এডওয়ার্ড জেনার (Edward Jenner)
প্রথম পাতা » জীবনী » এডওয়ার্ড জেনার (Edward Jenner)এডওয়ার্ড জেনার
(১৭৪৯–১৮২৩)
শীতের রাত, চারদিকে কনকনে ঠাণ্ডা। পথে ঘাটে একটি মানুষও নেই। অধিকাংশ মানুষই নেই। অধিকাংশ মানুষই ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে আগুনে পোয়াচ্ছে। যারা বাইরে গিয়েছিল, সকলেই ঘরে ফেরার জন্য উদগ্রীব।
ইংল্যান্ডের এক আধা শহর বার্কলেতে থাকতেন এক তরুণ ডাক্তার। বয়েসে তরুণ হলেও ডাক্তার হিসাবে ইতিমধ্যে চারিদিকে তার নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। দূর-দূরান্ত থেকে রুগী আসে তার কাছে। বহু দূরের এক রুগী দেখে বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামতেই ডাক্তার দেখলেন তাঁর বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কালো পোশাকে ঢাকা এক মহিলা। কছে এগিয়ে গেলেন! সামনে আসতেই মহিলাটি তাঁর পায়ের সামনে বসে পড়ল, আমার ছেলেকে বাঁচান ডাক্তারবাবু।
ডাক্তার তাড়াতাড়ি মহিলাটিকে তুলে ধরে বললেন, কোথায় আপনার ছেলে?
–ছেলেকে বাড়িতে রেখে এসেছি ডাক্তারবাবু। আমার চার চারটি ছেলে আগে মারা গিয়ে এই শেষ সম্বল।
সমস্ত দিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়েছিলেন ডাক্তার। তবুও মহিলাটির কাতর ডাকে সাড়া না দিয়ে পারলেন না…তার সাথে বাড়িতে গেলেন। গলির শেষ প্রান্তে ছোট্ট একটি ঘর, ঘরের মধ্যে প্রদীপ জ্বলছিল। এক কোণায় বিছানার উপর শুয়েছিল ছোট একটি বাচ্চা। সারা গায়ে ঢাকা দেওয়া। ডাক্তার গায়ের ঢাকা খুলতেই চমকে উঠলেন। শিশুটির সমস্ত শরীর গুটি বসন্তে ভরে গিয়েছে। জ্বরে বেহুঁশ।
ঔষধের বাক্স নিয়ে শিশুটির পাশে সমস্ত রাত জেগে রইলেন। সামনে উদবেলিত উৎকণ্ঠা ভরা চোখে চেয়ে আছে মহিলাটি।এই ভয়ঙ্কর অসুখ আমার আগের চারটি সন্তানকে কেড়ে নিয়েছে। একে আপনি বচন।
সমস্ত রাত জীবন আর মৃত্যুর লড়াই চলতে থাকে। অবশেষে পরাজিত হয় জীবন, মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিয়ে যায় জীবন। মায়ের কান্নায় মুখর হয়ে ওঠে চারদিক।
রণক্লান্ত পরাজিত সৈনিকের মত বাড়ি ফিরে চলেন ডাক্তার। তার বুকের মধ্যে বাজতে থাকে বিধবা মায়ের সন্তান হারাবার কান্না। নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। দীর্ঘক্ষণ পাথরের মূর্তির মত স্থির নিস্পন্দ হয়ে থাকেন। তারপর এক সময় উঠে দাঁড়ান। পুত্রহারা মায়ের এই কান্না তাকে বন্ধ করতেই হবে। পৃথিবী থেকে মুছে ফেলতে হবে মৃত্যুরূপী এই ভয়ঙ্কর গুটি বসন্তকে।
শুরু হল তাঁর সাধনা। একদিন দুদিন নয়, দিনের পর দিন মাসের পর মাস বছরের পর বছর। কোন ক্লান্তি নেই, অবসন্নতা নেই, এই সাধনায় তাঁকে সিদ্ধিলাভ করতেই হবে। অবশেষে সাফল্য এসে ধরা দিল সাধনার কাছে। জয়ী হল মানুষের সংগ্রাম। বসন্তের ভয়াবহ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেল পৃথিবী। যে মানুষটির নিরলস সাধনায় পরাজিত হল ভয়াবহ ব্যাধি, তার নাম এডওয়ার্ড জেনার।
১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই মে ইংলন্ডের বার্কলে শহরে তাঁর জন্ম। বাবা ছিলেন সেখানকার ধর্মযাজক। বার্কলের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়। ধর্মপ্রচারের সাথে সাথে স্থানীয় মানুষের সুখে-দুঃখে তিনি ছিলেন তাদের অকৃত্রিম বন্ধু। গরীব দুঃখী মানুষের প্রতি তাঁর ছিল সীমাহীন ভালবাসা। পিতার এই মহৎ গুণ শিশুবেলা থেকেই জেনারের চরিত্রে প্রভাব বিস্তার করেছিল। কিন্তু পিতার সান্নিধ্য দীর্ঘদিন পাননি জেনার। যখন তাঁর মাত্র পাঁচ বছর বয়েস তখন বাবা মারা যান। তাঁর সব ভার এসে পড়ে দাদা রেভারেন্ড স্টিফেন জেনারেলে উপর। দাদার স্নেহচ্ছায়াতেই বড় হয়ে উঠতে থাকেন জেনার। জেনার যেখানে থাকতেন সেই বার্কলের সংলগ্ন অঞ্চলে ছিল সবুজ মাঠ, গাছপালা, মাঝে মাঝে চাষের জমি, কোথাও গোচারণ ভূমি। চাষীরা চাষ করত, রাখাল ছেলেরা মাঠে গরু নিয়ে আসত।
ছেলেবেলা থেকেই এই উদার মুক্ত প্রকৃতি জেনারকে নেশার মত আকর্ষণ করত, তিনি একা একা ঘুরে বেড়াতেন মাঠের ধারে গাছের তলায়। মনে হত তারা যেন সজীব পদার্থ। প্রতিটি গাছের পাতায় ছোট ছোট ঘাসের মধ্যে তিনি যেন প্রাণের স্পন্দন শুনতে পাচ্ছেন। পাখির ডাক তার কলকাকলি মনে হত সঙ্গীতের মূচ্ছনা। প্রকৃতির মুখোমুখি হলেই তন্ময়তার গভীরে ডুব দিতেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করতেন, তার বৈচিত্র বৈশিষ্ট্য। যা কিছু দেখতেন জানতেন, বাড়ি ফিরে এসে খাতার পাতায় লিখে র আর লিখতেন কবিতা, কবিতার প্রতি ছেলেবেলা থেকেই ছিল তাঁর আকর্ষণ, পরিণত বয়েসেও তিনি অবসর পেলেই কবিতা লিখতেন। অন্তরে ছিলেন তিনি অবসর পেলেই কবিতা লিখতেন। অন্তরে ছিলেন তিনি কবি, প্রকৃতিপ্রেমিক, কর্মে বিজ্ঞানী চিকিৎসক।
ভর্তি হলেন স্থানীয় স্কুলে। এই সময় দেখতেন অসুস্থ মানুষের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা। তাঁর মনে হত বড় হয়ে এই কষ্ট দুঃখ তিনি দূর করবেন। স্কুলের ছাত্র অবস্থাতেই মনস্থির করলেন তিনি ডাক্তারি পড়বেন। সেই সময় চিকিৎসা ক্ষেত্রে শিক্ষা পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কেউ চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়ন করতে চাইলে তাকে কোন প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসকের কাছে ছাত্র হিসাবে কাজ করতে হত। গুরুর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে থেকে তারা হাতে-কলমে কাজ শিখত।
বার্কলেতে কোন প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার ছিল না। জেনার এলেন লন্ডনে। সেই সময় লন্ডনের সবচেয়ে খ্যাতিমান ডাক্তার ছিলেন জন হান্টার। তার কাছে ছাত্র হিসাবে ভর্তি হলেন। অল্পদিনের মধ্যেই হান্টার জেনারের একাগ্রতা, নিষ্ঠা, সাধনার পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হলেন। দীর্ঘ ছয় বছর ধরে তার কাছে ছাত্র হিসাবে কাজ করলেন। অবশেষে ১৭৭৩ সালে চব্বিশ বছর বয়সে ডাক্তার হান্টানের কাছে চিকিৎসার পাঠ শেষ করে বার্কলেতে ফিরে এলেন জেনার। স্থির করলেন এখানেই তাঁর চিকিৎসার পেশা শুরু করবেন।
চিকিৎসক হিসাবে জেনারের ছিল সহজাত প্রতিভা, অন্যদিকে রুগীর প্রতি ছিল তার আন্তরিক দরদ মমতা ভালবাসা। অল্পদিনের মধ্যেই চিকিৎসক হিসাবে চারদিকে তার নাম ছড়িয়ে পড়ল।
সেই সময় সবচেয়ে ভয়াবহ অসুখ ছিল বসন্ত। যখন কোথাও বসন্তের প্রাদুর্ভাব দেখা যেত, সেই অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ মারা পড়ত। তার কোন চিকিৎসা ছিল না। কিভাবে সেই রোগ নিরাময় করা যায় সে সম্বন্ধেও কারোর কোন ধারণা ছিল না। শুধুমাত্র কিছু প্রচলিত বিশ্বাস ছিল। যারা গরুর দুধ গোয়ায় তাদের গো বসন্ত হয়, একবার কারো গো বসন্ত হলে তার আর গুটি বসন্ত হয় না। এই তথ্যের সপক্ষে কেউ কোন প্রমাণ দিতে পারেনি। প্রত্যেকেই বলত তারা অন্যের কাছে শুনেছে মাত্র।
জেনারের কাছে অনেক বসন্তের রোগী আসত, তাদের কারোই প্রাণ বাঁচাতে পারতেন না। চোখের সামনে অসহায়ের মত দেখতেন তাদের মৃত্যু। কিভাবে এই রোগ নির্মূল করা যায় সেই সময়কার খ্যাতিমান সব ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগ করলেন, তাদের কেউই কোন পথের সন্ধান দিতে পারল না।
জেনার উপলব্ধি করতে পারলেন, মৃত্যুরূপী এই ভয়ঙ্কর অসুখের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করবার কাজে তাঁকে সাহায্য করবার কেউ নেই, তাঁকে একাই এগিয়ে যেতে হবে।
শুরু হল তাঁর পড়াশুনা, তিনি বিভিন্ন পুঁথি থেকে জানতে পারলেন অষ্টাদশ শতাব্দীতে চীন দেশের লোকেরা বসন্ত রোগ নিবারণের জন্য এক ধরনের টিকা ব্যবহার করত। যার দেহে বসন্ত হয়েছে তার থেকে খানিকটা পুঁজ নিয়ে অন্যের শরীরে ঢুকিয়ে দিত। তার ফলে সুস্থ মানুষটি সামান্য পরিমাণে অসুস্থ হলেও তার আর বসন্ত হত না। কিন্তু এই কাজ করবার সময় দেখা গিয়েছিল। সুস্থ লোকের দেহে বসন্তের পুঁজ ঢোকানোর ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা অসুস্থ হয়ে মারা পড়ছে। তাই এই পদ্ধতি সাফল্যলাভ করেনি।
শুরু হল জেনারের গবেষণা। বিভিন্ন রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের পুঁজ নিয়ে নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলেন। তার মনে হল প্রচলিত বিশ্বাসের মধ্যে কোথাও কোন সত্য আছে কিনা তাও যাচাই করে দেখতে হবে।
১৭৮০ সাল নাগাদ। দীর্ঘ গবেষণার পর জেনার উপলব্ধি করলেন, গো বসন্ত সম্বন্ধে যে ধারণা প্রচলিত তা আংশিক সত্য। এই গো বসন্ত সাধারণত গরুর শরীরে হয়। এতে গরুর বিশেষ কোন ক্ষতি হয় না। বিভিন্ন ধরনের গো বসন্তের পুঁজ এনে পরীক্ষা করলেন। দেখলেন শুধুমাত্র এক ধরনের গো বসন্তের পুঁজই গুটি বসন্তের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে কোন কার্যকারী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারবে কি না সে বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারলেন না জেনার।
ইতিমধ্যে দেশে বসন্তের প্রাদুর্ভাব ক্রমশই বেড়ে চলছিল। মানুষের হাহাকার শুনতে শুনতে বিচলিত হয়ে পড়তেন জেনার। মনে হত, জীবননাশিনী এই রোগের বিরুদ্ধে কি মানুষ কোনদিন জয়ী হতে পারবে না? মৃত্যুর কান্না কি বন্ধ হবে না?
জেনারের বাড়িতে আসত একটি গোয়ালিনী, নাম সারা নেলনিস। নেলনিস জেনারের বাড়িতে দুধ দিত। একদিন নেলনিসের কাছে জানতে পারলেন তার বাড়ির সকলের বসন্ত হয়েছে, কিন্তু নেলনিসের কিছু হয়নি। শুধুমাত্র তার হাতে কয়েকটি ছোট ছোট গুটি বেরিয়েছে। জেনার অনুমান করতে পারলেন যেহেতু কয়েক মাস আগে নেলনিসের গো বসন্ত হয়েছে তাই গুটি বসন্ত তাকে আক্রমণ করতে পারেনি।
ভাগ্যক্রমে সেই সময় একটি আট বছরের মা-বাপ মরা ছেলে জেমস ফিপস তার কাছে এল। ছেলেটিকে নিজের কাছে আশ্রয় দিলেন জেনার।
বহুদিন ধরেই জেনার চিন্তা করছিলেন গো বসন্তের টিকা নিয়ে মানুষের দেহে প্রয়োগ করবেন। ইতিপূর্বে তিনি বিভিন্ন জন্তু-জানোয়ারের উপর প্রয়োগ করেছিলেন এবং প্রতি ক্ষেত্রেই সফল হয়েছিলেন কিন্তু যতক্ষণ না কোন মানুষের দেহে প্রয়োগ করতে পারছেন ততক্ষণ তো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছেন না।
প্রথমে মনে হয়েছিল নিজের দেহে প্রয়োগ করবেন। কিন্তু যদি তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন কে তাকে সুস্থ করে তুলবেন? তাই জেমসের উপরেই ঔষধ প্রয়োগ করবার সিদ্ধান্ত নিলেন। দীর্ঘ কুড়ি বছরের গবেষণার পর অবশেষে ১৭৯৬ সালের ১৪ই মে জেনার প্রথমে সারা নেলনিসের হাতের গুটি থেকে ইনজেকশন করে সামান্য পুঁজ তুলে নিলেন তারপর ঈশ্বরের নাম করে সেই পুঁজ জেমসের শরীরে টিকা দিলেন।
জেমসের আগে কোনদিন বসন্ত হয়নি। টিকা নেওয়ার দু-একদিন পরেই দেখা গেল যেখানে টিকা নেওয়া হয়েছিল সেই জায়গায় একটা ঘা সৃষ্টি হয়েছে। কয়েকদিনের চিকিৎসায় সেই ঘা ধীরে ধীরে শুকিয়ে গেল। কিন্তু ক্ষতস্থানের একটা চিহ্ন রয়ে গেল।
কয়েকদিন ধরে জেনার জেমসকে নিয়ে বসন্ত রুদীদের মধ্যে চিকিৎসার কাজ করলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় জেমসের বসন্ত হল না। তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন তার কুড়ি বছরের সাধনা অবশেষে সফল হয়েছে। এখন প্রয়োজন তার এই সাফল্যের কথা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা। কিন্তু তার আগে সর্বসমক্ষে পরীক্ষ দিতে হবে। প্রমাণ করতে হবে তিনি গুটি বসন্তের প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছেন। জেনার লন্ডনের বিখ্যাত সব চিকিৎসকদের ডেকে তার গবেষণার কথা জানালেন। ঘোষণা করলেন সর্বসমক্ষে তিনি জেমসের শরীরে বসন্ত রোগের পুঁজ প্রবেশ করাবেন।
চারদিকে গুঞ্জন উঠল, কেউ বলল, জেনার অর্থহীন প্রলাপ বকছেন, কেউ বলল তিনি একটি শিশুকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। এ জঘন্য অপরাধ, কেউ কেউ মন্তব্য করর জেনার অর্থের লোভে জুয়াচুরি শুরু করেছেন। কিন্তু জেনার কারো সমালোচনাতেই কান দিলেন না।
১লা জুলাই ১৭৯৬ সাল। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য দিন। জেনার উপস্থিত ডাক্তারদের সামনে এক বসন্ত রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে পুঁজ নিয়ে জেমসের শরীরে ঢুকিয়ে দিলেন। সকলেই উৎকণ্ঠিত কৌতূহলী হয়ে উঠলেন…একদিন দুদিন করে বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। কিন্তু জেমসের দেহে বসন্তের সামান্যতম চিহ্ন দেখা গেল না। টিকা নেওয়ার জন্যে জেমসের দেহে প্রতিষেধক শক্তি সৃষ্টি হয়েছে।
কিন্তু চিকিৎসকরা কেউই জেনারের এই আবিষ্কারকে স্বীকৃতি দিতে চাইল না। এর পেছনে দুটি কারণ ছিল। একদল ভঁর এই অসাধারণ আবিষ্কারে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছিল, অন্যদল বিশ্বাস করতে পারছিল না গুটি বসন্তের মত ভয়াবহ অসুখকে নির্মূল করা সম্ভব।
নিজের বিশ্বাসে অটল ছিলেন জেনার। একের পর এক তেইশ জনকে টিকা দিলেন এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তিনি সফল হলেন।
এই সময় তার কাছে একাধিক প্রলোভন আসতে থাকে। স্যার ওয়ালটার নামে এক ভদ্রলোক জেনারকে এক লক্ষ পাউন্ড এবং বছরে দশ হাজার পাউন্ড দেবার কথা বলল, বিনিময়ে এই আবিষ্কারের ফর্মুলা তুলে দিতে হবে।
মানব কল্যাণে উৎসর্গীকৃত প্রাণ জেনার হাসিমুখে সেই অর্থ ফিরিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, মানুষের কল্যাণে আমি আমার এই আবিষ্কারকে ব্যবহার করতে চাই, অর্থ উপার্জনের জন্য নয়।
অবশেষে ১৭৯৮ সালে তিনি প্রকাশ করলেন তার যুগান্তকারী প্রবন্ধ Inquiry into cause and effect of the Variolae Vaccinae। এর পরের বছর প্রকাশ করলেন দ্বিতীয় প্রবন্ধ Further inquiry…। এবং চূড়ান্ত প্রবন্ধ প্রকাশ করলেন ১৮০০ সালে Complete Statement of facts and observations.
এই সমস্ত প্রবন্ধ প্রকাশের সাথে সাথে শুধু ইংলন্ড নয়, পৃথিবীর আরো বহু দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হল। প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক থেকে আরম্ভ করে হাতুড়ে ডাক্তার সকলেই এর বিরুদ্ধে মতামত দিতে আরম্ভ করল। অনেকে অভিমত দিল এ এক নূতন ধরনের অপারেশন। এতে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর বিরুদ্ধে ব্যঙ্গকৌতুক ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশিত হতে লাগল।
এই প্রচণ্ড বিরোধিতা সমালোচনা বিদ্রুপের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও জেনার অটল অবিচলিতভাবে তাঁর গবেষণার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। তার অটল বিশ্বাস ছিল মানুষ একদিন না একদিন তার আবিষ্কারকে স্বীকরা করে নেবে।
এই সময় গবেষণার প্রয়োজনে চিকিৎসা করতে পারতেন না। হাতে সামান্য যা অর্থ পেতেন গবেষণার কাজেই তা ব্যয় হত। সংসারে অভাব অনটন প্রকট হয়ে উঠল। দু এক জন হিতৈষী বন্ধু কিছু অর্থ সাহায্য করতে চাইলে তিনি হাসিমুখে তাদের ফিরিয়ে দিলেন। পরিবারের প্রতিটি মানুষের সাথেই দারিদ্র্যকে ভাগাভাগি করে নিতেন।
একদিকে দারিদ্র অন্যদিকে প্রত্যক্ষ বিরোধিতা। এই দুইয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সাময়িক বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেও ধীরে ধীরে নিজের মধ্যে শক্তি সঞ্চয় করলেন। তিনি অনুভব করতে পারছিলেন তার আরো বাধার সম্মুখীন হতে হবে এবং সমস্ত বাধাকে অতিক্রম করেই চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করতে হবে।
জেনারকে দুই ধরনের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হল। একদল লোক, তাদের বেশির ভাগ মানুষই ছিল ডাক্তার–তারা চারদিকে প্রচার করতে আরম্ভ করল গুটি বসন্তের প্রতিরোধক হিসাবে যে টিকা ব্যবহার করা হচ্ছে তা মানুষের শরীরের পক্ষে ক্ষতি রিক, এতে মানুষের মত পর্যন্ত হতে পারে। এই ধরনের প্রচারে জেনার বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না। কারণ তিনি জানতেন যে মানুষ একবার টিকা গ্রহণ করতে পারবে, সে নিজেই উপলব্ধি করতে পারবে এই টিকা কল্যাণকর না ক্ষতিকারক। কিন্তু বিপদ এল অন্য পথে।
সেই সময় ডাক্তার জর্জ পিয়ার্সন বলে একজন চিকিৎসক ঘোষণা করলেন ইতিপূর্বেই তিনি এই বিষয়ে গবেষণা করেছেন এবং টিকা দেওয়ার প্রণালী সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অবগত আছেন এবং তিনি তার একটি রচনা প্রকাশ করলেন, যদিও গো বসন্ত সম্বন্ধে তাঁর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন জ্ঞানই ছিল না।
তিনি গুটি বসন্তের সম্বন্ধে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করলেন, এবং গো বসন্তের পরিবর্তে মানুষের দেহে যে গুটি বসন্তু হয় তা দিয়েই টিকা তৈরি করে বিভিন্ন মানুষকে দিতে আরম্ভ করলেন।
জেনার তার গবেষণায় প্রমাণ করেছিলেন দু’ধরনের গো বসন্ত আছে। তার মধ্যে একটির গুটি বসন্ত প্রতিশেষধ ক্ষমতা আছে। এবং তা তখনই সম্ভব যদি একটি বিশেষ অবস্থায় অসুস্থ গরুর বা গো বসন্তে আক্রান্ত রোগীর দেহ থেকে টিকা তৈরি করে অন্যকে দেওয়া হয়। কিন্তু যদি গুটি বসন্তে আক্রান্ত দেহ পুঁজ রক্ত নিয়ে টিকা প্রস্তুত করা হয় তাতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রুগীর দেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠলেন রোগীর জীবনের আশঙ্কা থেকেই যায়। পিয়ার্সন এই ধরনের টিকা প্রস্তুত করে বিতরণ করতে আরম্ভ করলেন। শুধু তাই নয়, বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার জন্য লন্ডনে একটি দাঁতব্য প্রতিষ্ঠান তৈরির কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
অন্য কেউ এই ধরনের বিপজ্জনক কাজের পরিণতির কথা চিন্তা করতে না পারলেও জেনার তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি সরাসরি এর বিরুদ্ধে প্রচার করতে আরম্ভ করলেন। সৌভাগ্যক্রমে কিছু খ্যাতনামা চিকিৎসক জেনারের বক্তব্যের সারমর্ম উপলব্ধি করতে পারলেন। তারাও এগিয়ে এলেন জেনারের সমর্থনে। সমবেত প্রতিরোধের সামনে পিয়ার্সন পিছু হটতে বাধ্য হলেন। এবং তার প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল।
মানুষ ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে পারছিল জেনারের আবিষ্কারের গুরুত্ব। এ বিষয়ে জানবার জন্য প্রতিদিন তিনি অজস্র মানুষের কাছ থেকে চিঠি পেতেন। কেউ চিঠি লিখে তাঁর কাছে সিরাম চাইত, কেউ এই মহান আবিষ্কারের জন্য তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ধন্যবাদ দিত। অনেকে এ বিষয়ে আরো বিস্তৃতভাবে জানতে চাইত। ক্রমশই চিঠির সংখ্যা এতই বেড়ে চলল যে শুধু চিঠির উত্তর দেবার জন্য তাঁকে দুজন লোক রাখতে হল। এত চিঠি লেখার জন্যে তিনি কৌতুক করে বলতেন, “আমি একজন ভ্যাকসিন ক্লার্ক।” প্রশংসা ছাড়াও বিরোধী পক্ষেরও কম চিঠি পেতেন না। যদিও এদের বেশির ভাগই ছিল কিছু মূর্খ মানুষ আর হাতুড়ে ডাক্তার। তাদের মতে ধরনের টিকা মানুষের ‘ পক্ষে ক্ষতিকারক এবং এর ফলে দেশে গুটি বসন্তের আরো প্রসার ঘটবে।
কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে তাদের সব সন্দেহ অমূলক বলে প্রমাণিত হত। পিয়ার্সন যাদের টিকা দিয়েছিলেন তাদের বেশির ভাগ লোকই গুটি বসন্তে আক্রান্ত হয়েছিল। জেনার প্রমাণ করলেন করলেন সেই সব লোকেদের যে টিকা দেওয়া হয়েছিল তাদের প্রস্তুত প্রণালী ভুল ছিল। তাই লোকে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল হয়ে পড়েছিল। তিনি শত শত মানুষকে টিকা দিয়ে প্রমাণ করলেন তাঁর নির্দেশিত পদ্ধতিতে প্রস্তুত টিকা সম্পূর্ণ নিরাপদ। ধীরে ধীরে মানুষ উপলব্ধি করতে পারল টিকা নেওয়ার সার্থকতা। ১৮ মাসে ইংলন্ডে প্রায় ১২০০০ মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় এক তৃতীয়ংশ কমে আসে।
জেনারের খ্যাতি ক্রমশই চারদিকে ছড়িয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। টিকার সম্বন্ধে মানুষের যে প্রাথমিক ভীতি ছিল, একটু একটু করে কাটতে আরম্ভ করল। লোকে উপলব্ধি করতে পারছিল একমাত্র টিকা নিলেই মানুষ এই ভয়ঙ্কর ব্যাধির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে।
কিন্তু তবুও পার্লামেন্ট, ইংলন্ডের গুণীজন এই মহান আবিষ্কারকে স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠা বোধ করছিল। পার্লামেন্টের তরফ থেকে তাঁকে মাত্র দশ হাজার পাউন্ড পুরষ্কার দেওয়া হর এবং তার মধ্যে এক হাজার পাউন্ড সরকারী খরচ বলে কেটে নেওয়া হল। গবেষণার জন্য যে বিরাট অর্থ ব্যয় করতে হয়েছিল, এই অনুদান ছিল তার তুলনায় নগণ্য। জেনার নিজের সম্বন্ধে তাই কৌতুক করে বলেছিলেন, “আমি একজন ভ্যাকসিন ক্লার্ক। বিজ্ঞানী হিসাবে কেউ আমাকে মর্যাদা দিল না।”
অর্থের প্রতি কোন মোহ ছিল না জেনারের। তিনি চেয়েছিলেন পার্লামেন্টের অর্থে একদিকে যেমন গবেষণার কাজ চালিয়ে যাবেন, অন্যদিকে দীন-দরিদ্র মানুষদের মধ্যে বিনামূল্যে টিকা দেবেন। সামান্য যা সম্বল ছিল তাই নিয়েই কাজ শুরু করলেন। তিনি নিজেই ভ্যাকসিন তৈরি করে লোককে টিকা দিতে আরম্ভ করলেন। প্রতিদিন তার বাড়িতে দীর্ঘ লাইন পড়ে যেত। তিনি হাসিমুখে সকলকে টিকা দিতেন। এক একদিন তিনশোর বেশি মানুষকে টিকা দিতে হত।
শুধু দরিদ্র সাধারণ মানুষ নয়, ইংলন্ডের বহু অভিজাত পরিবারের সন্তানরা তার কাছে টিকা নেবার জন্য আসতে আরম্ভ করল।
ইংলন্ডের সীমানা ছাড়িয়ে জেনারের মহান আবিষ্কারের কথা ছড়িয়ে পড়ল দেশে দেশে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন টমাস জেফারসন। তিনি এই টিকা নিলেন। রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী এই টিকা নিলেন। জার্মানীতে ব্যাপকভাবে প্রচলিত হল এই টিকা। জেনারকে সম্মান জানাবার জন্যে জার্মানীতে প্রথম টিকা দেবার দিনটিকে জাতীয় উৎসবের দিন হিসাবে ঘোষণা করা হল।
ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়ন টিকা নিলেন। জেনারের প্রতি ছিল তার গভীর শ্রদ্ধা। ফ্রান্সে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগের ক্ষেত্রে তার উৎসাহ ছিল সবচেয়ে বেশি।
একবার কোন এক যুদ্ধে ইংলন্ডের বহু সৈনিককে বন্দী করেছিলেন নেপোলিয়ন। তাদের মধ্যে কয়েকজন ছিল জেনারের পরিচিত। সেই বন্দীদের মুক্তির জন্য জেনার চিঠি লিখলেন নেপোলিয়নকে। সামরিক দপ্তর থেকে সেই চিঠি দেওয়া হল সম্রাজ্ঞীর কাছে। তিনি চিঠিটি নিয়ে গেলেন নেপোলিয়নের কাছে। তিনি চিঠিটি নিয়ে গেলেন নেপোলিয়নের কাছে। নেপোলিয়ন শুধুমাত্র চিঠির কথা শুনেই বললেন, “ঐ মানুষটির নামে কোন অনুরোধ এলে তা আমাদের ফেরানো সম্ভব নয়।”
সম্রাটের আদেশে সমস্ত বন্দীদেরই মুক্তি দেওয়া হল। পার্লামেন্টের সদস্যরা ক্রমশই উপলব্ধি করতে পারছিলেন জেনারেল প্রতিভাকে অস্বীকার করে লাভ নেই। এবার তাঁকে হাজার পাউন্ড সাহায্য দেওয়া হল। এই অর্থে জেনার গড়ে তুললেন জাতীয় ভ্যাকসিন ইন্সটিটিউশন। (National Vaccine Institution). এই প্রতিষ্ঠানটিকে গড়ে তোলাবার জন্য শুরু হল তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম। কয়েক মাস পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। লন্ডনের পরিবেশ তাঁর ভাল লাগছিল না। বার্কলেন কমওন্ডের সবুজ প্রান্তর, উন্মুক্ত প্রকৃতি ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। লন্ডন ছেড়ে চলে এলেন বার্কলে। লন্ডন ত্যাগ করার পেছনে আরো একটি কারণ ছিল, ভ্যাকসিন ইন্সটিটিউশনের তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা ডিরেক্টর। কিন্তু তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই বেশ কিছু সদস্য নেওয়া হল যারা ছিলেন জেনারের সম্পূর্ণ বিরোধী। কোন প্রতিবাদ করলেন না জেনার, শুধু নীরবে পদত্যাগ করলেন।
আসলে জেনার ছিলেন একজন প্রকৃতিই বিজ্ঞানী, নম্র বিনয়ী, কোন অর্থ যশ খ্যাতি সম্মানের প্রতি তাঁর সামান্যতম আগ্রহ ছিল না। তিনি ইচ্ছা করলে তাঁর এই আবিষ্কার থেকে লক্ষ লক্ষ পাউন্ড উপার্জন করতে পারতেন। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন তার এই আবিষ্কার মানব কল্যাণের কাজে লাগুক, অর্থ উপার্জনে নয়।
১৮০৬ সালে বিখ্যাত সমাজসংস্কারক উইলবারফোর্স লিখেছেন, “জেনারের টিকা এখন ব্যবহৃত হচ্ছে পৃথিবীর দূরতম প্রান্তে। সুদূর চীন, ভারতবর্ষে।”
সমস্ত পৃথিবী তাকে সম্মানিত করলে তার স্বদেশ তাঁকে যোগ্য মর্যাদা দেয়নি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে M.D উপাধি দেওয়অর পর সকলেই অনুমান করেছিল তাঁকে রয়অল কলেজ অব ফিজিসিয়ানস (Royal college of Physicians)-এর সদস্য করা হবে। কিন্তু কলেজ থেকে জানানো হল তাঁকে এই কলেজের সদস্য হতে গেলে গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষায় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। (জেনার এই দুটি ভাষার কোনটিই জানতেন না। তিনি এই অপমানকর প্রস্তাব সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে বললেন, আমার কাছে এই সম্মানের কোন মূল্য নেই।
তবে জেনার চেয়েছিলেন ইংলন্ডের রয়াল সোসাইটি তাঁর গবেষণাপত্র অনুমোদন করবে। রায়ল সোসাইটি ছিল বিজ্ঞানীদের প্রধান সংগঠন। বিস্ময়ে অবাক হতে হয় যে আবিষ্কার পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করল সেই গবেষণাপত্রকে ত্রুটিপূর্ণ বলে অমনোনীত করেছিল রয়াল সোসাইটি। এই ঘটনায় জেনার খুবই দুঃখিত হয়েছিলেন। তবুও তাঁর গবেষণার কাজ বন্ধ হয়নি।
বার্কলের নিভৃত প্রান্তরে স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে সুখী জীবন যাপন করতেন। কদাচিৎ লন্ডনে যেতেন। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল ক্যাথারিন। শান্ত উদার সহৃদয় স্বভাবের মহিলা। জেনারের প্রতিটি গবেষণা কাজের পেছনে ছিল তার অফুরন্ত উৎসাহ অনুপ্রেরণা। স্বামীর বিশ্বাস আদর্শকে তিনি গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রচার করতেন। তাদের সৎ আদর্শবান হয়ে ওঠার শিক্ষা দিতেন।
জেনার যখনই সময় পেতেন স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে দূরে কোথাও ছুটি কাটাতে যেতেন। ছেলেকে তিনি চিকিৎসক হিসাবেই গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ১৮১০ সালে ছেলের আকস্মিক মৃত্যুতে মানসিক দিক থেকে একেবারেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এরপর থেকে কদাচিৎ ঘরের বাইরে বার হতেন।
১৮১৫ সালে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যু হল। এই সময় তার এক বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছেন, “আমার চারদিকে সব যেন শূন্য হয়ে গেল।”
স্ত্রী, পুত্রের মৃত্যুর বেদনা ভুলতে তিনি ফিরে গেলেন তাঁর প্রকৃতির মধ্যে, যে প্রকৃতিতে তিনি আজন্ম ভালবেসেছিলেন। এই সময় তিনি গাছপালা পাখিদের নিয়ে পড়াশুনা করতেন। মৃত্যুর আগে তিনি শেষ প্রবন্ধ লেখেন দেশান্তরী পাখিদের নিয়ে।
জীবনের সব কাজ শেষ হয়ে এসেছিল জেনারের। একা একা বসে মনে করতেন পুরনো দিনে স্মৃতিকথা। একটি মানুষের কথা বড় বেশি মনে পড়ে তার। বহু বছর আগে দেখা সেই অসুস্থ সন্তানের মা। কতবার তার খোঁজ করেছেন, কোন সন্ধান পাননি, কতদিন ঘুমের মধ্যে জেগে উঠেছেন সন্তানহারা সেই মায়ের কান্নায়।
জীবনের অন্তিম লগ্নে এসে আর কোন দুঃখ নেই। মায়ের কান্না তিনি চিরদিনের মত মুছিয়ে দিতে পেরেছেন।
১৮২৩ সালের ২৬শে জানুয়ারি সকলকে কাঁদিয়ে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন কবি, প্রকৃতি প্রেমিক, বিজ্ঞানী, মানবদরদী এডওয়ার্ড জেনার।
তথ্যসূত্রঃ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী – মাইকেল এইচ. হার্ট / সম্পাদনায় – রামশংকর দেবনাথ