সক্রেটিস (Socrates)

প্রথম পাতা » জীবনী » সক্রেটিস (Socrates)


সক্রেটিস

সক্রেটিস

(৪৬৯-৩৯৯ খৃঃ পূ:)
দিন শেষ হয়ে গিয়েছিল। দুজন মানুষ তার চেয়েও দ্রুত এগিয়ে চলছিলেন। ঐ আঁধার নামার আগেই তাদের পৌঁছতে হবে ডেলফিতে। একজনের নাম চেরেফোন। (Chaerephon) মধ্যবয়সী গ্ৰীক। দুজনে এসে থামলেন ডেলফির বিরাট মন্দির প্রাঙ্গণে। সিঁড়ি বেয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই মন্দিরের পূজারী এগিয়ে এল। চেরেফোন তার দিকে চেয়ে বললেন, আমরা দেবতার কাছে একটি বিষয় জানবার জন্য এসেছি। পূজারী বলল, আপনারা প্রভু অ্যাপেলের মূর্তির সামনে গিয়ে নিজেদের পরিচয় দিন আর বলুন আপনারা কি জানতে চান? কুৎসিত চেহারার মানুষটি প্রথমে এগিয়ে এসে বললেন, আমি সক্রেটিস, প্রভু, আমি কিছুই জানি না। এবার চেরেফোন নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, হে সর্বশক্তিমান দেবতা, আপনি বলুন গ্রীসের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী কে?

চেরেফোনের কথা শেষ হতেই চারদিক কাঁপিয়ে আকাশ থেকে এক দৈববাণী ভেসে এল।

“যে নিজেকে জানে সেই।”

সক্রেটিসের জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৯/৪৬৩। পিতা সফরেনিকাশ (Sopphroniscus) ছিলেন স্থপতি। পাথরের নানান মূর্তি গড়তেন। মা ফেনআরেট (Phaenarete) ছিলেন ধাত্রী।

পিতা মাতা দুজনে দুই পেশায় নিযুক্ত থাকলেও সংসারে অভাব লেগেই থাকত। তাই ছেলেবেলায় পড়াশুনার পরিবর্তে পাথর কাটার কাজ নিতে হল। কিন্তু অদম্য জ্ঞানস্পৃহা সক্রেটিসের। যখন যেখানে যেটুকু জানার সুযোগ পান সেইটুকু জ্ঞান সঞ্চয় করেন। এমনি করেই বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। একদিন ঘটনাচক্রে পরিচয় হল এক ধনী ব্যক্তির সঙ্গে। তিন সক্রেটিসের ভুদ্র ও মধুর আচরণে, বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে তার পড়াশুনার দায়িত্ব নিলেন।

পাথরের কাজ ছেড়ে সেক্রেটিস ভর্তি হলে এনাক্সগোরাস (Anaxagoras) নামে এক গুরুর কাছে। কিছুদিন পর কোন কারণে এনাক্সগোরাস আদালতে অভিযুক্ত হলে সক্রেটিস আরখ এখলাস-এর শিষ্য হলেন।

এই সময় গ্রীস দেশ ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল। ফলে নিজেদের মধ্যে মারামারি, যুদ্ধবিগ্রহ, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত। দেশের প্রতিটি তরুণ, যুবক, সক্ষম পুরুষদের যুদ্ধে যেতে হত।

সক্রেটিসকেও এথন্সের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে এ্যামপিপোলিস অভিযানে যেতে হল। এই যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য সমস্ত যোগদান করে তাঁর মন ক্রমশই যুদ্ধের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠল।

চিরদিনের মত সৈনিকবৃত্তি পরিত্যাগ করে ফিরে এলেন এথেন্সে। এথেন্সে তখন জ্ঞান-গরিমা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শৌর্য, বীর্যে, পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশ। শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির এক স্বর্ণযুগ।

এই পরিবেশে নিজেকে জ্ঞানের জগৎ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলেন না সক্রেটিস। তিনি ঠিক করলেন জ্ঞানের চর্চায়, বিশ্ব প্রকৃতির জানবার সাধনায় নিজেকে উৎসর্গ করবেন।

প্রতিদিন ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে সামান্য প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়তেন। খালি পা, গায়ে একটা মোটা কাপড় জড়ানো থাকত। কোনদিন গিয়ে বসতেন নগরের কোন দোকানে, মন্দিরের চাতালে কিম্বা বন্ধুর বাড়িতে। নগরের যেখানেই লোকজনের ভিড় সেখানেই খুঁজে পাওয়া যেত সক্রেটিসকে। প্রাণ খুলে লোকজনের সঙ্গে গল্প করছেন। আড্ডা দিচ্ছেন, মাঝে মাঝে প্রশ্ন করছেন, নিজে এমন ভাব দেখাতেন যেন কিছুই জানেন না, বোঝেন না। লোকের কাছ থেকে জানবার জন্যে প্রশ্ন করছেন।

আসলে প্রশ্ন করা, তর্ক করা ছিল সে যুগের এক শ্রেণীর লোকদের ব্যবসা। এদের বলা হত সোফিস্ট। এরা পয়সা নিয়ে বড় বড় কথা বলত।

যারা নিজেদের পান্ডিত্যের অহঙ্কার করত, বীরত্বের বড়াই করত, তিনি সরাসরি জিজ্ঞেস করতেন, বীরত্ব বলতে তারা কি বোঝে? পান্ডিত্যের স্বরূপ কি। তারা যখন কোন কিছু উত্তর দিত, তিনি আবার প্রশ্ন করতেন। প্রশ্নের পর প্রশ্ন সাজিয়ে বুঝিয়ে দিতেন তাদের ধারণা কত ভ্রান্ত। মিথ্যে অহমিকায় কতখানি ভরপুর হয়ে আছে তারা। নিজেদের স্বরূপ এইভাবে উৎঘাটিত হয়ে পড়ায় সক্রেটিসের উপর তারা সকলে ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠল। কিন্তু সক্রেটিস তাতে সামান্যতম বিচলিত হতেন না। নিজের আদর্শ, সত্যের প্রতি তাঁর ছিল অবিচল আস্থা। সেই সাথে ছিল অর্থ সম্পদের প্রতি চরম উদাসীনতা।

একবার তাঁর বন্ধু এ্যালসিবিয়াদেশ তাকে বাসস্থান তৈরি করবার জন্য বিরাট একখন্ড জমি দিতে চাইলেন। সক্রেটিস বন্ধুর দান ফিরিয়ে দিয়ে সকৌতুকে বললেন, আমার প্রয়োজন একটি জুতার আর তুমি দিচ্ছ একটি বিরাট চামড়া এ নিয়ে আমি কি করব জানি না।

পার্থিব সম্পদের প্রতি নিঃস্পৃহতা তাঁর দার্শনিক জীবনে যতখানি শান্তি নিয়ে এসেছিল, তার সাংসারিক জীবনে ততখানি অশান্তি নিয়ে এসেছিল। কিন্তু তার প্রতিও তিনি ছিলেন সমান নিস্পৃহ।

তাঁর স্ত্রী জ্যানথিপি (Xanthiphe) ছিলেন ভয়ঙ্কর রাগী মহিলা। সাংসারিক ব্যাপারে সক্রেটিসের উদাসীনতা তিনি মেনে নিতে পারতেন না। একদিন সক্রেটিস গভীর একাগ্রতার সাথে একখানি বই পড়ছিলেন। প্রচন্ড বিরক্তিতে জ্যানথিপি গালিগালাজ শুরু করে দিলেন। কিছুক্ষণ সক্রেটিস স্ত্রীর বাক্যবাণে কর্ণপাত করলেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ধৈর্য রক্ষা করত না পেরে বাইরে গিয়ে আবার বইটি পড়তে আরম্ভ করলেন। জ্যানথিপি আর সহ্য করতে না পেরে এক বালতি পানি এনে তার মাথায় ঢেলে দিলেন। সক্রেটিস মৃদু হেসে বললেন, আমি আগেই জানতাম যখন এত মেঘগর্জন হচ্ছে তখন। শেষ পর্যন্ত একপশলা বৃষ্টি হবেই।

জ্যানথিপি ছাড়াও সক্রেটিসের আরো একজন স্ত্রী ছিলেন, তাঁর নাম মায়ার্ত (Myrto)।

দুই স্ত্রী গর্ভে তাঁর তিনটি সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল। দারিদ্র্যের মধ্যে হলেও তিনি তাদের ভরণ পোষণ শিক্ষার ব্যাপারে কোন উদাসীনতা দেখাননি। না। তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষাই মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। শিক্ষার মধ্যেই মানুষের অন্তরের জ্ঞানের পূর্ণ জ্যোতি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। জ্ঞানের মধ্যে দিয়েই মানুষ একমাত্র সত্যকে চিনতে পারে। যখন তার কাছে সত্যের স্বরূপ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, সে আর কোন পাপ করে না। অজ্ঞানতা থেকেই সমস্ত পাপের জন্য। তিনি চাইতেন মানুষের মনের সেই অজ্ঞানতাকে দূর করে তার মধ্যে বিচার বুদ্ধি বোধকে জাগ্রত করতে। যাতে তারা সঠিতভাবে নিজেদের কর্মকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে।

তাঁর লক্ষ্য ছিল আলোচনা জিজ্ঞাসা প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে সেই সত্যকে উপলব্ধি করতে মানুষকে সাহায্য করা।

কথা মধ্যে দিয়ে তর্ক বিচারের পদ্ধতিকে দার্শনিকরা আস্তি নাস্তিমূলক পদ্ধতি (Dialectic Method) নাম দিয়েছেন সক্রেটিস এই পদ্ধতির সূত্রপাত করেছিলেন। পরবর্তীকালের তাঁর শিষ্য প্লেটো, প্লেটোর শিষ্য এ্যারিস্টটল সেই ধারাকে পরিপূর্ণ রূপে বিকশিত করেছিলেন ন্যায় শাস্ত্রে।

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের শেষ ভাগ থেকে পঞ্চম শতাব্দীর শেষার্ধ পর্যন্ত গ্রীক সভ্যতার স্বর্ণযুগ। এই যুগেই সক্রেটিসের জন্ম। কিন্তু তাঁর যৌবনকালে থেকে এই সভ্যতার অবক্ষয় শুরু হল। পরস্পরের সঙ্গে দীর্ঘ যুদ্ধবিগ্রহের ফলে প্রত্যেকেরই প্রভাব-প্রতিপত্তি কমতে আরম্ভ করল। গ্রীসের সবচেয়ে সমৃদ্ধ রাষ্ট্র এথেন্সও তার প্রভাব থেকে বাদ পড়ল না। শুধু অর্থনীতি নয়, সমাজ রাজনীতিতেও নেমে এল বিপর্যয়। তর্কের মধ্যে দিয়ে আলোচনার পথ ধরে মানুষের মধ্যে চিন্তার উন্মেষ ঘটানো, সত্যের পথে মানুষকে চালিত করা। সক্রেটিসের আদর্শকে দেশের বেশ কিছু মানুষ সুনজরে দেখেনি। তারা সক্রেটিসের সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা করল। তাছাড়া যারা ঐশ্বর্য, বীরত্ব শিক্ষার অহঙ্কারে নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে মনে করত, সক্রেটিসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাদের এই অহঙ্কারের খোলসটা খসে পড়ত। এইভাবে নিজেদের স্বরূপ উৎঘাটিত হয়ে পড়ায় অভিজাত শ্রেণীর মানুষেরা সক্রেটিসের ঘোর বিরোধী হয়ে উঠল। তাঁদের চক্রান্তে দেশের নাগরিক আদালতে সক্রেটিসের ঘোর বিরোধী অভিযোগ আনা হল (৩৯৯ খ্রিস্টপূর্ব)।

তাঁর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ ছিল তিনি এথেন্সের প্রচলিত দেবতাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করে নতুন দেবতার প্রবর্তন করতে চাইছেন। দ্বিতীয়ত তিনি দেশের যুব সমাজকে ভ্রান্ত পথে চালিত করেছেন।

তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের আরো দুটি কারণ ছিল স্পার্টার সঙ্গে ২৭ বছরের যুদ্ধে এথেন্সের পরাজয়ের ফলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরাট আঘাত এল। অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিল। সেকালের ধর্শবিশ্বাসী মানুষের মনে করল নিশ্চয়ই দেবতাদের অভিশাপেই এই পরাজয় আর এর জন্য দায়ী সক্রেটিসের ঈশ্বরদ্বেষী শিক্ষা।

সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে এল মেলেতুল, লাইকন, আনীতুস নামে এথেন্সের তিনজন সম্ভ্রান্ত নাগরিক। এই অভিযোগের বিচার করবার জন্য আলোচোনের সভাপতিত্বে ৫০১ জনের বিচারকমন্ডলী গঠিত হল। এই বিচারকমন্ডলীর সামনে সক্রেটিস এক দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তাঁর বিরোধীপক্ষ কি বলেছিল তা জানা যায়নি। তবে সক্রেটিসের জবানবন্দী লিখে রেখে গিয়েছিলেন প্লেটো। এক আশ্চর্য সুন্দর বর্ণনায়, বক্তব্যের গভীরতায় এই রচনা বিশ্ব সাহিত্যের এক শ্রেষ্ঠ সম্পদ।

…হে এথেন্সের অধিবাসীগণ, আমার অভিযোগকারীদের বক্তৃতা শুনে আপনাদের কেমন লেগেছে জানি না, তবে আমি তাদের বক্তৃতার চমকে আত্মবিস্মৃত হয়েছিলাম, যদিও তাদের বক্তৃতায় সত্য ভাষণের চিহ্নমাত্র নেই। এর উত্তরে আমি আমার বক্তব্য পেশ করছি। আমি অভিযোগকারীদের মত মার্জিত ভাষার ব্যবহার জানি না। আমাকে শুধু ন্যায় বিচারের স্বার্থে সত্য প্রকাশ করতে দেওয়া হোক।

কেন আমি আমার দেশবাসীর বিরাগভাজন হলাম? অনেক দিন আগে ডেলফির মন্দিরে দৈববাণী শুনলাম তখনই আমার মনে হল এর অর্থ কি? আমি তো জ্ঞানী নই তবে দেবী কেন আমাকে দেবীর কাছে নিয়ে গিয়ে বলব, এই দেখ আমার চেয়ে জ্ঞানী মানুষ।

আমি জ্ঞানী মানুষ খুঁজতে আরম্ভ করলাম। ঠিক একই জিনিস লক্ষ্য করলাম। সেখান থেকে গেলাম কবিদের কাছে। তাদের সাথে কথা বলে বুঝলাম তারা প্রকৃতই অজ্ঞ। তারা ঈশ্বরদত্ত শক্তি ও প্রেরণা থেকেই সব কিছু সৃষ্টি করেন, জ্ঞান থেকে নয়।

শেষ পর্যন্ত গেলাম শিল্পী, কারিগরিদের কাছে। তারা এমন অনেক বিষয় জানেন যা আমি জানি না। কিন্তু তারাও কবিদের মত সব ব্যাপারেই নিজেদের চরম জ্ঞানী বলে মনে করত আর এই ভ্রান্তিই তাদের প্রকৃত জ্ঞানকে ঢেকে রেখেছিল।

এই অনুসন্ধানের জন্য আমার অনেক শত্রু সৃষ্টি হল। লোকে আমার নামে অপবাদ দিল, আমিই নাকি একমাত্র জ্ঞানী কিন্তু ততদিনে আমি দৈববাণীর অর্থ উপলব্ধি করতে পেরেছি। মানুষের জ্ঞান কত অকিঞ্চিতঙ্কর। দেবতা আমার নামটা দৃষ্টান্তস্বরূপ ব্যবহার করে বলতে চেয়েছিলেন তোমাদের মধ্যে সেই সর্বাপেক্ষা জ্ঞানী যে সক্রেটিসের মত জানে, যে সত্য সত্যই জানে তার জ্ঞানের কোন মূল্য নেই।

আমি নিশ্চিত যে আমি অনেকের অপ্রিয়তা এবং শত্রুতা অজর্ন করেছি এবং আমার চরম দণ্ড হলে এই শত্রুতার জন্যেই হবে, মেলেতুস বা আনিতুসের হন্য নয়। দণ্ড হলে তা হবে জনতার ঈর্ষা ও সন্দেহের জন্য যা আমার আগে অনেক সৎকারের নিধনের কারণ হয়েছে এবং সম্ভবত আরো অনেকের নিধনের কারণ হবে। আমিই যে তাদের শেষ বলি তা মনে করার কোন কারণ নেই…অতএব হে এথেন্সের নাগরিকগণ, আমি বলি তোমরা হয় আনিতুসের কথা শোন অথবা আগ্রাহ্য কর। হয় আমাকে মুক্তি দাও নয়তো দিও না, কিন্তু নিশ্চিন্ত থাকতে পার আমি আমার জীবনের ধারা বদলাব না।

…আমাকে ঈশ্বর এই রাষ্ট্র আক্রমণ করতে পাঠিয়েছেন। রাষ্ট্র হল একটি মহৎ সুন্দর ঘোড়া। তার বৃহৎ আয়তনের জন্য সে শ্লথগতি এবং তার গতি দ্রুততর করতে, তাকে জাগিয়ে তোলার জন্য মৌমাছির প্রয়োজন ছিল। আমি মনে করি যে আমি ঈশ্বর-প্রেরিত সেই মৌমাছি। আমি সর্বক্ষণ তোমাদের দেহে হুল ফুটিয়ে তোমাদের মধ্যে সুস্থ ভাবনা জাগিয়ে তুলি, যুক্তির দ্বারা উদ্বুদ্ধ করি এবং প্রত্যেককে তিরস্কারের দ্বারা তৎপর করে রাখি।…বন্ধুগণ সম্ভব অসম্ভবের কথা বাদ দিয়ে বলছি মুক্তিলাভের জন্য বা দণ্ড এড়াবার জন্য বিচারকদের অনুনয় করা অসঙ্গত। যুক্তি পেশ করে তাদের মনে প্রত্যয় জন্মানোই আমাদের কর্তব্য, বিচারকদের কর্তব্য হচ্ছে ন্যায় বিচার করা। বিচারের নামে বন্ধু তোষণ করা নয়।…আমি দেবতাকে বিশ্বাস করি, আমার অভিযোগকারীরা যতখানি বিশ্বাস করে তার চেয়েও অনেক বেশি বিশ্বাস করি। এতক্ষণ আমি ঈশ্বর এবং তোমাদের সামনে আমার বক্তব্য রাখলাম। এবার তোমাদের এবং আমার পক্ষে যা সর্বত্তম সেই বিচার হোক। কিন্তু বিচারে ২৮১–২২০ ভোটে সক্রেটিসকে দোষী সাব্যস্ত করা হল। সেই যুগে এথেন্সে কোন অভিযুক্তকে দোষী ঘোষণা করে হলে তাকে দুটি শাস্তির মধ্যে যে কোন একটিকে বেছে নেবার সুযোগ দেওয়া হত।

কিন্তু সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন তিনি নির্দোষ, তাই রায় ঘোষিত হবার পর তিনি উত্তর দিলেন, হে এথেন্সের অধিবাসীগণ, আমার পক্ষ থেকে কি পালটা দণ্ড প্রস্তাব করব? আমার যা ন্যায়ত প্রাপ্য তাই নয় কি? আমি তোমাদের প্রত্যেকের কাছে ব্যক্তিগতভাবে গিয়েছি, সে শুধু তোমাদের কল্যাণের জন্য। আমি আমার ব্যক্তিগতভাবে গিয়েছি, সে শুধু তোমাদের কল্যাণের জন্য। আমি আমার ব্যক্তিগত স্বার্থের কথা চিন্তা করার আগে চিন্তা করেছি এথেন্সের স্বার্থ। এইভাবে আমি তোমাদের উপকার করতে চেয়েছি। উপকারীকে সরকারী ব্যায়ে ভরণ-পোষণের ভার গ্রহণ করা হোক এই আমার শেষ ইচ্ছা। সক্রেটিসের এই বক্তব্যে জুরীরা আরো ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল। তাঁদের ধারণা ইল সক্রেটিস তাদের ব্যঙ্গ করছেন। আরো অনেকে তার বিরুদ্ধে চলে গেল এবং বিচারে তার মৃত্যুদণ্ড করা হল।

সেই ভয়ঙ্কর রায় শুনে এতটুকু বিচলিত হলেন না সক্রেটিস। স্থির শান্তভাবে বললেন, এখন সময় হয়েছে আমাদের সকলকে চলে যাবার, তবে আমি যাব মৃত্যুর দিকে, তোমরা যাবে জীবনের দিকে। জীবন কিম্বা মৃত্য–একমাত্র ঈশ্বরই বলতে পারেন। এর মাঝে শ্রেষ্ঠ কে? সক্রেটিসের বন্ধুদের মধ্যে ক্ৰিটো ছিলেন সবচেয়ে ধনী। তিনি কারারক্ষীদের ঘুষ দিয়ে সক্রেটিসকে অন্য দেশে পালিয়ে যেতে পরামর্শ দিলেন। কিন্তু সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন দেশের প্রত্যেক নাগরিকেরই দেশের আইন শৃংখলা মেনে চলা কর্তব্য। বিচারালয়ের আদেশ উপেক্ষা করে অন্য দেশে পালিয়ে যাওয়ার অর্থ আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। তাছাড়া এতে সকলের মনে এই ধারণা হবে যে সক্রেটিস সত্যি সত্যিই অপরাধী। তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে বিচারকরা ঠিক কাজই করেছেন।

মৃত্যুর দিন সকাল শিষ্যরা একে একে উপস্থিত হলেন কারাগারে।

তিনি গোসল করে ফিরে এলেন। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। মুহূর্তে মৃত্যুদূতের মত দ্বারে এসে দাঁড়াল জেলের কর্মচারী। গভীর বেদনায় কাঁদতে কাঁদতে ঘোষণা করল সক্রেটিসের বিষপানের সময় হয়েছে। ক্রিটো বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা রাজকর্মচারীর দিকে ইঙ্গিত করতেই জল্লাদ কক্ষে প্রবেশ করল, হাতে তার বিষের পাত্র। সক্রেটিস হাসিমুখে সেই পাত্র নিজের হাতে তুলে নিলেন। অকম্পিতভাবে শেষবারের মত ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন তারপরই সমস্ত বিষ পান করলেন।

তারপর জল্লাদের নির্দেশে ঘরে মধ্যে হাঁটতে আরম্ভ করলেন। ধীরে ধীরে বিষ তার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। পা দুটো ভারী হয়ে এল। চলৎশক্তিহীন হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। কাপড়ে মুখ ঢেকে দিলেন। কয়েক মুহূর্ত সব শান্ত। মৃত্যুর সব শান্ত। মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে সক্রেটিস যাত্রা করলেন অমৃতলোকে। তার মৃত্যুর পরেই এথেন্সের মানুষ ক্ষোভে দুঃখে ফেটে পড়ল। চারদিকে ধিক্কার ধ্বনি উঠল।

বিচারকদের দল সর্বত্র একঘরে হয়ে পড়ল। অনেকে অনুশোচনায় আত্মহত্যা করলেন। অভিযোগকারীদের মধ্যে মেনেতুসকে পিটিয়ে মারা হল, অন্যদেশ থেকে বিতাড়িত করা হল। দেশের লোকেরা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বিরাট মূর্তি প্রতিষ্ঠা করল। প্রকৃতপক্ষে সকেটিসই পৃথিবীর প্রথম দার্শনিক, চিন্তাবিদ যাকে তার চিন্তা দর্শনের জন্য মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। কিন্তু মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে তাঁর নশ্বর দেহের শেষ হলেও চিন্তার শেষ হয়নি। তাঁর শিষ্য প্লেটো, প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টটলের মধ্যে দিয়ে সেই চিন্তার এক নতুন জগৎ সৃষ্টি হল যা মানুষকে উত্তেজিত করেছে আজকের পৃথিবীতে।

তথ্যসূত্রঃ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী – মাইকেল এইচ. হার্ট / সম্পাদনায় – রামশংকর দেবনাথ




আর্কাইভ