেন? তুমি যে বিদ্যার সাগর, ক্ষীরসমুদ্র।
নরেন্দ্রনাথ নিজেই এসেছিলেন রামকৃষ্ণের কাছে। বিখ্যাত দত্ত বাড়ির ছেলে, শিক্ষিত তরুণ। রামকৃষ্ণের প্রভাবে তিনি হয়ে গেলেন স্বামী বিবেকানন্দ।
ঠাকুর রামকৃষ্ণ শুধু সাধকই নন, তিনি যে প্রেমাবতার। প্রেম বিলাতে বিলাতে তিনি মানুষের মনের কলুষকে দূর করতে লাগলেন, মানুষের মনের পাপ হরণ করতে গিয়ে নিজেই হলেন নীলকণ্ঠ।
গলায় তাঁর ক্ষতরোগ হল। ক্যান্সার। চিকিৎসার জন্য তাকে চিকিৎসকের নির্দেশে শিষ্যদের এবং সাধারণ মানুষের তাঁর কাছে যেতে মানা। কিন্তু প্রেমের ঠাকুর রামকৃষ্ণ সেই নিষেধ উপেক্ষা করে কল্পতরু উৎসবের অনুষ্ঠান করলেন। সর্বধর্মের সকল শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে মিশে হৃদয়ের প্রেম নিঃশেষে বিতরণ করতে লাগলেন।
ইংরেজি ১৮৮৬ সাল, বাংলা ১২৯৩ সালের ১লা ভাদ্র মহাসমাধিতে নিমগ হলেন যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ।
তথ্যসূত্রঃ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী – মাইকেল এইচ. হার্ট / সম্পাদনায় – রামশংকর দেবনাথ