লেভ তলস্তয় (Leo Tolstoy)
প্রথম পাতা » জীবনী » লেভ তলস্তয় (Leo Tolstoy)লেভ তলস্তয়
(১৮২৮–১৯১০)
এ মহান রুশ মনীষী, বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক, মানবতাবাদী তলস্তয়ের জন্ম হয় ১৮২৮ সালের ২৮ আগস্ট (৯ সেপ্টেম্বর) রাশিয়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। বাবা-মা দুই দিক থেকেই তলস্তয় ছিলেন খাঁটি অভিজাত। তলস্তয়ের বাবা নিকোলাস ছিলেন বিশাল জমিদারির মালিক।
লিও তলস্তয় ছিলেন তাঁর পিতামাতার চতুর্থ পুত্র। তার জন্মের এক বছর পরেই তার মা মারা গেলেন। তার দেখাশুনার ভার ছিল এক ফুফুর উপর। পাঁচ বছর বয়সে বাড়িতেই শুরু হল তাঁর পড়াশুনা, একজন জার্মান শিক্ষক তাঁকে পড়াতেন।
যখন তাঁর আট বছর বয়স, ভাইদের সাথে তাকে পলিয়ানার গ্রাম্য পরিবেশ ছেড়ে যেতে হল মস্কোতে।
বেশিদিন তাঁকে মস্কোতে থাকতে হল না। এক বছর পর হঠাৎ নিকোলাস মারা গেলেন। তাদের অভিভাবিকা হলেন ফুফু। বড় দুই ভাই মস্কোতে রয়ে গেল, তলস্তয় ফিরে গেলেন ফুফুর কাছে পলিয়ানায়। বাড়িতে শিক্ষক ঠিক করা হল। তার কাছেই শিখতে আরম্ভ করলেন জার্মান আর রুশ ভাষা।
তিন বছর যেতে না যেতেই ফুফু মারা গেলেন, এবার নাবালকদের অভিভাবক হলেন আরেক ফুফু, তিনি থাকতেন কাজানে। ফুফু তলস্তয়কে নিয়ে গেলেন কাজানে।
এভাবে অলস আমোদ আহ্লাদে দিন কাটতে দেখে ভাই ঠিক করলেন তলস্তয়কে খাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির পরীক্ষায় প্রথমবার পাশ করতে পারলেন না। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন।
পড়াশুনার প্রতি কোনদিনই মনোযোগী ছিলেন না তলস্তয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে এতদিনের সব বাধা বন্ধন মুক্ত হয়ে গেলেন তলস্তয়। দিন-রাতের বেশির ভাগ সময়েই আচ্ছা আমোদ আর ফুর্তিতেই কেটে যেত।
পরিণতিতে পরীক্ষায় ফেল করলেন। দেখতে দেখতে ১৮ বছরে পা দিলেন তলস্তয়। ভাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে সৈন্যদলের অফিসার হিসাবে যোগ দিয়েছে। সাবালক হওয়ার জন্যে তলস্তয় পৈতৃক সম্পত্তির মালিকানা পেলেন। ইয়াসনা পলিয়ানার বিশাল জমিদারি, সেই সাথে প্রায় ৩৫০ জন ভূমিদাসের মালিক হলেন তিনি।
খাজানের উচ্ছখল অনিয়ম জীবন যাপনের ফলে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল।
হাসপাতাল থেকে ফিরে তিনি সোজা চলে এলেন নিজের জমিদারিতে। তলস্তয় ছিলেন রুশোর আদর্শে অনুপ্রাণিত, তিনি স্থির করলেন নিজের জমিদারির মধ্যে ভূমিদাসদের উন্নতি করবেন।
তারা তলস্তয়ের এই কাজকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে আরম্ভ করল। তাদের মনে হল এর পেছনে অবশ্যই কোন খারাপ উদ্দেশ্য আছে। তাদের এই আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন তলস্তয়। তিনি ঠিক করলেন কৃষকদের মধ্যে সময়ের অপচয় না করে পড়াশুনা আরম্ভ করবেন।
তিনি পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়বার জন্য ভর্তি হলেন। কিছুদিন যেতেই সেখানকার জীবন ক্রমশই ক্লান্তিকর হয়ে উঠল তাঁর কাছে। ফিরে এলেন নিজের জমিদারিতে। সেখানেও ভাল লাগল না। গেলেন মস্কোতে।
বড় ভাই নিকোলাস বড়দিনের ছুটি কাটাতে বাড়িতে এলেন। ছোট ভাইয়ের আচার-আচরণ দেখে স্থির করলেন তাকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করে দেবেন। ভাই এর প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেলেন তলস্তয়। সমস্ত জমিদারি দেখা শুনার ভার ভগ্নিপতির উপর দিয়ে ভাই এর সঙ্গে রওনা হলেন ককেসাসে।
তলস্তয় সেনাবাহিনীতে ভর্তি হলেন। এই সময়কার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পরবর্তীকালে তিনি দুটি বিখ্যাত গল্প লিখেছিলেন “ককেসারে বন্দী” ও “কসাক”।
প্রথম কিছুদিন যুদ্ধের উন্মাদনায় মেতে উঠলেও ক্রমশই তার মনের মধ্যে যুদ্ধের বিরুদ্ধে একটা ঘৃণা সৃষ্টি হতে আরম্ভ করল।
একদিকে সৈনিক জীবন, অন্যদিকে চলছিল সাহিত্য সাধনা। কয়েক মাস পরিশ্রম করবার পর শেষ করলেন তাঁর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের প্রথম পর্ব “শৈশব”। স্থানীয় একটি পত্রিকায় লেখাটি পাঠিয়ে দিলেন। দুই মাস পর পত্রিকার সম্পাদক নেক্রাসভের চিঠি এল। শৈশব পড়ে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন।
নেক্রাসভের এই প্রশংসায় উৎসাহিত হয়ে তলস্তয় শুরু করলেন উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব! “বাল্যকাল”। উপন্যাস রচনার সাথে সাথে তিনি লিখে চললেন ছোটগল্প, নকশা।
হঠাৎ ক্রিমিয়ায় যুদ্ধ শুরু হল। তলস্তয়কে যুদ্ধে যেতে হল। ১৮৫৪ সালে তিনি এলেন সেবাস্তপোলে। এখানে যুদ্ধ প্রবল আকার ধারণ করেছিল। যুদ্ধের বীভৎসতা দেখে তিনি এত বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন, এই যুদ্ধের পরই তিনি সামরিক বিভাগ থেকে ইস্তফা দিলেন। ফিরে এলেন পিটার্সবার্গে। সেবাস্তপোলের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি রচনা করলেন তিনটে গল্প।
ইতিমধ্যে তলস্তয়ের এক ভাই ক্ষয়রোগে মারা গিয়েছেন। জমিদারি দেখাশুনার জন্য পলিয়ানাতে ফিরে এলেন তলস্তয়। এর পর শুরু করলেন তাঁর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের তৃতীয় পর্ব “যৌবন”। তাঁর এই উপন্যাস শৈশব কৈশোর যৌবন (Childhood, Boyhood and Youth) তার জীবনের এক জীবন্ত চিত্র।
কিছুদিন জমিদারির কাজ দেখাশুনা করার পর তিনি দেশভ্রমণে বার হলেন। তখন ইউরোপের সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল ছিল প্যারিসে। তলস্তয় প্রথমে এলেন প্যারিসে। প্যরিস ছেড়ে গেলেন সুইজারল্যাণ্ডের রাজধানী জেনেভায়। কিছুদিন জেনেভায় থাকার পর ফিরে এলেন মস্কোতে।
তলস্তয়ের বড় ভাই নিকোলাস যক্ষ্মা রোগে মারা গেলেন। এই ভাইকে খুবই ভালবাসতেন তলস্তয়। তার মৃত্যুতে ভেঙে পড়লেন তলস্তয়।
মানসিক অবসাদ ভুলতে নিজের জমিদারি ইয়াসনা পলিয়ানায় ফিরে এলেন।
১৮৫৫ সালে রাশিয়ার জার প্রথম নিকোলাসের মৃত্যু হল। তার পর সিংহাসনে বসলেন দ্বিতীয় আলেকজাণ্ডার। দ্বিতীয় আলেকজাণ্ডার কিছু সংস্কারমূলক নীতি প্রবর্তন করলেন। তলস্তয় একে স্বাগত জানালেন। এতে অন্য সব জমিদাররা তার উপর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল এমনকি তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করা হল। এই সব ঘটনায় মানসিক অশান্তিতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন, ডাক্তার পরামর্শ দিলেন আবহাওয়া পরিবর্তন করতে।
তলস্তয় এলেন ককেসাসে। এখানে ছিলেন ডঃ বেহর্ম। পরিচয় হল তাঁর মেজ মেয়ে সোফিয়ার সাথে। দুজনেরই পরস্পরকে ভাল লেগে গেল। ১৮৬২ সালে তলস্তয় সোফিয়াকে বিয়ে করলেন, তখন তাঁর বয়স ৩৪, সোফিয়ার ১৮। স্ত্রীকে নিয়ে জমিদারিতে ফিরে এলেন তুলস্তয়। নতুন করে শুরু হল তাঁর সাহিত্য সাধনা।
ইতিমধ্যে তার যে সব রচনা শেষ করেছিলেন তার মধ্যে কসাক প্রকাশিত হল ১৮৬৩ সালে। সাথে সাথে অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করল। এই উপন্যাস প্রকাশের সাথে সাথে তলস্তয় রাশিয়ার একজন জনপ্রিয় লেখক হিসাবে খ্যাতি অর্জন করলেন। এই জনপ্রিয়তায় উৎসাহিত হয়ে তিনি শুরু করলেন তার ওয়ার এণ্ড পিস উপন্যাস (War and peace) সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই উপন্যাসটি ১৮০৫ সাল থেকে ১৮১৩ সাল অবধি রাশিয়ার সমাজ জীবনের বিশাল পটভূমিতে লেখা। এটি রচনা করতে তাঁর দীর্ঘ পাঁচ বছর সময় লেগেছিল। ১৮৬৫ সালে রুশ দূত পত্রিকায় এই উপন্যাসের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। ১৮৬৯ সালে এর শেষ খণ্ড ছাপা হয়।
এই উপন্যাসকে মহাকাব্যর সঙ্গে তুলনা করা যায়। সমগ্র মানব জীবন এখানে তার সব বৈচিত্র্য ব্যাপ্তি নিয়ে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। এর সাথে আছে মানব জীবনের বিশ্লেষণ, তার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিবরণ। ১৮০৫ থেকে ১৮১৩ সালের মধ্যে রুশ সমাজ ব্যবস্থা, সেই সাথে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের রাশিয়া আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি পরিবারের মধ্যে যে ভাঙাগড়ার খেলা চলেছে তারই কাহিনী ওয়ার এণ্ড পিস।
ইতিমধ্যে তিনি ছয়টি সন্তানের পিতা হয়েছেন। এছাড়া বাড়িতে আরো কয়েকটি ছোট ছেলেমেয়ে ছিল। এদের সঙ্গে মেলামেশা করতে করতে তিনি শিশু শিক্ষার দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন। গ্রামের শিশুদের জন্য কয়েকটি স্কুল খুললেন।
এই সময় একদিন তলস্তয় জানতে পারলেন একটি মেয়ে রেললাইনে আত্মহত্যা করেছে। এই ঘটনাটি তাঁর মনকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। তিনি এই ঘটনাটিকে অবলম্বন করে লিখলেন তাঁর বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস আন্না ক্যারেনিনা। এই উপন্যাসটি লিখতেও তাঁর বেশ কয়েক বছর সময় লেগেছিল। ১৮৭৭ সালে রুশ দূত পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়।
কিন্তু এই খ্যাতির মধ্যে তলস্তয়ের জীবনে নেমে আসে আঘাত আর বেদনা। পর পর তার কয়েকটি সন্তান মারা গেল। মারা গেলেন তার ফুফু। একের পর এক মৃত্যু ভুলতে তলস্তয় আশ্রয় নিলেন ধর্মের জগতে। খ্যাতি অর্থ যশ নাম সব কিছুই তার কাজে মূল্যহীন মনে হয়।
তলস্তয় গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন ধর্ম সংক্রান্ত কাজে-কর্মে। নিয়মিত গীর্জায় যেতেন। যাজকদের সাথে ধর্ম বিষয়ে আলোচনা করতেন। নিয়মিত বাইবেল পড়াতেন। যীশুর জীবনকে উপলব্ধি করাবার চেষ্টা করতেন।
খ্রিষ্টান ধর্মজগতের মানুষদের পাপ অনাচার দেখে ক্রমশই তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিলেন। সরাসরি চার্চ ও খ্রিস্টান ধর্মজগতের মানুষদের সমালোচনা করে বেশ কয়েকটি রচনা প্রকাশ করলেন। এতে সমস্ত ধর্মজগতের মানুষেরা তার উপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল।
স্ত্রীর অনুরোধে সপরিবারে মস্কোতে এসে বাসা বাঁধলেন তলস্তয়।
এরপর থেকে ক্রমশই এক চিন্তা তার মনের মধ্যে পাক খেতে থাকে, ধনসম্পদ সঞ্চয় করা যদি পাপ হয় তবে তিনি তো সেই পাপে পাপী। তিনি স্থির করলেন তার সমস্ত ধনসম্পদ বিলিয়ে দেবেন সাধারণ চাষীদের মধ্যে।
কিন্তু প্রবল বাধা এল সোফিয়ার কাছ থেকে। নিজের সন্তানদের কথা ভেবে এই উচ্চ আদর্শকে কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। শুরু হল বিবাদ-বিসংবাদ, পরবর্তী জীবনে এই বিবাদ ক্রমশই তীব্রতর হয়ে ওঠে।
সাংসারিক বিবাদ ক্রমশই চরমে ওঠে। তলস্তয় তার সব সম্পত্তি, বইয়ের স্বত্ব স্ত্রীকে উইল করে দিয়ে গ্রামে ফিরে এলেন। তিনি স্থির করলেন এতদিন যে আদর্শের কথা বলেছেন, সেই আদর্শকে নিজের জীবনে পালন করবেন।
এই সময় তলস্তয় মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়ে দিলেন। মদ স্পর্শ করতেন না, এমনকি ধূমপানও ছেড়ে দিলেন।
আবার নতুন করে সৃষ্টির কাজে হাত দিলেন তলস্তয়। এই পর্যায়ে তিনি লিখলেন তাঁর বিখ্যাত কিছু ছোট গল্প। মানুষ কি নিয়ে বাঁচে, দুজন বৃদ্ধ মানুষ যেখানে ভালবাসা সেখানেই ঈশ্বর, বোকার ইভানের গল্প, তিনজন সন্ন্যাসী, মানুষের কতটা জমি প্রয়োজন, ধর্মপুত্র–এই গল্পগুলোর মধ্যে একদিকে রয়েছে নৈতিক শিক্ষা অন্যদিকে সৎ সরল জীবন পথের নির্দেশ। এক অসাধারণ সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে প্রতিটি গল্পে। পাঠকের হৃদয়ের অন্তঃস্থলকে তা স্পর্শ করে। পরবর্তীকারে এই গল্পগুলো সংকলিত হয়ে প্রকাশিত হয় ২৩টি গল্প (১৯০৬)।
১৮৮৯ সালে প্রকাশিত হল তাঁর সবচেয়ে বিতর্কিত উপন্যাস ক্রয়োজার সোনেটা। তখন তলস্তয়ের বয়স ৬১ বছর। এতে লিখলেন এক বৃদ্ধ কি প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণায় ঈর্ষাপ্রণোদিত দ্বিচারিণী স্ত্রীকে হত্যা করেছিল। এই রচনা প্রকাশের সাথে সাথে চারিদিকে বিতর্কের ঝড় বয়ে গেল। নিন্দা বিদ্রূপ আর কটুক্তিতে ছেয়ে গেল চারদিক-সমালোচনা করা হল এক বিকৃত যৌনতা ফুটে উঠেছে এর মধ্যে। লেখক সমস্ত সমাজ সংসারক ধ্বংস করবার কাজে নেমেছেন। নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল এই বই। কিন্তু তার আগেই হাজার হাজার কপি ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সর্বত্র।
সোভিয়েত রাশিয়ায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। হাজার হাজার মানুষ অনাহারক্লিষ্ট দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাতে লাগল। দেশের সরকার এই ঘটনায় সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে রইলেন। কিন্তু তলস্তয় গভীরভাবে বিচলিত হয়ে পড়লেন। লণ্ডনের ডেলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি দেশের সরকার তার আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমালোচনা করে বললেন, দেশের দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী বর্তমান প্রশাসন, তাঁর এই সমালোচনার ফলে রুশ দেশের প্রকৃত ছবি পৃথিবীর সামনে প্রকাশিত হয়ে পড়ল।
ক্ষোভে ফেটে পড়ল জারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা। সকলে বুঝতে পারল রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে এই বার তলস্তয়কে বন্দী করা হবে।
কিন্তু জার গ্রেফতারের অনুমতি দিলেন না।
দুর্ভিক্ষের বিবাদ মিটতে না মিটতেই তলস্তয়ের জীবনে নেমে এল বিরাট এক আঘাত। তাঁর প্রিয় পুত্রের মৃত্যু হল। এই মৃত্যুতে সাময়িকভাবে ভেঙে পড়লেন তলস্তয়।
ইতিমধ্যে তার আরো কিছু রচনা প্রকাশিত হল। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসেও তাঁর সৃজনশক্তি এতটুকু হ্রাস পায়নি। এই সময় তিনি লিখতে আরম্ভ করলেন তাঁর একটি বড় গল্প.”হাজি মুরাদ” (Hadji Murad)। এই গল্পটি প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পর। এটি তার একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা।
হাজি মুরাদ রচনার সাথে সাথে তিনি তাঁর আর একটি বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস। “নবজন্ম” (Resurrection)।
রাশিয়ার জার তৃতীয় আলেকজান্ডার মারা গেলেন। নতুন জার হলেন তাঁর পুত্র দ্বিতীয় নিকোলাস। তৃতীয় আলেকজান্ডার ছিলেন অপেক্ষাকৃত উদারপন্থী। কিন্তু তাঁর পুত্র ছিলেন যেমন অত্যাচারী তেমনি নিষ্ঠুর। সমস্ত দেশ জুড়ে শুরু হল ধরপাকড় আর নির্যাতন। তলস্তয়ের বিরুদ্ধে কোন কিছু না করলেও তার অনুগামীদের কারাগারে পাঠানো হল। শুরু হল তাদের উপর নির্যাতন। সরকারের অনুগত ধর্মপ্রতিষ্ঠানের তরফে বলা হল কোন যাজক তার সকারে যেন অংশ না নেয়।
এদিকে দেশ জুড়ে লেলিনের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল বিপ্লবী আন্দোলন। ১৯০৮ সালে প্রকাশিত হল তাঁর আবেগময় প্রবন্ধ, “আমি নীরব থাকতে পারি না।” এতে তিনি বিপ্লবীদের উপর অত্যাচারের তীব্র ভাষায় নিন্দা করলেন সাথে সাথে এই রচনা নিষিদ্ধ করা হল।
আশি বছরে পা দিলেন তলস্তয়। সমস্ত দেশের মানুষের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন মানবতা আর রুশ সংস্কৃতির মূর্ত প্রতীক।
সমস্ত পৃথিবী তাঁকে সম্মান জানালেও সংসারে চরম অশান্তি। তলস্তয় তার সমস্ত রচানায় গ্রন্থস্বত্ব সমগ্র মানবজাতিকে দান করেছিলেন। তার স্ত্রী সোফিয়া এটি মেনে নিতে পারছিলেন না। তার অর্থের প্রতি লোভ ক্রমশই বেড়ে চলছিল। এক এক সময় বিবাদ তীব্র আকার ধারণ করত। ক্রমশই অসুস্থ হয়ে পড়লেন তলস্তয়। এই সময় তাকে সেবা-শুশ্রূষা করতেন তার ছোট মেয়ে আলেকজাণ্ডার। কিন্তু স্ত্রী নির্যাতন এমন অবস্থায় পৌঁছাল তিনি আর ঘরে থাকতে পারলেন না। বেরিয়ে পড়লেন অজানার উদ্দেশ্যে।
পথে আস্তাপগে নামে এক স্টেশনে এসে নেমে পড়লেন। তখন তার প্রচণ্ড জ্বর সেই সাথে কাশির সঙ্গে রক্ত উঠছে। স্টেশন সংলগ্ন একটি বাড়িতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ১৯১০-এর ৭ নভেম্বর।
তথ্যসূত্রঃ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী – মাইকেল এইচ. হার্ট / সম্পাদনায় – রামশংকর দেবনাথ