হযরত মূসা (Hazrat Musa)

প্রথম পাতা » জীবনী » হযরত মূসা (Hazrat Musa)


হযরত মূসা

হযরত মুসা

(খ্রীষ্ট পূর্ব ত্রয়োদশ শতাব্দী)
প্রাচীন মিশরের রাজধানী ছিল পেন্টাটিউক। নীল নদের তীরে এই নগরে বাস করতেন মিশরের “ফেরাউন” রামেসিস। নগরের শেষ প্রান্তে ইহুদিদের বসতি। মিশরের “ফেরাউন” ছিলেন ইহুদিদের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন। একবার কয়েকজন জ্যোতিষী গণনা করে তাকে বলেছিলেন, ইহুদি পরিবারের মধ্যে এমন এক সন্তান জন্মগ্রহণ করবে যে ভবিষ্যতে মিশরের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। জ্যোতিষীদের কথা শুনে ভীত হয়ে পড়লেন ফ্যারাও। তাই “ফেরাউন” আদেশ দিলেন কোন ইহুদি পরিবারে সন্তান জন্মগ্রহণ করলেই যেন হত্যা করা হয়।

“ফেরাউন” এর গুপ্তচররা চতুর্দিকে ঘুরে বেড়াত। যখনই কোন পরিবারে সন্তান জন্মবার সংবাদ পেত তখনই গিয়ে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করত।

ইহুদি মহল্লায় বাস করতেন আসরাম আর জোশিবেদ নামে এক সদ্যবিবাহিত দম্পতি। যথাসময়ে জোশিবেদের একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করল। সন্তান জন্মাবার পরই স্বামী-স্ত্রীর মনে হল যেমন করেই হোক এই সন্তানকে রক্ষা করতেই হবে। কে বলতে পারে এই সন্তানই হয়ত ইহুদি জাতিকে সমস্ত নির্যাতন থেকে রক্ষা করবে একদিন।

সকলের চোখের আড়ালে সম্পূর্ণ গোপনে শিশুসন্তানকে বড় করে তুলতে লাগলেন আসরাম আর জোশিবেদ। কিন্তু বেশিদিন এই সংবাদ গোপন রাখা গেল না। স্বামী-স্ত্রী বুঝতে পারলেন যে কোন মুহূর্তে “ফেরাউন”-এর সৈনিকরা এসে তাদের সন্তানকে তুলে নিয়ে যাবে। ঈশ্বর আর ভাগ্যের হাতে শিশুকে সঁপে দিয়ে দুজন বেরিয়ে পড়লেন। নীল নদের তীরে এক নির্জন ঘাটে এসে শিশুকে শুইয়ে দিয়ে তারা বাড়ি ফিরে গেলেন।

সেই নদীর ঘাটে প্রতিদিন গোসল করতে আসত “ফেরাউনের কন্যা। ফুটফুটে সুন্দর একটা বাচ্চাকে একা পড়ে থাকতে দেখে তার মায়া হল। তাকে তুলে নিয়ে এল রাজপ্রাসাদে। তারপর সেই শিশু সন্তানকে নিজের সন্তানের মত স্নেহ-ভালবাসা দিয়ে মানুষ করে তুলতে লাগল। রাজকন্যা শিশুর নাম রাখল মুসা।

এ বিষয়ে আরেকটি কাহিনী প্রচলিত। মুসার মা জোশিবেদ জানতেন প্রতিদিন “ফেরাউন”-এর কন্যা সখীদের নিয়ে নদীতে স্নান করতে আসেন। একদিন ঘাটের কাছে পথের ধারে শিশু মুসাকে একটা ঝুড়িতে করে শুইয়ে রেখে দিলেন। নিজের গাছের আড়ালে লুকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর রাজকুমারী সেই পথ দিয়ে স্নান করতে যাবার সময় দেখতে পেল মুসাকে। পথের পাশে ফুটফুটে একটা শিশুকে পড়ে থাকতে দেখে তার মায়া হল। তাড়াতাড়ি মুসাকে কোলে তুলে নিল। জোশিবেদকেই মুসাকে ধাত্রী হিসাবে নিয়োগ করে রাজকুমারী। নিজের পরিচয় গোপন করে রাজপ্রাসাদে মুসাকে দেখাশুনা করতে থাকে জোশিবেদ। মা ছাড়া মুসা কোন নারীর স্তন্যপান করেনি।

ধীরে ধীরে কৈশোর থেকে যৌবনে পা দিলেন মুসা। ফ্যারাওয়ের অত্যাচার বেড়েই চলছিল। ইহুদির উপর এই অত্যাচার ভাল লাগত না মুসার। পুত্রের মনোভাব জানতে পেরে একদিন জোশিবেদ তার কাছে নিজের প্রকৃত পরিচয় দিলেন। তারপর থেকে মুসার অন্তরে শুরু হল নিদারুণ যন্ত্রণা।

একদিন রাজপথ দিয়ে যাচ্ছিলেন মুসা। এমন সময় তার চোখে পড়ল এক হতভাগ্য ইহুদিকে নির্মমভাবে প্রহার করছে তার মিশরীয় মনিব। এই দৃশ্য দেখে আর স্থির থাকতে পারলেন না মুসা। তিনি সেই ইহুদিকে উদ্ধার করবার জন্য নিজের হাতে তরবারী দিয়ে আঘাত করলেন মিশরীর মনিবকে। সেই আঘাতে মারা গেল মিশরীয় লোকটি। ইহুদি লোকটি চারদিকে এ কথা প্রকাশ করে দিল। গুপ্তচররা “ফেরাউনকে গিয়ে সংবাদ দিতেই ক্রোধে ফেটে পড়লেন “ফেরাউন”। তিনি বুঝতে পারলেন রাজকন্যা মুসাকে মানুষ করলেও তার শরীরে বইছে ইহুদি রক্ত, তাই নিজের ধর্মের মানুষের উপর অত্যাচার হতে দেখে মিশরীয়কে হত্যা করেছে। একে যদি মুক্ত রাখা যায় তবে বিপদ অবশ্যম্ভাবী। তখনই সৈনিকদের ডেকে হুকুম দিলেন, যেখানে থেকে পার মুসাকে বন্দী করে নিয়ে এস।

“ফেরাউন”-এর আদেশে কথা শুনে আর বিলম্ব করলেন না মুসা। তৎক্ষণাৎ নগর ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়লেন।

দীর্ঘ পথশ্রমে মুসা ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর চোখে পড়ল দূরে একটি কুয়ো। কুয়োর সামনে সাতটি মেয়ে তাদের ভেড়াকে পানি খাওয়াচ্ছিল। হঠাৎ একদল মেষপালক সেখানে এসে মেয়েদের কাছে থেকে জোর করে ভেড়াগুলোকে কেড়ে নিল। সাথে সাথে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দিল সাত বোন। তাদের চিৎকার শুনে ছুটে এলেন মুসা। তারপর মেষপালকদের কাছ থেকে সবকটা ভেড়া উদ্ধার করে মেয়েদের ফিরিয়ে দিলেন। মেয়েরা তাঁকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়ি ফিরে গেল।

সাত বোনের বাবার নাম ছিল রুয়েন। সাত বোন এসে মুসাকে ডেকে নিয়ে গেল। তাদের বাড়িতে। তাঁর পরনের মূল্যবান পোশাক, সম্ভ্রমপূর্ণ ব্যবহার দেখে সকলেই মুগ্ধ হয়ে গেল। রুয়েন তার পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই কোন কথা গোপন করলেন না মুসা। অকপটে নিজের পরিচয় দিলেন। রুয়েন মুসার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে তাকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিল। অল্প কিছুদিন পর এক মেয়ের সাথে তাঁর বিয়ে দিলে রুয়েন।

সেই যাযাবর গোষ্ঠীর সাথে থাকতে থাকতে অল্প দিনেই মেষ চরানোর কাজ শিখে নিলে মুসা। এক নতুন পরিবেশের সাথে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে মানিয়ে নিলেন। দেখতে দেখতে বেশ কয়েক বছর কেটে গেল।

ওদিকে মিশরে ইহুদিদের অবস্থা ক্রমশই দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল।

মিডিয়াতে পশুপালকের জীবন যাপন করলেও স্বজাতির কথা ভুলতে পারেননি মুসা। মাঝে মাঝেই তার সমস্ত অন্তর ব্যথিত হয়ে উঠত।

একদিন মেষের পাল নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে নির্জন পাহাড়ের প্রান্তে এসে পৌঁছলেন মুসা। সামনেই বেশ কিছু গাছপালা। হঠাৎ মুসা দেখলেন সেই গাছপালা পাহাড়ের মধ্যে থেকে এক আলোকছটা বেরিয়ে এল। এত তীব্র সেই আলো, মনে হল দু চোখ যেন ঝলসে যাচ্ছে। তবুও স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন সেই আলোর দিকে। তার মনে হল ঐ আলো যেন তাঁকে আচ্ছান্ন করে ফেলছে। এক সময় শুনতে পেলেন সেই আলোর মধ্যে থেকে এক অলৌকিক কণ্ঠস্বর ভেসে এল: মুসা মুসা।

চমকে উঠলেন মুসা। কেউ তাঁরই নাম ধরে ডাকছে। তৎক্ষণাৎ সাড়া দিলেন, কে আপনি আমায় ডাকছেন? সেই অলৌকিক কণ্ঠস্বর বলে উঠল, আমি তোমার ও তোমার পূর্বপুরুষদের একমাত্র ঈশ্বর।

ঈশ্বর তাঁর সাথে কথা বলছেন, এ যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না মুসা। ভীত হয়ে মাটিতে নতজানু হয়ে বসে পড়লেন। আমার কাছে আপনার কি প্রয়োজন প্রভু?

দৈবকণ্ঠস্বর বলল, তুমি আমার প্রতিনিধি হিসাবে মিশরে যাও। সেখানে ইহুদিরা অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করছে। তুমি ইহুদিদের মুক্ত করে নতুন দেশে নিয়ে যাবে।

মুসা বললেন, আমি কেমন করে তাদের মুক্তি দেব?

দৈববাণী বলল, আমি অদৃশ্যভাবে তোমাকে সাহায্য করব। তুমি ফ্যারাও-এর কাছে গিয়ে বলবে, আমিই তোমাকে প্রেরণ করেছি। সকলেই যেন তোমার আদেশ মেনে চলে।

মুসা বললেন, কিন্তু যখন তারা জিজ্ঞেস করবে ঈশ্বরের নাম, তখন কি জবাব দেব? প্রথমে ঈশ্বর তাঁর নাম প্রকাশ না করলেও পরে বললেন তিনিই এই বিশ্বজগতের স্রষ্টা আল্লাহ।

মুসা অনুভব করলেন তাঁর নিজের শক্তিতে নয়, ঈশ্বর প্রদত্ত শক্তিতেই তাঁকে সমস্ত কাজ সমাধান করতে হবে। এতদিন ঈশ্বর সম্বন্ধে তাঁর কোন স্পষ্ট ধারণা ছিল না। এই প্রথম অনুভব করলেন ঈশ্বর-নির্দিষ্ট কাজের জন্যই তিনি পৃথিবীতে এসেছেন। আর আল্লাহ তাঁর একমাত্র ঈশ্বর।

এর কয়েক দিন পর দ্বিতীয়বার ঈশ্বরের আদেশ পেলেন মুসা। তিনি পুনরায় আবির্ভূত হলেন মুসার সামনে। তারপর বললেন, তোমার উপর আমি প্রসন্ন হয়েছি। একমাত্র তুমিই পারবে ইহুদি জাতিকে এই সংকট থেকে উদ্ধার করতে। আর বিলম্ব করো না, যত শীঘ্র সম্ভব রওনা হও মিশরে। অল্প কয়েক দিন পর স্ত্রী-সন্তানদের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে মিশরের পথে যাত্রা করলেন যাত্রা করলেন মুসা।

যথাসময়ে মিশরে গিয়ে পৌঁছলেন মুসা। গিয়ে দেখলেন সত্যি সত্যিই ইহুদিরা অবর্ণনীয় দুরবস্থায় মধ্যে বাস করছে।

মুসা প্রথমেই সাক্ষাৎ করলেন ইহুদিদের প্রধান নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে। তাদের সকলকে বললেন ঈশ্বরের আদেশের কথা। মুসার আচার-আচরণ, তাঁর ব্যক্তিত্ব, আন্তরিক ব্যবহার, গভীর আত্মপ্রত্যয় দেখে সকলেই তাঁকে বিশ্বাস করল।

মুসা বললেন, আমরা “ফেরাউন”-এর কাছে গিয়ে দেশত্যাগ করবার অনুমতি প্রার্থনা করব। মুসা তার ভাই এ্যাবন ও কয়েকজন ইহুদি নেতাকে সাথে নিয়ে গিয়ে হাজির হলেন “ফেরাউন”-এর দরবারে। মুসা জানতেন সরাসরি দেশত্যাগের অনুমতি চাইলে কখনোই ফ্যারাও সেই অনুমতি দেবেন না। তাই তিনি বললেন, সম্রাট, আমাদের। স্রষ্টা আদেশ দিয়েছেন সমস্ত ইহুদিকে মিডিয়ার মরুপ্রান্তরে এক পাহাড়ে গিয়ে প্রার্থনা করতে। আপনি যদি কয়েক দিনের জন্য সেখানে যাবার অনুমতি দেন।

“ফেরাউন মুসার অনুরোধে সাড়া দিলেন। ক্রুদ্ধ স্বরে বলে উঠলেন, তোমাদের আল্লাহর আদেশ আমি মানি না। তোমরা মিশর ত্যাগ করে কোথাও যেতে পারবে না।

মুসা বললেন, আমরা যদি মরুভূমিতে গিয়ে প্রার্থনা না করি তবে তিনি আমাদের উপর ক্রুদ্ধ হবেন। হয়ত আমাদের সকলকেই ধ্বংস করে ফেলবেন।

ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে এলেন মুসা। কি করবেন কিছুই ভাবতে পারছিলেন না। শেষে নিরুপায় হয়ে আল্লাহর কাছে আকুল হয়ে প্রার্থনা করলেন। তার প্রার্থনায় সাড়া দিলেন আল্লাহ। তিনি মুসাকে বললেন, তোমার ভাই এ্যারনকে বল, সে যেন নদী, জলাশয়, পুকুর ঝর্ণায় গিয়ে তার জাদুদণ্ড স্পর্শ করে, তাহলেই দেখবে সমস্ত পানি রক্ত হয়ে গিয়েছে।

আল্লাহ নির্দেশের এ্যারন মিশরের সমস্ত পানীয় জলকে রক্তে রূপান্তরিত করে ফেলল। ফ্যারাও আদেশ দিলেন মাটি খুড়ে পানি বার কর।

সৈনিকরা অসংখ্যা কূপ খুঁড়ে ফেলল। সকলে সেই জল পান করতে আরম্ভ করল। এ্যারনের জাদু বিফল হতেই মুসা পুনরায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন।

এইবার মিশর জুড়ে ব্যাঙের মহামারী দেখা গেল। তার পচা গন্ধে লোকের প্রাণান্তরক অবস্থা কেউ আর ঘরে থাকতে পারে না। সকলে গিয়ে “ফেরাউনের কাছে নালিশ জানাল। নিরুপায় হয়ে “ফেরাউন” ডেকে পাঠালেন মুসাকে। বললেন, তুমি ব্যাঙের মড়ক বন্ধ কর। আমি তোমাদের মরুভূমিতে গিয়ে প্রার্থনা করবার অনুমতি দেব।

মুসার ইচ্ছায় ব্যাঙের মড়ক বন্ধ হলেও ফ্যারাও নানান অজুহাতে ইহুদিদের যাওয়ার অনুমতি দিলেন না।

নিরুপায় হয়ে মুসা আবার আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন। ফ্যারাওয়ের আচরণে এই বার ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন আল্লাহ। সমস্ত মিশর জুড়ে শুরু হল ঝড়-ঝঞ্ঝা বৃষ্টি মহামারী। তবুও “ফেরাউন” অনুমতি দিতে চান ন।

এই বার আল্লাহ নির্মম অস্ত্র প্রয়োগ করলেন। হঠাৎ সমস্ত মিশরীয়দের প্রথম পুত্র সন্তান মারা পড়ল। দেশজুড়ে শুরু হল হাহাকার। সমস্ত মিশরীয়রা দলবদ্ধভাবে গিয়ে “ফেরাউন”-এর কাছে দাবি জানাল, ইহুদিদের দেশ ছাড়ার অনুমতি দিন, না হলে আরো কি গুরুতর সর্বনাশ হবে কে জানে।

ভয় পেয়ে গেলেন ফ্যারাও। “ফেরাউন মুসাকে ডেকে বললেন, প্রার্থনা করবার জন্য তোমাদের মরুভূমিতে যাবার অনুমতি দিচ্ছি। যদি মনে কর, তোমাদের যা কিছু আছে, গৃহপালিত গবাদি পশু, জীবজন্তু, জিনিসপত্র, সব সাথে নিয়ে যেতে পার।

দেশত্যাগের অনুমতি পেয়ে ইহুদিরা সকলেই উল্লসিত হয়ে উঠল। তারা সকলেই মুসাকে তাদের নেতা বলে স্বীকার করে নিল। মিশর ছাড়াও মাকুম নগরেও বহু ইহুদি বাস করত। সকলে দলবদ্ধভাবে মুসাকে অনুসরণ করল।

মুসা জানতেন আল্লাহর শাস্তির ভয়ে ফ্যারাও দেশত্যাগের অনুমতি দিলেও তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করবেন যাতে তাদের যাত্রাপথে বিঘ্ন সৃষ্টি করা যায়। তাই যথাসম্ভব সতর্ক ভাবে পথ চলতে লাগলেন।

কয়েকদিন চলবার পর তারা সকলে এসে পড়ল লোহিত সাগরের তীরে।

এদিকে ইহুদিরা মিশর ত্যাগ করতেই “ফেরাউন”-এর মনের পরিবর্তন ঘটল। যেমন করেই হোক তাদের ফিরিয়ে নিয়ে এসে আবার ক্রীসদাসে পরিণত করতে হবে। তৎক্ষণাৎ ইহুদিদের বন্দী করবার জন্য বিশাল এক সৈন্যবাহিনীকে পাঠালেন “ফেরাউন”।

এদিকে দূর থেকে মিশরীয় সৈন্যদের দেখতে পেয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ল সমস্ত ইহুদীরা। সামান্যতম বিচলিত হলেন না মুসা।

প্রার্থনায় বসলেন মুসা। প্রার্থনা শেষ হতেই দৈববাণী হল, মুসা, তোমার হাতের দণ্ড তুলে সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে যাবে। সমুদ্রের পানি তোমাদের স্পর্শ করবে না।

মুসা তাঁর হাতের দণ্ড তুলে সমুদ্রের সামনে এসে দাঁড়াতেই সমুদ্র দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল। তার মধ্যে দিয়ে প্রসারিত হয়েছে প্রশান্ত পথ। সকলের আগে মুসা, তার পেছনে সমস্ত ইহুদি-নারী-পুরুষের দল সেই পথ ধরে এগিয়ে চলল। তারা কিছুদূর যেতেই মিশরীয় সৈন্যরা এসে পড়ল সমুদ্রের তীরে। ইহুদিদের সমুদ্রের মাঝখান দিয়ে যেতে দেখে তারাও তাদের অনুসরণ করে সেই পথে ধরে এগিয়ে চলল। সমস্ত মিশরীয় বাহিনী সমুদ্রের মধ্যে নেমে আসতেই আল্লাহর নির্দেশ শুনতে পেলেন মুসা, তোমার হাতের দণ্ড পেছন ফিরে নামিয়ে দাও।

মুসা তার হাতে দণ্ড নিচু করতেই সমুদ্রের জলরাশি এসে আছড়ে পড়ল মিশরীয় সৈন্যদের উপর। মুহূর্তে বিশাল সৈন্যবাহিনী সমুদ্রের অতল গহরে হারিয়ে গেল। ইহুদিরা নিরাপদে তীরে গিয়ে উঠল।

মুসা সকলকে নিয়ে এগিয়ে চললেন। সামনে বিশাল মরুভূমি। সামান্য পথ অতিক্রম করতেই তাদের সঞ্চিত পানি, খাবার ফুরিয়ে গেল। মরুভূমির বুকে কোথাও পানির চিহ্নমাত্র নেই। ক্রমশই সকলে তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ছিল। অনেকে আর অগ্রসর হতে চাইছিল না।

মুসা বিচলিত হয়ে পড়লেন, এতগুলো মানুষকে কোথা থেকে তৃষ্ণার পানি দেবেন। কিছুদূর যেতেই এক জায়গায় পানি পাওয়া গেল। এত দুর্গন্ধ সেই পানি, কার সাধ্য তা মুখে দেয়। প্রার্থনায় বসলেন মুসা। প্রার্থনা শেষ করে আল্লাহর নির্দেশে কিছু গাছের পাতা ফেলে দিলেন সেই পানির মধ্যে। সাথে সাথে সেই পানি সুস্বাদু পানীয় হয়ে উঠল। সকলে তৃষ্ণা মিটিয়ে সব পাত্র ভরে নিল। যারা মুসাকে দোষারোপ করছিল, তারা অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা-ভিক্ষা চাইল। সকলে মুসাকে তাদের ধর্মগুরু ও নেতা হিসাবে স্বীকার করে নিল। সকলে তাঁর নির্দেশ মত এগিয়ে চলল। কিছুদিনের মধ্যেই সমস্ত খাবার ফুরিয়ে গেল। আশেপাশে কোথাও কোন খাবারবের সন্ধান পাওয়া গেল না। খিদের জ্বালায় সকলেই ক্লান্ত হয়ে পড়ল। আবার তারা দোষারোপ করতে আরম্ভ করল মুসাকে। তোমার জন্যেই আমাদের এত কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে।

মুসা সকলকে শান্ত করে বললেন, তোমরা ভুলে গিয়েছ আমাদের ঈশ্বর আল্লাহর কথা। তিনি “ফেরাউনকে” তোমাদের দেশত্যাগের অনুমতি দিতে বাধ্য করেছেন। তিনি সমুদ্রকে দ্বিধাবিভক্ত করেছেন, সৈন্যদের হাত থেকে তোমাদের রক্ষা করেছেন। তোমাদের পানীর ব্যবস্থা করেছেন। তবুও তোমরা তাঁর শক্তিতে সন্দেহ প্রকাশ করছ।

মুসার কথা শেষ হতেই কোথা থেকে সেখানে উড়ে আসে অসংখ্য পাখির ঝাঁক। ইহুদিরা ইচ্ছামত পাখি মেরে মাংস খায়। আর কারো মনে কোন সংশয় থাকে না। মুসাই তাদের অবিসংবাদিত নেতা। সকলে শপথ করে জীবনে-মরণে তারা মুসার সমস্ত আদেশ মেনে চলবে।

মুসা সমস্ত ইহাদিদের নিয়ে এলেন এফিডিম নামে এক নির্জন প্রান্তে। চারদিকে ধু ধু বালি, মাঝে মাঝে ছোট পাহাড়, কোথাও পানীর কোন উৎস নেই।

মুসা আবার এগিয়ে চললেন। কিছুদূর গিয়ে একটা বড় পাহাড়ের সামনে এসে দাঁড়ালেন। আল্লাহর নির্দেশে একটা পাথর সরাতেই বেরিয়ে এল স্বচ্ছ পানির এক ঝর্ণাধারা। সেই পানিতে সকলের তৃষ্ণা মিটল।

মুসা যেখানে এসেছিলেন তার অদূরেই প্যালেস্তাইনে তখন বাস করত আমালেক নামে এক উপজাতি সম্প্রদায়। নতুন একদল মানুষকে তাদের অঞ্চলে প্রবেশ করতে দেখে তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হল।

অপরদিকে ইহুদিরা দীর্ঘ পথশ্রমে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, অবসন্ন, সকলে মুসাকে বলল, এই যুদ্ধে আমাদের নিশ্চিত পরাজয় হবে। তুমি অন্য কোথাও আশ্রয়ের সন্ধানে চল।

মুসা সকলকে সাহস দিয়ে তাঁর দলের সমস্ত পুরুষদের একত্রিত করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। যুদ্ধ পরিচালনার ভার দেওয়া হল জোশুয়া নামে এক সাহসী যুবককে। শুরু হলে গেল তুমুল যুদ্ধ। মুসা নিজে যুদ্ধে যোগ দিলেন। আল্লাহ্র নির্দেশে পাহাড়ের উপর উঠে তার হাতের দণ্ড আকাশের দিকে তুলে ধরলেন। যুদ্ধের প্রথমে আমালেকরা ইহুদিদের বিপর্যন্ত করছিল। কিন্তু মুসা তাঁর দণ্ড ঊর্ধ্বাকাশে তুলে ধরতেই যুদ্ধের গতি পরিবর্তন হল। ইহুদিরা বীর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমালেকদের উপর। ইহুদিদের সেই প্রচণ্ড বিক্রম সহ্য করতে পারল না আমালেকরা। বিপর্যন্ত বিধ্বস্ত হয়ে তারা পালিয়ে গেল।

ইহুদিরা নতুন উদ্যমে এগিয়ে চলল প্যালেস্তানেই দিকে। পথে সিনাই পর্বত। এখানে পানি ও গাছপালার কোন অভাব নেই দেখে মুসা সেখানেই সকলকে তাবু খাটাবার নির্দেশ দিলেন।

সেই সময় মুসার শ্বশুর জেথ্রো তার স্ত্রী, দুই পুত্র, সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে সেই পথ ধরে যাচ্ছিল। কাছে আসতেই বুঝতে পারলেন এরা দেশত্যাগী ইহুদি জাতি। তার জামাই-এর নেতৃত্বে এখানে বসতি স্থাপন করেছে।

জেথ্রো ছিলেন উপজাতি সম্প্রদায়ে পুরোহিত। নানান দেবদেবীর পূজা করতেন তিনি। মুসাকে বললেন, তোমাদের আল্লাহর কথা শুনে উপলব্ধি করতে পেরেছি, তিনি সকল দেবতার ঊর্ধ্বে, তিনিই সমস্ত শক্তির উৎস। এতদিন আমি ভুল পথে চালিত হয়েছি। যে সব দেবতাকে পূজা-অর্চনা করেছি তারা কেউই আল্লাহর সমকক্ষ নন। আমি তার ইবাদত করতে চাই।

মুসা ইহুদিদের মধ্যে থেকে সৎ ন্যায়বান জ্ঞানী মানুষদের বিচারক হিসাবে নিযুক্ত করলেন।

এই সময় মুসা একদিন গভীর রাতে আল্লাহর দৈববাণী শুনতে পেলেন মুসা; আমি আমার এক দূতকে তোমাদের কাছে পাঠাব। তোমরা সকলে তাকে অনুসরণ করবে। যে পথে তোমরা যাবে সেই পথে নানান বাধা আসবে। শক্ররা তোমাদের যাত্রাপথে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে। কিন্তু আমার আশীর্বাদে তোমাদের কোন ক্ষতি হবে না। তুমি বীরদর্পে এগিয়ে যাবে। পথে অন্য কোন দেবতার মূর্তি বিগ্রহ মন্দির দেখলেই তা ধ্বংস করবে। আর সর্বত্র আমার উপদেশ প্রচার করবে। যারা মূর্তি পূজা করবে তারা আমার শত্রু, তুমি তাদের ধ্বংস করবে।

পরদিন মুসা ইহুদিদের সকলকে ডেকে বললেন তোমরা সকলে আগামী দুদিন শুদ্ধ পবিত্রভাবে থাকবে। তৃতীয় দিন দেবদূতের আবির্ভাব হবে। তখন আমরা তাঁকে অনুসরণ করব।

দুদিন কেটে গেল। তৃতীয় দিন ভোর থেকেই ঘন মেঘে আকাশ ছেয়ে গেল। তারই সাথে ঘন ঘন বিদ্যুতের চমক, বজ্রের নিঘোর্ষ। হঠাৎ ঘন মেঘপুঞ্জের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল এক তীব্র আলোকছটা। তার আলোয় সব অন্ধকার কেটে গেল। দেখা গেল এক টুকরো ভাসমান মেঘ আকাশ থেকে নেমে এল সিনাই পর্বতের মাথায়। এক মেঘ থেকে সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলি বার হয়ে পাহাড়ের সমস্ত চূড়াকে আচ্ছন্ন করে ফেলল।

এমন সময় সইে মেঘপুঞ্জ থেকে অলৌকিক কণ্ঠস্বর ভেসে এল, মুসা, তুমি পাহাড়ের চূড়ায় উঠে এস।

পাহাড়ের চূড়ায় উঠতেই মুসা শুনতে পেলেন আল্লাহর কণ্ঠস্বর, হে আমার প্রিয় ভক্ত, আমি তোমার মাধ্যমে সমস্ত ইহুদিদের দশটি নিয়ম জানাতে চাই। শুধু মাত্র আমাকে মানলেই চলবে না। এই দশটি নিয়ম তোমাদের সকলকে মেনে চলতে হবে।

আল্লাহ তখন মুসার কানে কানে দশটি নির্দেশ দিলেন। এদের বলে টেন কম্যান্ডমেন্টস্।

মুসাকে আরো কিছু নির্দেশ দিয়ে আল্লাহর অদৃশ্য কণ্ঠস্বর বাতাসে মিলিয়ে গেল। ঝরে গেল সেই আলোকরশ্মি মেঘপুঞ্জ। সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এল।

নিয়ম দশটি নিম্নরূপঃ

এক–আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ঈশ্বর নেই। তোমরা আল্লাহ ছাড়া অপর কোন দেবতার ইবাদত করবে না।

দুই–আল্লাহকে শুধু মাত্র উপাস্য হিসাবে মান্য করলেই হবে না। তাঁর প্রতিটি নির্দেশ আদেশ মেনে চলতে হবে।

তিন–সপ্তাহের ছয় দিন কাজ করবে। সপ্তম দিন কোন কাজ করবে না। এই দিন স্যাবাথ বা পবিত্র বিশ্রামের দিন।

চার–পিতামাতাকে ভক্তি করবে, শ্রদ্ধা করবে, তাঁদের প্রতি পালনীয় কর্তব্য অবশ্যই পালন করবে।

পাঁচ–কোন মানুষকে হত্যা করো না।

ছয়–কোন নারী বা পুরুষ কখনোই ব্যভিচার করবে না।

সাত–অপরের দ্রব্য অপহরণ করবে না।

আট–মিথ্যা সাক্ষ্য দেবে না।

নয়–অন্য জিনিসের প্রতি কোন লোভ করবে না, বা যাতে অন্যের অধিকার আছে। তা গ্রহণ করবে না।

দশ––উপাসনাস্থল বেদী নির্মাণ করে পশুবলি দিতে হবে।

পাথর স্থাপন করা হল পাহাড়ের গায়ে। যাতে ইহুদিদের ভবিষ্যৎ বংশধররা জানতে পারে ঈশ্বরের আদেশের কথা।

এইবার মুসা ঈশ্বরের ধ্যান করবার জন্য পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গেলেন। দীর্ঘ চল্লিশ দিন ধরে গভীর সাধনায় মগ্ন হয়ে রইলেন মুসা।

এদিকে মুসা অনুপস্থিতিতে সকলেই চিন্তিত হয়ে পড়ল। সকলে এসে ধরল মুসার ভাই হারুনকে সে ভুলে গেল টেন কম্যান্ডমেন্টস-এর নির্দেশ। সে একটি সোনার বাছুর তৈরি করে বলল, এই বাছুরটিকেই আল্লাহর প্রতীক বলে পূজা কর। তারপর একে বলি দিয়ে পূজা শেষ করব।

সকলে বাছুর পূজার আনন্দে মেতে উঠল। ইহুদিদের এই মূর্তিপূজা দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন আল্লাহ। তিনি মুসাকে বললেন, ওদের এই গর্হিত কাজের জন্য আমি সকলকে ধ্বংস করব। সৃষ্টি করব নতুন এক জাতি।

মুসা বুঝতে পারলেন আল্লাহ ইহুদিদের অন্যায় আচরণে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছেন। তিনি নতজানু হয়ে বসে বললেন, হে প্রভু, তুমি তোমার সন্তানদের এই অপরাধ মার্জনা কর।

মুসার কথায় শান্ত হলেন আল্লাহ। তিনি তাঁর উপদেশ-নির্দেশ লেখা আরো দুটি পাথর দিলেন। মুসা সেই পাথর দুটি নিয়ে পাহাড় থেকে নিচে নামতেই দেখতে পেলেন সোনার বাছুরে মূর্তিকে ঘিরে ইহুদিরা আনন্দ উৎসবে মেনে উঠেছে। ইহুদিদের এই অসংযমী ধর্মবিরুদ্ধ আচরণে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন মুসা।

তাই তিনি ক্রুদ্ধ স্বরে গর্জন করে উঠলেন, তোমরা এই নাচ ও পূজা উৎসব বন্ধ কর।

ইহুদিরা কোনদিন মুসার এই ক্রুদ্ধ মূর্তি দেখেনি। তারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। মুসা বললেন, তোমরা যারা আল্লাহর নির্দেশ মান্য করে আমার সঙ্গী হতে চাও তারা আমার ডানদিকে এসে দাঁড়াও। যারা আল্লাহর নির্দেশিত পথ অনুসরণ করতে না চাও তারা সকলে বাঁ দিকে যাও।

ইহুদিরা সকলেই মুসার ডান দিকে এসে দাঁড়াল। মুসা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, তোমরা যে অন্যায় করেছ তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।

মুসা বললেন, প্রত্যেক পরিবারের একজন তরবারি নিয়ে এগিয়ে এস।

সকলে তরবারি নিয়ে আসতেই মুসা বললেন, এই তরবারী দিয়ে তোমাদের যে কোন একজন ভাই, বন্ধু কিম্বা প্রিয়জনকে হত্যা কর। এ আমার নির্দেশ নয়, আল্লাহর আদেশ।

সকলেই নতমস্তকে সেই আদেশ মেনে নিল। মুসা আর ইহুদিদের সাথে একত্রে বাস করতেন না। তিনি আলাদা তাবুতে থাকতেন। দিনরাত আল্লাহর ধ্যানেই মগ্ন হয়ে থাকতেন। মাঝে শুধু আল্লাহর নির্দেশগুলো প্রচার করতেন। দশটি অনুশাসন ছাড়াও এগুলো ছিল স্বতন্ত্র নির্দেশ।

এক-–বিদেশীদের স্বজাতির মানুষদের মতই ভালবাসবে।

দুই-–কেনাবেচার সময় ব্যবসায়ীরা যেন ওজনের কারচুপি না করে সঠিক দাম নেয়।

তিন–অন্যের স্ত্রীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক করা চলবে না।

চার–মূর্তিপূজা, জাদুবিদ্যা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।

আল্লাহর নির্দেশে সকলে প্যালেস্তাইনের যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হল। তিন দিন চলবার পর তারা এসে পড়ল ক্যানান নগরের প্রান্তে। এখানেই শিবির স্থাপন করা হল।

মুসা ইহুদিদের মধ্যে থেকে বারো জন অভিজ্ঞ মানুষকে পাঠালেন প্যালেস্তাইনে। তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তর পরিদর্শন করে এসে জানাল প্যালেস্তাইনের দক্ষিণ দিকটাই সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল।

মুসা বললেন, আমরা প্যালেস্তাইনের দক্ষিণেই বসতি স্থাপন করব, তোমরা সকলে এগিয়ে চল ৷

প্যালেস্তাইনের সীমান্ত প্রদেশে তখন বাস করত আমালেকিত ও কানানিত নামে দুটি উপজাতি। এই দুই উপজাতি বহুদিন ধরেই প্যালেস্তাইনে বাস করছিল। দুই উপজাতির মানুষেরা এক সঙ্গে ইহুদিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আচমক এই আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না ইহুদিরা। তারা আত্মরক্ষার জন্য পালিয়ে গেল হর্মা নামে এক নির্জন প্রান্তরে।

মুসা বুঝতে পারলেন প্যালেস্তাইনে প্রবেশ করতে গেলে অন্য পথ দিয়ে প্রবেশ করতে হবে। তারা এসে পড়লেন ক্যানানিত রাজ্যের প্রান্তে। অপরিচিত ইহুদিদের দেখেই ক্যানানিতে রাজা তাদের আক্রমণ করলেন। এইবার আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল ইহুদিরা। মুসার বুদ্ধি-কৌশলে তারা পরাজিত হল।

অবশেষে তারা এসে পড়লেন জর্ডান নদীর তীরে। নদীর ওপারে মোয়ারের রাজ্য। সেই রাজ্য পার হলেই প্যালেস্তাইন। জর্ডানের তীরে এক উঁচু পাহাড়ের উপর উঠলেই দেখা যায় প্যালেস্তাইনের সবুজ প্রান্তর।

এদিকে মুসাও উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছিলেন প্যালেস্তাইনের মাটিতে পা দেবার জন্য। এমন সময় আল্লাহর দৈববাণী শুনতে পেলেন। হে আমার প্রিয় ভক্ত, তোমার পৃথিবী ছাড়বার সময় হয়েছে, তুমি প্রস্তুত হও।

পরদিনই সমস্ত ইহুদিদের ডেকে আল্লাহ আদেশের কথা বললেন। সকলের সামনে সমস্ত দায়িত্বভার ত্যাগ করে জোশুয়ার উপর অর্পণ করলেন।

সকলকে উপদেশ দিয়ে তিনি প্রার্থনায় বসলেন। বুঝতে পারলেন তাঁর সময় শেষ হয়েছে। দীর্ঘ ১২০ বছর ধরে পৃথিবীর কত কিছুই তো প্রত্যক্ষ করলেন। গত চল্লিশ বছর মেষপালক যেমন তার মেষের চালকে চালিয়ে নিয়ে বেড়ায়, তিনি তেমনি সমগ্র ইহুদি জাতিকে মিশর থেকে নিয়ে এসেছেন প্যালেস্তাইনের প্রান্তরে। জীবনে কোনদিন সুখভোগ করেননি। বিলাসিতা করেননি। ধর্মের পথে সৎ সরল জীবন যাপন করেছেন। প্রতিমুহূর্তে নিপীড়িত ইহুদি জাতির প্রতি নিজের অন্তরের অকুণ্ঠ ভালবাসা প্রকাশ করেছেন। তাদের নানান বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। এতদিনের তাঁর সব কাজ শেষ হল।

তথ্যসূত্রঃ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী – মাইকেল এইচ. হার্ট / সম্পাদনায় – রামশংকর দেবনাথ




আর্কাইভ