ডেভিড লিভিংস্টোন (David Livingstone)

প্রথম পাতা » জীবনী » ডেভিড লিভিংস্টোন (David Livingstone)


ডেভিড লিভিংস্টোন

ডেভিড লিভিংস্টোন

(১৮১৩-১৮৭৩)
প্রায় দেড়শো বছর আগেকার কথা। তখন আফ্রিকা মহাদেশকে বলা হত অন্ধকার মহাদেশ। উত্তরে মিশরকে বাদ দিয়ে আফ্রিকার অবশিষ্ট সমস্ত অঞ্চল জুড়েই ছিল গভীর অরণ্য। মানুষেরা ছিল আদিম অসভ্য বর্বর। শিক্ষার কোন আলোই সেখানে পৌঁছায়নি। সভ্য মানুষেরা যেখানে যেত শিকারের লোভে আর দেশ জয়ের আকাঙ্ক্ষায়। ডেভিট লিভিংস্টোন প্রথম মানুষ যিনি অন্ধকারে মহাদেশে গেলেন, মনে অদম্য সাহস, উৎসাহ, ভালবাসা আর আত্ম-উৎসর্গের অনুপ্রেরণা। তিনিই প্রথম মানুষ যিনি পাশ্চাত্য সভ্যতার আলোকে তুলে ধরেছিলেন আফ্রিকার মানুষের কাছে।

ডেভিড লিভিংস্টোনের জন্ম ১৮১৩ সালের ১৯শে মার্চ গ্লাসগোর কাছে ব্লানটায়ারে। তাঁর পিতা নীল লিভিংস্টোন ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। খুচরো চায়ের কারবারের সাথে মিশনারীর কাজ করতেন। প্রায়শই ধর্মীয় কাজে এত বেশি জড়িত হয়ে পড়তে ব্যবসায়ের ক্ষতি হত। কখনো তার জন্যে সামান্যতম দুঃখিত হতেন না নীল লিভিংস্টোন। মনে করতেন তিনি যা কিছু করেন ঈশ্বরের অভিপ্রেত অনুসারেই করেন।

নিজের এই ঈশ্বর বিশ্বাস পুত্রের মধ্যে অনুপ্রাণিত করেছিলেন পিতা। তিনি চাইতেন লিভিংস্টোন যেন কোন বিজ্ঞানের বই না পড়ে। ধর্মীয় সাধনায় পরিপূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করে। লিভিংস্টোন সমস্ত জীবন ধরে ছিলেন ঈশ্বর বিশ্বাসী কিন্তু কোন ধর্মীয় গোঁড়ামি তার মধ্যে ছিল না। তিনি লিখেছিলেন কোন কোন ব্যাপারে আমি পিতার সঙ্গে কিছুতেই একমত হতে পারতাম না। তার ইচ্ছা অনুসারে কোনদিনই আমি ধর্মের শুকনো নিয়মের মধ্যে নিজেকে বাঁধতে পারিনি।

সংসারের অভাব-অনটনের জন্য দশ বছর বয়েসে ডেভিডকে সুতো কারখানায় কাজ নিতে হল। সেই শিশু বয়সেই তাকে প্রতিদিন চোদ্দ ঘণ্টা করে কাজ করতে হত। এত পরিশ্রম করেও তার মধ্যে ছিল পড়াশুনা করবার প্রবল আগ্রহ। কাজের ফাঁকে যেটুকু সময় পেতেন তখনই নানান বিষয়ের বই পড়তেন। কারখানার অন্য শ্রমিকরা ভাবত বয়সের তুলনায় পাকা ছেলে। অনেকেই তাকে ঠাট্টা করত। কিন্তু শিশুকাল থেকেই এমন গভীর আত্মবিশ্বাস ছিল যে সামান্যতম বিচলিত হতেন না লিভিংস্টোন।

বই পড়তে পড়তে মনের মধ্যে জেগে উঠত নানান কল্পনা। সবচেয়ে ভাল লাগত ভ্রমণ কাহিনী। তাঁর মন ভেসে চলত অজানা দেশে। ভাবতেন তিনিও যাবেন ঐ সমস্ত দেশে। একদিন এক জার্মান মিশনারীর লেখা একটি বই তার হাতে এল। বইখানি পড়তে পড়তে মিশনারী জীবনের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন। কিন্তু পিতার ধর্মীয় উন্মাদনাকে কোনদিনই শ্রদ্ধার চোখে দেখতে পারেননি লিভিংস্টোন। তাঁর মনের মধ্যে জেগে ওঠে এক গভীর সংশয় আর দ্বন্দ্ব। টমাস ডিকের লেখা একটি বই পড়ে তার মনের মধ্যে এক নতুন চেতনার উন্মেষ হল। “ধর্ম এবং বিজ্ঞান কেউ পরস্পরের বিরোধী নয়। উভয়েই উভয়ের পরিপূরক। বিজ্ঞান চেতনা নিয়ে যদি ধর্মের সাধনা করা যায় তবে সেখানে কোন গোঁড়ামি, ধর্মীয় উন্মাদনা প্রবল হয়ে উঠতে পারে না।” তখনই তিনি মিশনারী জীবনকে গ্রহণ করবার জন্য মনস্থির করলেন।

কৈশোর অতিক্রম করে তারুণ্যে পা দিয়েছেন লিভিংস্টোন। ইতিমধ্যে সামান্য কিছু সঞ্চয়ও হয়েছিল। তাঁর এক ভাইও অর্থ উপার্জন করছিল। বাবা ও ভাইয়ের উৎসাহে তেইশ বছর বয়েসে তিনি গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। এখানে তাঁর পাঠ্য বিষয় ছিল গ্রীক ভাষা সাহিত্য, চিকিৎসাশাস্ত্র এবং ধর্মশাস্ত্র। এক বছর পর তিনি লন্ডন মিশনারী সোসাইটিতে শিক্ষানবিসি শুরু করলেন। কিন্তু ধর্মপ্রচারক হিসাবে তার ব্যর্থতা অল্পদিনেই প্রকট হয়ে উঠল। তাছাড়া এই কাজের মধ্যে তিনি তার মানসিক আনন্দও খুঁজে পাচ্ছিলেন না। মিশনারী সোসাইটির শিক্ষানবিসি ছেড়ে চিকিৎসাবিদ্যা সংক্রান্ত কাজে ভর্তি হলেন। লন্ডনের বিভিন্ন হাসপাতালে দীর্ঘ কাজে ভর্তি হলেন। লন্ডনের বিভিন্ন হাসপাতালে দীর্ঘ দু’বছর শিক্ষানবিসি করে ডাক্তারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন।

লিভিংস্টোনের ইচ্ছা ছিল দূর কোন দেশে গিয়ে চিকিৎসাকে সেবার হিসাবে গ্রহণ করবেন। প্রথমে স্থির করলেন চীন দেশে যাবেন। কিন্তু সেখানে তখন শুরু হয়েছে আফিমের যুদ্ধ। তাই চীন যাত্রার পরিকল্পনা বাতিল করতে হল। এই সময় আফ্রিকায় একজন চিকিৎসক পাঠাবার প্রয়োজন হয়েছিল। লিভিংস্টোন আবেদন জানালেন, তাঁর আবেদন মঞ্জুর করা হল। অবশেষে ১৮৪০ সালের শেষ দিকে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় সমুদ্রপথে যাত্রা করলেন।

দীর্ঘ সমুদ্রপথ। জাহাজের কাপ্তেনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। কাপ্তেনের কাছে নানান বিষয়ে শিক্ষালাভ করলেন লিভিংস্টোন। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র দেখে দিক নির্ণয় করা। এই শিক্ষা পরবর্তী জীবনে লিভিংস্টোনকে নানাভাবে সাহায্য করেছিল। অবশেষে লিভিংস্টোন দক্ষিণ আফ্রিকার আলগোয়ায় এসে অবতরণ করলেন। এই বার শুরু হল স্থলপথে যাত্রা। আলগোয়া থেকে মিশনারী সংস্থার প্রধান কার্যালয় কুরু মান প্রায় ৭০০ মাইল দূর। এই সুদীর্ঘ পথ কখনো পায়ে হেঁটে কখনো বলদের পিঠে চেপে রওনা হলেন। দুর্গম বন্ধুর পথ। কিন্তু কোন কছুিতেই বিচলিত হলেন না লিভিংস্টোন। এই সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এক সময় কুরুমানে গিয়ে পৌঁছলেন। এখানে থেকেই শুরু হল তার কর্মজীবন।

লিভিংস্টোন সঙ্গী-সাথী, প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন দূরতম অঞ্চলে। সেইখানে তখনো সভ্যতার আলো গিয়ে পৌঁছায়নি। চিকিত্সার সাথে সাথে চলত ধর্মের শিক্ষা। এক এক বারে কয়েক মাস ধরে চলত তাঁর পরিক্রমা, তারপর ফিরে আসতেন কুরুমানে। এই সমস্ত পরিক্রমায় তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করত চারদিকের প্রাকৃতিক পরিমন্ডল, গাছপালা, ভূ-প্রকৃতি এবং সবকিছু নিখুঁতভাবে ডাইরির পাতায় লিখে রাখতেন।

তিন বছর আফ্রিকায় রয়ে গেলেন লিভিংস্টোন। কুরুমান মিশনারী সংস্থার প্রধান ছিলেন ডঃ রবার্ট। তার একমাত্র মেয়ে মেরি। নির্জন নির্বান্ধব জগতে মেরিকে দেখে ভাল লেগে গিয়েছিল লিভিংস্টোনের। ১৮৪৪ সালে দুজনে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হলেন। লিভিংস্টোন স্ত্রীর সম্বন্ধে লিখেছেন, “সে সুন্দরী নয়, মাথায় খাটো, ভাল স্বাস্থ্য, একমাথা কোঁকড়ানো চুল। মোটের উপর একটা মেয়ে, এটাই আমার বড় পাওয়া।”

লিভিংস্টোন স্ত্রীকে নিয়ে কুরুমান থেকে ২০০ কি. মি. দূরে মাবেস্তা নামে এক জায়গায় বাসা বাঁধলেন। অল্পদিনের মধ্যেই নিজের চেষ্টায় এখানে একটা বাড়ি তৈরি করলেন লিভিংস্টোন। আফ্রিকার আদিম প্রকৃতির মধ্যে সুখেই দিন কাটছিল নব দম্পতির। ক্রমশই পারিপার্শ্বি অবস্থা, স্বামীর কঠোর অনাড়ম্বর সরল জীবনের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে মানিয়ে নেন মেরি। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন লিভিংস্টোনের আদর্শ সঙ্গিনী। প্রায়ই স্ত্রীকে রেখে ছোট ছোট অভিযানে বার হতেন লিভিংস্টোন। বিপদসঙ্কুল দুর্গম পথ। একদিন বাড়িতে ফিরছেন, এমন সময় আচমকা জঙ্গলের মধ্যে থেকে একটা সিংহ বেরিয়ে এল তার সামনে। সঙ্গী-সাথীরা বেশ কিছুটা দূরে। তাড়াতাড়ি হাতের বন্দুক তুলে নিলেন লিভিংস্টোন। গুলি করতেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেন। গুলিটা সিংহকে সামান্য আহত করে বেরিয়ে গেল। মুহূর্তে আহত সিংহ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ক্ষিপ্ততার সঙ্গে দেহটাকে সরিয়ে নিলেন লিভিংস্টোন। কিন্তু সিংহের একটা থাবা এসে পড়ল তার বা হাতে। ততক্ষণে লিভিংস্টোনের সঙ্গীরা ছুটে এসেছে। সিংহ ভয়েতে পালিয়ে গেল। কিন্তু হাতের খানিকটা মাংস তুলে নিয়ে গেল। আহত রক্তাক্ত লিভিংস্টোনকে সকলে বাড়িতে নিয়ে এল। কয়েক মাসের সেবা-যত্নে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন লিভিংস্টোন। কিন্তু আগের মত বাঁ হাতের শক্তি আর ফিরে পেলেন না।

কাজের তাগিদে মাবেস্তা ত্যাগ করতে হল লিভিংস্টোনকে। এইবার এগিয়ে গেলেন আরো পশ্চিমে। নতুন বাসা বাঁধলেন কোবেঙ্গ নদীর তীরে। অল্পদিনেই স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে পরিচয় গড়ে উঠল লিভিংস্টোনের। তাদের একমাত্র জীবিকা ছিল চাষবাস। লিভিংস্টোন তাদের শেখালেন চাষের নতুন পদ্ধতি। জমিতে কিভাবে জল সেচ করতে হয় তার বিভিন্ন উপায়। কিছুদিনের মধ্যেই নতুন প্রবর্তিত কৃষি ব্যবস্থার সুফল পাওয়া গেল। কিন্তু এক জায়গায় দীর্ঘদিন বসবাস করবার কোন ইচ্ছাই ছিল না লিভিংস্টোনের। মাঝে মাঝেই তিনি অজানা দেশে পাড়ি দেবার স্বপ্ন দেখতেন। স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে প্রশ্ন করে বুঝতে পারলেন উত্তরের দেশগুলো এখাননা অজানা রয়ে গিয়েছে। মিশনারী হিসাবে সেই সমস্ত অনাবিষ্কৃত অঞ্চল খুঁজে বার করে সেখানকার মানুষের কাছে সভ্যতার বাণীকে তুলে ধরতে হবে। কিছু লোক নাগামি নামে একটি হ্রদের সন্ধান করেছিল। ১৮৪৯ সালে লিভিংস্টোন দুজন ইংরেজ অভিযাত্রীকে সাথে নিয়ে অনুসন্ধানে বার হলেন। কয়েকদিন পথ চলার পর তাঁরা এসে পড়লেন কালাহারি মরুভূমির প্রান্তরে। ইতিপূর্বে কোন ইউরোপবাসীই সেই দুস্তর মরুভূমি পার হয়নি। অকুতোভয় লিভিংস্টোন তাঁর সাথীদের নিয়ে এগিয়ে চললেন। তারা উত্তর-পশ্চিম দিক লক্ষ্য করে চলতে চলতে মরুভূমি পার হয়ে একটা নদীর প্রান্তে এসে পৌঁছলেন। সেখানে কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে আবার এগিয়ে চললেন। এবার জনমানবহীন শুষ্ক প্রান্তর। কোথাও জল নেই, চলার জন্য গরুর গাড়ি নেই। অমানুষিক পরিশ্রমে অবশেষে লিভিংস্টোনের প্রথম উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার। এরপর থেকে লিভিংস্টোন আফ্রিকার অজানা অঞ্চলের সন্ধানেই জীবন উৎসর্গ করেন। পরের বছর লিভিংস্টোন আবার বার হলেন। এইবার তার সঙ্গী হল স্ত্রী মেরি ও ছেলেমেয়েরা। কিন্তু মাঝপথেই অভিযান পরিত্যাগ করতে হল লিভিংস্টোনকে। পথে এক ধরনের বিষাক্ত মাছির কামড়ে ছেলেমেয়েরা অসুস্থ হয়ে পড়ল।সাথে তেমন কোন ঔষধ নেই, তার উপর অস্বাস্থ্যকর আবহাওয়া, পথের কষ্ট। গৃহে ফিরে আসতে বাধ্য হলেন। লিভিংস্টোন বুঝতে পারছিলেন আফ্রিকার আদিম অরণ্যময় পরিবেশে থাকলে স্ত্রী ছেলেমেয়েরা আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাছাড়া ছেলেমেয়েরা শিক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা করলেন। কেপটাউন থেকে তাদের জাহাজে তুলে দেওয়া হল।

কেপটাউনে থাকাকালীন সময়ে লিভিংস্টোনের সাথে পরিচয় হল জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্যার টমাস ম্যাকলার-এর সাথে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি বরাবরই আগ্রহ ছিল লিভিংস্টোনের। ম্যাকলারের কাছে আরা গভীরভাবে জ্যোতির্বিজ্ঞানের নানান বিষয় শিক্ষালাভ করলেন। এই শিক্ষা থেকে তিনি জীবনে নানাভাবে উপকৃত হয়েছিলেন।

ফিরে এরেন কোবেঙ্গে তাঁর গৃহে। কিন্তু সেখানে তার জন্যে অপেক্ষা করছিল এক সর্বনাশা দৃশ্য। বুয়র সম্প্রদায়ের লোকেরা এসে কোবেঙ্গের সমস্ত গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিয়েছে। অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছে। লিভিংস্টোনের বাড়িতে যে সমস্ত ঔষধ ছিল, সব মাটিতে ফেলে দিয়ে মূল্যবান বইপত্র ছিঁড়ে নষ্ট করেছে।

এই বিপর্যয়ে মনোবল হারালেন না লিভিংস্টোন। স্থানীয় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সাধ্যমত তাদের সাহায্য করতে থাকেন। কয়েক মাসের চেষ্টায় নতুন করে গড়ে উঠল গ্রাম।

১৮৫২ সালে আবার অভিযানে বার হলেন। তার ইচ্ছা জাম্বেসির উত্তর একটা নতুন। মিশন স্থাপন করেন। আগেরবার পুত্রকন্যাদের অসুস্থতার জন্য এই অভিযান পরিত্যাক্ত হয়। দ্বিতীয়বার দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে জাম্বেসির উত্তরে গিয়ে পৌঁছলেন, চারদিকে অস্বাস্থ্যকর আবহাওয়া। একধরনের বিষাক্ত মাছির ভয়াবহ উপদ্রব। মানুষের বসতি নেই বললেই চলে। লিভিংস্টোন বুঝতে পারলেন এখানে মিশন স্থাপন করা সম্ভব নয়। কিছুটা হতাশ মনেই ফিরে এলেন লিভিংস্টোন।

মনের সাময়িক দুর্বলতাকে কাটিয়ে অল্পদিনের মধ্যেই নতুন অভিযানের পরিকল্পনা শুরু করলেন। এবার লক্ষ্য পশ্চিমের সমুদ্র উপকূলে পৌঁছবার সহজতম পথ খুঁজে বার করা। তাঁর সঙ্গী হল সাতাশ জন আদিবাসী। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করে ১৮৫৩ সালের ১১ই নভেম্বর লিভিংস্টোন যাত্রা করলেন। আদিবাসী সর্দার প্রধান পথপ্রদর্শক। চলতে চলতে তারা এসে পড়লেন এক অসভ্য বর্বর প্রকৃতির আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায়। এরা তুচ্ছ কারণে মানুষ খুন করে। লিভিংস্টোন ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের দেখে আদিবাসীরা চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলল। কিন্তু লিভিংস্টোনের দলভুক্ত আদিবাসী সর্দারের উপস্থিত বুদ্ধি অসীম সাহস ও ধৈর্যবলে বর্বর উপজাতিদের হাত থেকে বহুকষ্টে রক্ষা পেলেন লিভিংস্টোন। কিন্তু অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন লিভিংস্টোন। কিন্তু তাঁর চলার গতি কখনো রুদ্ধ হত না। কখনো গভরি অরণ্য, কখনো বন্ধুর পাথুরে পথ, জনমানবহীন বালুকাময় মরুভূমি পার হয়ে এগিয়ে চললেন। মাঝে মাঝে শরীর এত অসুস্থ হয়ে পড়ত আর পথ চলতে পারতেন না। কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে আবার নতুন উদ্যমে এগিয়ে চলতেন। এত দীর্ঘ পথশ্রম, অনিশ্চিত গন্তব্যস্থল লিভিংস্টোনের আদিবাসী অনুচররা ক্রমশই অধৈর্য হয়ে ওঠে। অনেকে আর অগ্রসর হতে অস্বীকার করে। অসীম মানসিক দৃঢ়তায় অসুস্থ দেহেই পিস্তল হাতে এগিয়ে যান। সরাসরি সেই সব বিদ্রোহীদের সামনের দাঁড়িয়ে গর্জন করে ওঠেন, যারা আমার আদেশ অমান্য করবে তারা লড়াইয়ের জন্য তৈরি হও। আমি কোন কারণেই দলের প্রধান। আমার হুকুম মেনে চলাই তোমাদের কাজ।

এইভাবে নানান প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে পশ্চিম মুখে এগিয়ে চললেন। তারা এসে পড়লেন আঙ্গোলায়। সেখানে পর্তুগীজ সেনাবাহিনীর কাছ থেকে পথনির্দেশ পেয়ে অবশেষে এসে পৌঁছলেন সমুদ্রতীরের সাও পাওলা দ্য লুয়ান্ডায়। তারিখটা ছিল মে ৩১, ১৮৫৪ সাল। লিভিংস্টোনের স্বপ্ন সফল হল। সেখান থেকে ইংলন্ডে ফিরে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেলেন লিভিংস্টোন। তাঁর অভিযান তখনো শেষ হয়নি। তাছাড়া তার দলের সদস্যদের দেশে পৌঁছে দিতে হবে। নেতা হিসাবে সে দায়িত্ব তাঁর।

সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে পুনরায় রওনা হলেন। যে পথে তারা এসেছিলেন সেই পথ ধরে ফিরে চললেন। পথিমধ্যে প্রচণ্ড কলেরায় আক্রান্ত হলেন লিভিংস্টোন। জীবনের আশা প্রায় ছিল না, কিন্তু তবুও রক্ষা পেলেন এবার আর পায়ে হাঁটা নয়, পুরো পথটাই, বলদের পিঠে চেপে চলা। অবশেষে তিনি সদলবলে এসে পৌঁছলেন লিয়ান্টিতে। স্থানীয় মানুষ তাকে বীরের মত অভ্যর্থনা জানাল। তার সম্মানে উৎসবের আয়োজন করা হল।

অজানা পথের ডাকে বেশি দিন ঘরে থাকতে পারলেন না লিভিংস্টোন। কিছু দিন পর আবার পথে বার হলেন। এইবার আবিষ্কার করলেন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জলপ্রোপাত ভিক্টোরিয়া। তখন স্থানীয় নাম ছিল মোসিয়াটুনিয়া (শব্দময় বাধা)। একদিকে যেমন তার প্রচণ্ড গর্জন অন্যদিকে অনেক উঁচু থেকে পড়বার জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলবিন্দুতে ধোয়ার সৃষ্টি হত। এই সময় তাঁকে অমানুষিক কষ্ট ভোগ করতে হয়েছিল। পথ ভুলে তিনি গিয়ে পড়েছিলেন মানুষখেকো উপজাতিদের মধ্যে। প্রাণ বাঁচাতে দিনের বেলায় জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতেন। গাছের শেকড়, বুনো ফল আর মধু খেয়ে দিন কাটাতেন। একবার ভুলক্রমে এক জলার মধ্যে গিয়ে পড়লেন। গভীর পাঁকের অতলে হয়ত চিরদিনের মত হারিয়ে যেতেন, ভাগ্নক্রমে তার একজন সঙ্গী দেখতে পেয়ে তাকে উদ্ধার করে।

নতুন অঞ্চল আবিষ্কারে নেশায় ঘর-বাড়ি ছাড়লেও স্ত্রী পুত্রদের কথা ভোলেননি লিভিংস্টোন। দীর্ঘ পাঁচ বছর তাদের সাথে সাক্ষাৎ হয়নি তাঁর। তাছাড়া কিছুদিন ধরেই অন্তরে অনুভব করছিলেন স্বদেশের টান। লন্ডনের পথে রওনা হলেন লিভিংস্টোন। ইংলন্ডে পৌঁছতেই তিনি পেলেন বীরের সম্মান। সমস্ত দেশ অজানা আফ্রিকাকে আবিষ্কারের জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানায়। রয়াল জিওগ্রাফিক সোসাইটি তাঁকে ভৈক্টোরিয়া পদক প্রদান করল। অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানিক ডিগ্রি প্রদান করল। এত সন্নানে ভূষিত হয়েও তিনি সামান্যতম অহঙ্কার অনুভব করেননি। তাঁর দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিলেন। এরই ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে গড়ে উঠল অভিনেত্রী মিশন। লিভিংস্টোনকে এই মিশনের প্রদান নিযুক্ত করা হল। ঠিক হল এই মিশন পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকায় অভিযান চালাবে। লিভিংস্টোন লন্ডন মিশনারী সোসাইটি থেকে পদত্যাগ করে অভিযাত্রী মিশনের ভার গ্রহণ করলেন।

মিশনারী সোসাইটি থেকে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তিনি তাঁর জবাবে বললেন, “আমি নিজেকে কখনো ঈশ্বরের দাস ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা করিনি। তাঁরই অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণে আমি চালিত হয়েছি। মিশনারী হিসাবে আমি যে দায়িত্ব পালন করেছি তা বাইবেল হাতে ধর্মান্ধ প্রচারকদের থেকে কিছুমাত্র আলাদা নয়। তবে আমি শুধু ধর্মের প্রচারের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখিনি। তারই সাথে সাথে মানুষের চিকিৎসা করেছি, রাজমিস্ত্রির কাজ করেছি, ছুতোরের কাজ করেছি। আমি মনে করি যখন আমি আমার সঙ্গীদের খাবার জন্য শিকার করি, যখন আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করি, মানুষের জন্য কোন কাজ করি, সবই প্রভু যীশুর সেবা।”

তিনি ফিরে এলেন আফ্রিকায়। শুরু হল নতুন করে জাম্বেসি অভিযান। এইবার লিভিংস্টোনের সঙ্গী হলেন তাঁর ভাই জন। কিন্তু নানান অসুবিধার জন্য মাঝপথেই এই। অভিযান পরিত্যাক্ত হল। অকস্মাৎ লিভিংস্টোনে জীবনে নেমে এল এক বিচ্ছেদ বেদনা। তাঁর প্রিয়তমা পত্নীর মৃত্যু হল। লিভিংস্টোন লিখেছেন, “যখন তিনি তাকে বিয়ে করেছিলাম তখন থেকেই তাকে ভালবাসি, যতদিন বাঁচব তাকে ভালবেসে যাব।”

স্ত্রীর এই বিচ্ছেদ বেদনায় সাময়িক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন লিভিংস্টোন। সময়ের ব্যবধানে মনের শোক প্রশমিত হতেই নতুন অভিযানে বার হলেন। এইবার আবিষ্কার করলেন নিয়ামাহ্রদ। তার দশ দিনের মধ্যে উপস্থিত হলেন বাঙ্গোয়েল হদের তীরে। এই হ্রদটিও অজানা ছিল ইউরোপীয়ানদের কাছে। নিয়ামা হ্রদের তীরে এসে সমুদ্রে ভাসার মত ছোট একটি ডিঙি তৈরি করলেন। এই ডিঙি বেয়েই আফ্রিকার সমুদ্র উপকূল থেকে ২৫০০ মাইল উত্তাল সমুদ্র পার হয়ে লিভিংস্টোন এসে পৌঁছলেন ভারতবর্ষের বোম্বে শহরে। ভারতবর্ষ তখন ইংরেজ উপনিবেশ। ভারত ভ্রমণের ইচ্ছা ছিল লিভিংস্টোনের। কিন্তু তখন লন্ডন অভিমুখী একখানি জাহাজ যাত্রার জন্যে অপেক্ষা করছিল। লিভিংস্টোন আর অপেক্ষা করলেন না। সেই জাহাজের আরোহী হলেন। ১লা জুলাই ১৮৬৪ সালে তিনি ইংলন্ডের মাটিতে পা রাখলেন! ইংলন্ডে থাকাকালীন সময়ে তিনি তাঁর জাম্বেসি অভিযানের কাহিনী নিয়ে একখানি বই লিখলেন। এই বই প্রকাশের ব্যবস্থা করে তিনি আবার ফিরে চললেন আফ্রিকায়। ইংলন্ড তার জন্মভূমি হলেও আফ্রিকা ছিল তার কর্মভূমি। ইংলন্ডের সুখ বিলাসের মধ্যে থেকে প্রতিমুহূর্তে তিনি অন্তরে অনুভব করতেন আফ্রিকার আদিম অরণ্যের আহ্বান। এইবার আফ্রিকা যাত্রার সময় তাঁর উদ্দেশ্য ছিল নীল নদের উৎস আবিষ্কার করবেন। আফ্রিকায় থাকার সময় তিনি দেখেছিলেন নিগ্রোদের নিয়ে ইউরোপীয়ানদের দাস ব্যবসা শুরু হয়েছে। এই ঘৃণিত ব্যবসা দেখে মনে মনে ব্যথিত হতে লিভিংস্টোন। মনে হয়েছিল মানবিতার বিরুদ্ধে এই ঘৃণিত অপরাধকে যেমন করেই হোক তাকে বন্ধ করতেই হবে। আফ্রিকায় ফিরে কিছু সাথী, একদল সিপাই নিয়ে যাত্রা করলেন। দলের অধিকাংশই ছির অভিযানের পক্ষে অযোগ্য। কিছু লোক মাঝপথে দল ত্যাগ করল। তারা ফিরে গিয়ে চারদিকে প্রচার করে দিল লিভিংস্টোনকে হত্যা করা হয়েছে। সাথে সাথে অনুসন্ধানী দল পাঠানো হল। অনেক অনুসন্ধানের পর এই সংবাদ মিথ্যা প্রমাণিত হল।

এইবার লিভিংস্টোন উত্তরের পথে চলতে চলতে গিয়ে পৌঁছলেন ট্যাঙ্গানিকা হ্রদের তীরে। বিশাল হ্রদ। কয়েক হাজার মাইল জুড়ে তার বিস্তৃত জলরাশি। এখানে গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন লিভিংস্টোন। কিন্তু নিজের দেহের প্রতি সামান্যতম ভ্রূক্ষেপ নেই লিভিংস্টোনে। ধীর পদক্ষেপে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছেন। কখনো ভিজে পোশাক গায়েই শুকিয়ে যাচ্ছে। ঠিক সময়ে খাওয়া হয় না। ক্রমশই শরীরের এমন অবস্থা হল, চলবার শক্তি প্রায় হারিয়ে ফেললেন। একদল আরব সেই পথে যাচ্ছিল। তাদের চিকিৎসা ও সেবাযত্নে পুনরায় সুস্থ হয়ে উঠলেন লিভিংস্টোন। আবার শুরু হল যাত্রা, লক্ষ্য নীল নদের উৎসস্থল! কিন্তু শরীরে আর আগের শক্তি ছিল না, তার উপর ক্রমাগত জ্বর আর আমাশায় ভুগছিলেন। সঙ্গীদের মধ্যে অধিকাংশই হয়ে উঠেছিল বিদ্রোহী। একটি নিগ্রো ছেলে তার সমস্ত ঔষুধ চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। সঙ্গের জিনিসপত্রও ফুরিয়ে এসেছিল। চলবার শক্তি হারিয়ে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন। জীবনের সব আশা হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। ঠিক সেই সময় অযাচিতভাবেই ঈশ্বরের আশীর্বাদ এসে গেল।

মিঃ এইচ. এম. স্টেনলি নামে এক ইংরেজ অভিযাত্রীকে লিভিংস্টোনের সন্ধানে পাঠানো হয়েছিল। একদিন মিঃ স্টেনলি দেখলেন একদল আরবের সাথে এক শীর্ণকায় শ্বেতাঙ্গ। সারা মুখে বড় বড় দাড়ি, মাথায় টুপি। মিঃ স্টেনলি এগিয়ে গিয়ে হাত ধরলেন–আপনিই কি ডঃ লিভিংস্টোন? মুহূর্তে লিভিংস্টোনের মুখে হাসি ফুটে উঠল। মনে হল অন্ধকারে যেন আলোর দিশা খুঁজে পেলেন।

কয়েকদিন পর নতুন উদ্যমে দুজনে টাঙ্গানিকার উত্তর তীর ধরে এগিয়ে চললেন, এখান থেকে মিঃ স্টেনলি বিদায় নিলেন। যাওয়ার আগে লিভিংস্টোনের প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র, নতুন কুলি যোগাড় করে দিয়ে গেলেন।

কিন্তু লিভিংস্টোনের জীবনিশক্তি শেষ হয়ে এসেছিল, কিন্তু তাঁর অদম্য মনোবলে এতটুকু ফাটল ধরেনি। কোনক্রমে এগিয়ে চলেছেন আর প্রতিদিনকার বিবরণী খাতায় লিখে রাখলেন। দিনটা ছিল ১৮৭৩ সালের ২৭শে এপ্রিল। শেষ ডাইরি লিখলেন লিভিংস্টোন। তারপর আচ্ছন্নের মত বিছানায় লুটিয়ে পড়লেন। দুটো দিন কেটে গেল, ১লা মে ভোরবেলায় একটি নিগ্রো চাকর এসে দেখল তিনি বিছানার পাশে প্রার্থনারত অবস্থাতেই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন।

তাঁর প্রিয় চাকরটি বহুকষ্টে লিভিংস্টোনের মৃতদেহ, তার জিনিসপত্র সবকিছু নিয়ে এল জনজিবারে সাগরের উপকূলে। সেখান থেকে সেই মৃহদেহ জাহাজে করে ইংলন্ডের ওয়েস্ট মিনিস্টার এ্যবেতে নিয়ে গিয়ে সমাধিস্থ করা হল। দেহ ইংলন্ডে গেলেও লিভিংস্টোনের আত্মা রয়ে গিয়েছিল তাঁর প্রিয় আফ্রিকায়।

তথ্যসূত্রঃ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী – মাইকেল এইচ. হার্ট / সম্পাদনায় – রামশংকর দেবনাথ




আর্কাইভ