পাবলো নেরুদা (Pablo Neruda)
প্রথম পাতা » জীবনী » পাবলো নেরুদা (Pablo Neruda)পাবলো নেরুদা
(১৯০৪–১৯৭৩)
“আমি কোন সমালোচক প্রবন্ধকার নই। আমি সাধারণ কবি মাত্র। কবিতা ভিন্ন অন্য ভাষায় কথা বলা আমার পক্ষে অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার। যদি আমাকে জিজ্ঞাসা কর আমার কবিতা কি? তাহলে বলতে হয় আমি জানি না। কিন্তু যদি আমার কবিতাকে প্রশ্ন কর সে জবাব দেবে, আমি কে।”
যথার্থ অর্থেই তাঁর কবিতার মধ্যেই তার জীবনের প্রকাশ। তাঁর কবিতার মধ্যে ফুটে উঠেছে তার ভালবাসা, তাঁর আশা আকাক্ষা, স্বপ্ন-আবেগ, তার আনন্দ, বেদনা, ক্রোধ, হতাশা আর সকলকে ছাপিয়ে তার তীব্র প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদের কবি, ভালবাসার কবির নাম পাবলো নেরুদা।
নেরুদার আসল নাম নেফতালি রিকার্দো রেয়েজ বোসোয়ালতো। কিশোর বয়েসে যখন নেরুদার সাহিত্য জীবনের সূত্রপাত হয়, সেই সময় চেকোশ্লোভাকিয়ায় ইয়ান নেরুদা বলে একজন বিখ্যাত লেখক ছিলেন। তাঁর নামে ছদ্মনাম গ্রহণ করে নিজের নাম রাখেন পাবলো নেরুদা।
নেরুদার জন্ম চিলিতে (১২ জুলাই ১৯০৪)। দক্ষিণ আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে স্বাধীন দেশ চিলি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের প্রবাসী মানুষ আর স্থানীয় উপজাতিরাই গড়ে তুলেছে এই দেশ। এখানে মিশ্র-ভাষা গড়ে উঠলেই সাহিত্যের ভাষা স্প্যানিশ। নেরুদার বাবা ছিলেন সামান্য কিছু জমির মালিক, মা একটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। নেরুদার জন্মের এক মাস পরেই মা টি. বি. তে মারা যান। বাবা আবার বিয়ে করলেন। নিজের মা না হলেও সৎ মা নেরুদাকে ভালবাসতেন নিজের সন্তানের মত। নিজের সন্তানের সাথে কোনদিন বিভেদ করেননি সৎ মা।
নেরুদার বয়স তখন দু বছর। দক্ষিণ চিলির সীমান্ত অঞ্চলে জঙ্গল কেটে নতুন বসতি গড়ে উঠেছে। সংসারের আর্থিক অনটনের জন্য নেরুদার বাবা স্থির করলেন আরাউকো প্রদেশের সেই অরণ্য অঞ্চলে গিয়ে বসবাস করবেন। সেখানে রেললাইন সংলগ্ন কাজ, রাস্তা তৈরির ঠিকাদারির কাজ নিলেন।
এ এক সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ। চারদিকে ঘন সবুজ অরণ্য। কোথাও অরণ্য নির্মূল করে গড়ে উঠেছে চাষের ক্ষেত। সর্বত্রই এক আদিম বন্য প্রকৃতি। কোন ধর্মীয়, সামজিক নিয়ম-কানুনের বেড়াজাল নেই। মুক্ত অরণ্যের মতই মানুষের বেড়ে ওঠা। অরণ্যের নিত্য সঙ্গী হয়ে সারা বছর ঝরে পড়ে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি। শিশু নেরুদার জীবনে এই বৃষ্টি আর অরণ্য গভীর প্রভাব ফেলেছিল। সকলের অজান্তেই তার মধ্যে জেগে উঠেছিল এক কবি স্বত্তা। যখন তার বয়স মাত্র দশ। তখনই শুরু হয় তাঁর কবিতা লেখা। শিশুমনের কল্পনায় যে ভাব জেগে ওঠে তাই লিখে ফেলেন।
স্কুলে নিয়মিত পড়াশুনার সাথে সাথে বাইরের বই পড়ার নেশা জেগে ওঠে। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ছেলেবেলায় আমি ছিলাম ঠিক যেন এক উটপাখি। কোন কিছু বাজবিচার না করেই আমি যা পেতাম তাই পড়ে ফেলতাম।
তেমুকোর পরিবেশ সাহিত্য-সংস্কৃতির অনুকূল ছিল না। নেরুদার পিতার ইচ্ছা ছিল ছেলে বড় হয়ে যেন সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক অগ্রণী পুরুষ হয়ে ওঠে। তাই ষোল বছর বয়েসে নেরুদাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল শান্তিয়াগোতে। সেই সময় কিশোর কবি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নেরুদা। তাঁর সাহিত্য জীবনে স্থানীয় মেয়েদের স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা গ্যাব্রিয়েল মিস্ত্রালের ভূমিকা বিরাট। মিস্ত্রাল শুধু চিলির নন, বিশ্বসাহিত্যের এক শ্রেষ্ঠ মহিলা কবি। তাঁর অসামান্য সৃষ্টির জন্য নোবেল পুরস্কার পান। মিস্ত্রাল নেরুদার মধ্যে একজন শ্রেষ্ঠ কবির সম্ভাবনাকে খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি শুধু তাঁকে উৎসাহিত করতেন তাই নয়, নিয়মিত তার কবিতা সংশোধন করে দিতেন।
১৯২১ সালে স্কুলের শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নেরুদা এলেন সান্তিয়াগোতে। চিলির অন্যতম প্রধান শহর। সাহিত্য সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল। এখানে এসে ফরাসী ভাষা শিখতে আরম্ভ করলেন। কলেজে ভর্তি হলেন কিন্তু পড়াশুনায় তেমন মন নেই। কেমন ছন্নছাড়া ভাব। অল্পদিনের মধ্যেই কয়েকজন তরুণ কবির সাথে পরিচিত হলেন। তার কবিতা তখন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে আরম্ভ হয়েছে। এই সময়েই তিনি পিতৃ নাম পরিত্যাগ করে পাবলো নেরুদা”–এই ছদ্মনাম গ্রহণ করেন।
কবি হিসাবে যখন সাহিত্যরসিকদের দৃষ্টি তার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে, নেরুদার জীবনে এল এক সুন্দরী তরুণী আলবার্তিনা। দীর্ঘ দিন তার পরিচয় গোপন রেখেছিলেন নেরুদা। প্রথম প্রেমের মুকুল বিকশিত হয়নি। অল্পদিনের মধ্যেই দুজনের সম্পর্কে ভাঙন ধরল। জীবন থেকে হারিয়ে গেলে ও আলবার্তিনাকে কবি অমর করে রেখেছেন তার অসাধারণ সব প্রেমের কবিতায়। এই কবিতাগুলো নিয়ে ১৯২৪ সালে কুড়ি বছর বয়েসে প্রকাশিত হল Twenty Love poenns. এর আগে আর একটি কবিতার বই প্রকাশ করেছিলেন Twilight Book. সেই বইটি তেমন কোন সাড়া জাগাতে পারেনি। কিন্তু “কুড়িটি প্রেমের কবিতা” বইটি প্রকাশিত হতেই চারদিকে আলোড়ন পড়ে গেল। প্রচলিত ধারাকে অনুসরণ করলেও এর আঙ্গিক, ভাব, ভাষায় নিয়ে এলেন পরিবর্তন। আনন্দ-বেদনার সুরের মূচ্ছনা এতে এমনভাবে পরিস্ফুট হয়েছে সহজেই পাঠকের অন্তরকে স্পর্শ করে কবি হিসাবে তার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
১৯২৬ সালে প্রকাশিত হল দুটি রচনা। এক বন্ধুর সাথে যৌথভাবে একটি ছোট উপন্যাস। আর একটি কবিতার বই Venture of Infinite man-এর প্রতিটি কবিতায় প্রচলিত সমস্ত প্রথা ভেঙে নিয়ে এলেন নতুন আঙ্গিক, ছন্দ। মানব চরিত্রের এক অস্থিরতা, নিঃসঙ্গতাই এখানে যেন প্রকট হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ কিন্তু এই বইটিকে গ্রহণ করতে পারল না।
এদিকে ছেলে পড়াশুনা বন্ধ করে কবিতা লিখছে এই ব্যাপারটি ভাল লাগল না নেরুদার বাবার। তিনি সমস্ত মাসোহারা বন্ধ করে দিলেন। মহা ভাবনায় পড়ে গেলেন নেরুদা। তিনটি বই বার হলেও তার থেকে সামান্যই অর্থ পেয়েছেন। অর্থ ছাড়া কেমন করে নিজের খরচ মেটাবেন! পিতার কাছে হাত পাততে মন সায় দিল না। শুরু হল চাকরির চেষ্টা। কয়েক মাস চেষ্টা করেও কোথাও চাকরি পেলেন না। সেই সময় চিলির বিদেশ দপ্তর থেকে রেঙ্গুন অফিসে পাঠাবার জন্যে একজন লোকের খোঁজ করা হচ্ছিল। কোন লোকই কয়েক হাজার মাইল দূরে বার্মার রেঙ্গুন তখন ব্রিটিশ অধিনস্ত বার্মার রাজধানী। এখানে পরিচিত কোন মানুষ নেই। স্থানীয় মানুষেরা কেউ স্প্যানিশ ভাষা জানে না। অফিসের দু-চারজন যেটুকু ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশ জানে তাতেই কোন রকমে কথাবার্তা চালান। অসহনীয় পরিবেশ, কথা বলবার লোক নেই, তার উপর সব মাসে ঠিক মত মাইনে পান না, তবুও রেঙ্গুনে রয়ে গেলেন। এই নির্জন প্রবাসে তার একমাত্র সঙ্গী কবিতা।
চার বছর কেটে গেল। স্থানীয় ভাষা মোটামুটি আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন নেরুদা। অনেক বার্মিজ পরিবারের লোকজনের সাথেই তার আলাপ পরিচয় ছিল। এদের মধ্যে ছিল এক তরুণী। তার মধ্যেকার উদ্দামতা দেখে ভাল লেগে গিয়েছিল। প্রেমে পড়ে গেলেন। কিছু দিন যেতেই নেরুদা অনুভব করলেন মেয়েটির মধ্যে আছে এক আদিম বন্য উদ্দামতা। মনের মধ্যে যদি কখনো সন্দেহ দেখা দেয়, সাথে সাথে ছুরি দিয়ে হত্যা করবে নেরুদাকে। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লেন নেরুদা। সৌভাগ্যক্রমে সেই সময় সিংহলে তার বদলির আদেশ হল। কাউকে কিছু না জানিয়ে রওনা হলেন সিংহল। মেয়েটি নেরুদার সন্ধান পাওয়ার জন্যে সিংহল পর্যন্ত গিয়েছিল। তার এই বন্য প্রেমকে নেরুদা বহু কবিতায় অবিস্মরণীয় রূপ দিয়েছেন। বার্মার জীবনের নিঃসঙ্গতাকে ভুলতে বেশ কিছু কবিতা লিখেছেন। এই কবিতাগুলো সংকলন করেই পরে প্রকাশিত হয় তার একটি। বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ Residence on eath (পৃথিবীতে বাসা)।
সিংহলে অল্প কিছুদিন থাকার পর এলেন বাটাভিয়ায় প্রবাস জীবনে একাধিক মেয়ের সান্নিধ্যে এলেও কাউকে বিবাহ করবার কথা ভাবেননি। বাটাভিয়াতে প্রথম ডাচ তরুণী মারিয়া এন্তোনিয়েতাকে দেখে বিবাহ করার কথা মনে হল। একদিন সরাসরি মারিয়াকে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। সম্মত হল মারিয়া। প্রথম কয়েক মাস সুখেই কেটে গেল। মারিয়া ডাচ মেয়ে, স্প্যানিশ ভাষা জানত না। নেরুদার চেষ্টা সত্ত্বেও স্প্যানিশ ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে তার সামান্যতম আগ্রহ ছিল না। নেরুদার কবিতার ব্যাপারেও ছিল উদাসীন। দুজনের মধ্যেকার মতাদর্শগত পার্থক্য, দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমশই প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। বাটাভিয়াতে থাকতে মন চাইল না, ফিরে এলেন তেমুকোতে বাবার কাছে।
ছেলেবেলাতে দেখা তেমুকোর অনেক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। সেই বনভূমি নির্জন প্রকৃতি আর নেই, সেখানে গড়ে উঠেছে শহর, কত অসংখ্য মানুষের আবাসস্থল। এখানকার মানুষের সাথে বহুদিন কোন যোগাযোগ নেই। নিজেকে যেন পরবাসী বলে। মনে হয়। মাঝে মাঝে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। অরণ্য মুক্ত প্রান্তর তাঁকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। সংসারে মারিয়ার সাথে অশান্তি বেড়ে চলে। দুজনেই বুঝতে পারেন এই ভাবে আর একসাথে থাকা সম্ভব নয়। বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায় তাঁদের।
এই মানসিক উদ্বেলতার মধ্যেই তিনি প্রকাশ করেন তার রেসিডেন্স অন আর্থ।’ এই পর্যায়ের সমস্ত কবিতাই লিখেছিলেন দূর প্রাচ্যে থাকাকালীন সময়ে। রেসিডেন্স অন আর্থ’ প্রকাশের সাথে সাথে চারদিক থেকে অভিনন্দন আসতে থাকে। সেই সূত্রেই একদিন পরিচয় হল আর্জেন্টিনার তরুণী চিত্রশিল্পী দলিয়ার সাথে। দুজনেই দুজনের ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হলেন। অল্পদিনের মধ্যেই বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছে তারা।
কবি হিসাবে খ্যাতি পেলেও আশানুরূপ অর্থ পেলেন না। নিতান্ত প্রয়োজনেই আবার বিদেশ দপ্তরে চাকরি নিলেন নেরুদা। এবার স্পেন। ১৯৩৪ সালে চিলির কন্সাল হয়ে এলেন স্পেনের বার্সিলোনায়। স্পেনের মানুষের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেলেন তিনি। এখানকার মানুষের মুখের ভাষাই তাঁর সাহিত্যের ভাষা। অল্পদিনের মধ্যেই তরুণ কবিদের সাথে পরিচয় হল। শুধু কবিতাই নয়, স্পেনের বুদ্ধিজীবীরাও স্বাগত জানাল এই তরুণ কবিকে। স্পেনের সমকালীন রাজনীতি, গণমুখী সাহিত্য গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল নেরুদাকে। তারই ফলশ্রুতি রেসিডেন্স অন আর্থের দ্বিতীয় পর্ব। সমস্ত স্পেনের সাহিত্য জগতে আলোড়ন ওঠে। দীর্ঘ সংগ্রামের পর অবশেষে প্রতিষ্ঠা পেলেন নেরুদা।
প্রথমে বার্সিলোনা তারপর মাদ্রিদে এলেন। মাদ্রিদ সেই সময় স্পেনের কবি শিল্পী সাহিত্যিক নাট্যকারদের মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল। এদের অনেকের সাথেই বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল নেরুদার। স্পেনের ভাগ্যাকাশে তখন আবির্ভাব ঘটেছে স্বৈরাচারী শাসক ফ্রাংকোর। অল্পদিনের মধ্যেই দেশ জুড়ে শুরু হল গৃহযুদ্ধ (১৯৩৬–১৯৩৯)। ফ্রাংকো উত্তর আফ্রিকা আক্রমণ করলেন। চারদিকে প্রতিবাদের ঢেউ উঠল। সমস্ত প্রতিবাদী কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেবার জন্য শত শত মানুষকে হত্যা করা হল। এদের মধ্যে ছিলেন স্পেনের তরুণ কবি লরকা। বেদনায় ক্ষোভে ফেটে পড়লেন নেরুদা। তাঁর কবিতা হয়ে উঠল স্পেনের সংগ্রামী মানুষের প্রতিবাদের হাতিয়ার। সরকার হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি জ্বালাময়ী ভাষায় প্রতিবাদ জানালেন।
স্পেনের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নেরুদা গোপনে যোগ দিলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। এই সময় লিখলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা “Spain in my Heark” (1937}। সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ায় তিনি সরকারের বিরাগভাজন হলেন। তাঁকে সরকারী কনসালের পদ হারাতে হল। চিলির রাজনৈতিক পরিবেশও আর তাঁর পক্ষে নিরাপদ ছিল না। স্ত্রী দালিয়াও সন্তানসম্ভবা। নেরুদা প্রথমে স্পেন ত্যাগ করে এলেন প্যারিসে। তারপর ফিরে এলেন চিলিতে।
চিলিতে এসেও রাজনৈতিক আন্দোলনের থেকে নিজেকে নিবৃত করলেন না। জোরালো ভাষায় স্পেনের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। দেশে দেশে সংগ্রামী মানুষদের কাছে প্রচার করতে থাকেন তাঁর রচনা। এই সময় তাঁর রচিত কবিতা সংকলন দ্য ফিউরাস অ্যান্ড দ্য পেইনস প্রকাশিত হয়। প্রথম যৌবনে তিনি লিখেছিলেন প্রেমের কবিতা, ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠলেন সংগ্রামের কবি।
আমি যখন প্রেমের কবিতা লিখি,
আমার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে
ঝর্ণার মত কবিতার ধারা…
……………………।
ওরা আমাকে বলেছে, “কি মহান তুমি থিওকরিটাস।”
আমি বলেছি, আমি থিওকরিটাস নই।
জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে পেয়েছি,
জয় করেছি, চুম্বন করেছি।
তারপর প্রবাহিত মানুষের জীবনের
মুখোমুখি হওয়ার জন্য
হেঁটে গিয়েছি
পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে, খনির গুহাগর্ভে।
দু বছর কর্মহীন জীবন যাপন করবার পর ১৯৪০ সালে কনসাল জেনারেল হিসাবে তাঁকে পাঠানো হল মেক্সিকোতে। দীর্ঘ তিন বছর তিনি মেক্সিকোতে ছিলেন। এই সময় নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করতেন। চিলির রাজনৈতিক জগতের অনেকের সাথেই যোগাযোগ রাখতেন।
চিলিতে তখন চলেছে পালা বদলের পালা। চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে এলেন চিলিতে। অর্থের অভাব নেই। বই বিক্রি বাবদ নিয়মিত অর্থ পাচ্ছেন। বহুদিন ধরে ইচ্ছে ছিল বৈচিত্র্যময় দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণ করবেন। বেশ কয়েক মাস ধরে ঘুরে বেড়ালেন বিভিন্ন দেশে। অপার বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়ে দেখতেন প্রকৃতির ব্যাপ্ত বৈচিত্র্য। পেরুতে এক রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ দেখে লিখলেন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা The Heights of Macchu Picchu. শুধু প্রকৃতি নয়, দেখলেন দক্ষিণ আমেরিকায় বঞ্চিত শোষিত মানুষদের। তাঁর মনে হত এই মানুষদের মুক্তির কথা।
চিলিতে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠেছে। নেরুদা বিশ্বাস করতেন একমাত্র মার্কসবাদই পারে শোষণ বঞ্চনা থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করতে। (১৯৪৫) নেরুদা সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দিলেন। সেই সময় চিলির আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। নেরুদা নির্বাচনে দাঁড়ালেন। কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থনে সিনেটের সদস্য নির্বাচিত হলেন। এর পরেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেন। এবং আমৃত্যু তিনি এই পার্টির সভ্য ছিলেন।
সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর তাঁর লেখার মধ্যেও পরিবর্তন আসছিল। তিনি হয়ে উঠছিলেন সাধারণ মানুষের কবি, শ্রমিক, কৃষক, খেটে খাওয়া মানুষের কবি। তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছিল সমস্ত অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক।
১৯৪৮ সালে চিলির প্রেসিডেন্ট ভিদেলার সাথে প্রত্যক্ষ বিরোধে জড়িয়ে পড়লেন। প্রেসিডেন্ট ভিদেলা ছিলেন স্বৈরাচারী মনোভাবের মানুষ। কমিউনিজমের প্রতি তার ছিল তীব্র ঘৃণা। ইউরোপের বহু দেশের সাথে সম্পর্ক ছেদ করলেন। কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল। বিশ্বস্ত সূত্রে সংবাদ পেয়ে পালিয়ে গেলেন নেরুদা। এই সময় তাঁর সঙ্গী ছিল স্ত্রী দলিয়া। কোথাও বেশি দিন থাকতে পারেন না। এক শহর থেকে আরেক শহরে পালিয়ে বেড়াতে থাকেন। শেষে সীমান্ত পেরিয়ে আর্জেন্টিনায় এসে আত্মগোপন করেন। দলিয়া শুধু যে তার সঙ্গী ছিলেন তাই নয়, সর্ব কাজে ছিলেন প্রধান প্রেরণা। এই স্বেচ্ছানির্বাসিত জীবনেও তাঁর কলম স্তব্ধ থাকেনি। এই পর্যায়ে লেখা ছোট ছোট কবিতাগুলো হাজার হাজার মানুষের মুখে মন্ত্রের মত উচ্চারিত হত।
পলাতক জীবনে কবির পরিচয় হয় চিলির এক তরুণীর সাথে। দুজনের মধ্যে ধীরে ধীরে গড়ে উঠল নিবিড় সম্পর্ক। এই সম্পর্ককে ঘিরেই বিবাদ দেখা দিল দলিয়ার সাথে। দীর্ঘ ১৬ বছরের বিবাহিত জীবনের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল।
চিলির রাজনৈতিক জীবনে পরিবর্তনের ছোঁওয়া আসছিল। নেরুদা চিলিতে এসে স্থানীয়ভাবে বসবাস করতে আরম্ভ করলেন। সমুদ্রের ধারে একটি বাড়ি করলেন। মাঝে মাঝে একাই বেরিয়ে পড়তেন। মাইলের পর মাইল বেলাভূমিতে বেড়াতে বেড়াতে ঝিনুক কুড়োতেন। জেলেদের সাথে গল্প করতেন। সমুদ্রের ঢেউ-এর শব্দ শুনতে শুনতে কবিতা লিখতেন। ছোট ছোট সাধারণ বস্তুই হয়ে উঠেছিল তাঁর কবিতার বিষয়। তাতে কোন আড়ম্বর নেই, আবেগ নেই, অংহকার মুষ্টিমেয় মানুষের গণ্ডির সীমানা থেকে নিয়ে যেতে চাইলেন বৃহত্তর মানব সমাজের কাছে। শুধু চিলি বা স্পেন নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনূদিত হল তাঁর কবিতা।
ডাক এল ইউরোপ থেকে গেলেন রাশিয়া, জার্মানী, ফ্রান্স, ইতালি, ইংলন্ড। সর্বত্র পেলেন অভূতপূর্ব সম্মান আর সংবর্ধনা। রাশিয়া থেকে তাঁকে দেওয়া হল স্টালিন পুরস্কার। দেশে ফিরে আসবার এক বছর পর প্রকাশিত হল পর দুটি কাব্যগ্রন্থ জেনারেল সঙ (১৯৫৪), এলিমেন্টাল ওডস (১৯৫৪)। নেরুদা হয়ে উঠলেন চিলির জাতীয় কবি।
কবিতার মতই কবির জীবনে এল মাতিলদে উরুতিয়া। গভীর প্রেমের জোয়ারে ভেসে গেলেন। জীবনের মধ্য পর্বে আসা এই প্রেমের আবেগে দীর্ঘদিন পর পর আবার প্রেমের কবিতা লিখতে আরম্ভ করলেন। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হল “একশ প্রেমের সনেট” {one hundred love sonnets)। এই কবিতাগুলোর মধ্যে আত্মমগ্নতার সুর প্রবল হয়ে উঠেছে। তারই সাথে মাতিলদে ছিল তাঁর স্ত্রী, সহযোগী, সহকর্মী।
জীবনে খ্যাতি, ঐশ্বর্য, অর্থ, সম্মান, সুখ পেয়েও নিজেকে হারিয়ে ফেলেননি কবি। আত্মজীবনী Isla Negra তে লিখেছেন ছেলেবেলার কথা, চেনাজানা মানুষদের কথা, তেমুকোর কথা যেখানে বৃষ্টির জন্ম হয়। অহল্যাভূমিতে মানুষ কাজ করে, গাছের পাতায় পাতায় শোনা যায় বৃষ্টির শব্দ। গদ্যের ভাষা এখানে কবিতার মতই ছন্দময় হয়ে উঠেছে।
১৯৬৯ সালে আবার সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন। তিনি বিশ্বাস করতেন রাজনীতি আর সংগ্রামই মানুষের মুক্তির পথ। একটি কবিতায় লিখেছেন
“আমাদের সকলেই ঐ এক লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্য ব্যাকুল।
তিক্ত যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে আমরা অর্জন করব দুঃখ-যন্ত্রণার শেষ দিনটি।
সেটিই হবে আমাদের প্রতিপক্ষের বিচারের দিন।
হে আমার সংগ্রামী মৃত ভাইয়ের দল,
স্বাধীনতার উদাত্ত আহ্বানে
তোমরা যেদিন জেগে উঠবে
মৃত্যুর থেকেই ভেসে উঠবে
তোমাদের কণ্ঠস্বর।”
১৯৭০ সালে চিলির রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবার জন্য নির্বাচনে অংশ নিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির তরফে জোরালো প্রচার শুরু হল। বামপন্থী দলের হয়ে একই সাথে নির্বাচনে নামলেন সালভাদার আলেন্দে (Salvador Allende)। আলেন্দ ছিলেন নেরুদার বন্ধু। আলেন্দের প্রতি নেরুদার ছিল গভীর শ্রদ্ধা। বন্ধুর সপক্ষে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিলেন। নির্বাচনে জয়ী হয়ে চিলির প্রেসিডেন্ট হলেন আলেন্দ। শুরু হল এক নতুন যুগ।
নেরুদা রাষ্ট্রদূত হয়ে গেলেন ফ্রান্সে। এক বছর পরেই তার অসাধারণ সাহিত্য সৃষ্টির জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হল (১৯৭১)। চিলির জনগণের পক্ষ থেকে তাঁকে গণ সংবর্ধনা দেওয়া হল। স্বাস্থ্য ভেঙে গিয়েছিল নেরুদার। মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। পরীক্ষায় জানা গেল তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত সব কাজ থেকে অবসর নিয়ে ফিরে গেলেন নিজের বাড়িতে।
চিলির ভাগাকাশে তখন বিপর্যয় শুরু হয়ে গিয়েছে। আমেরিকান সামাজ্যবাদী শক্তি ষড়যন্ত্র শুরু করল। কিভাবে কমিউনিস্ট সরকারকে উৎখাত করা যায়। শুরু হল দেশ জুড়ে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। অসুস্থ নেরুদার কলম শাণিত হয়ে ওঠে। তিনি লেখেন, “আমি কোন সমালোচক বা প্রবন্ধকার নই, আমি সাধারণ এক কবি। তবুও কখনো এমন সময় আসে যখন আমাকে কিছু বলতেই হয়, বিশেষত আর সকলে যখন নীরব হয়ে থাকে, আমি চিৎকার করে দেখিয়ে দিই সেই শত্রুদের যারা যুদ্ধ চায়, যুদ্ধের আগুনে ধ্বংস করে মানুষের সৃষ্টিকে।”
১৯৭৩ সালে দেশ জুড়ে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। ১১ই সেপ্টেম্বর প্রথমে নৌবাহিনী তারপর সৈন্যবাহিনী বিদ্রোহ ঘোষণা করে। রাষ্ট্রপতি ভবন আক্রমণ করে। সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হলেন প্রেসিডেন্ট আলেন্দে। সারা দেশে সামরিক শাসন জারি হল। নিজের গৃহে বন্দী হলেন অসুস্থ মৃত্যুপথযাত্রী কবি। বিছানায় শুয়েই কবি লিখলেন তাঁর শেষ কবিতা।
“নিক্সন ফ্রেই নিকোচেত
১৯৭৩ এই ভয়ঙ্কর সেপ্টেম্বর মাস
……..আমাদের ইতিহাসের
ক্ষুধার্ত হায়নার দল।
আমাদের বিজয় পতাকাকে
ছিন্নভিন্ন করেছে, লণ্ঠন করেছে
নিউইয়র্কের ক্ষুধার্ত নেকড়েগুলো
বেশ্যার দালাল…শুধুই অত্যাচার আর অত্যাচার কোন আইন নেই
শুধু ক্ষুধা আর চাবুক।”
সেই বন্দী অবস্থায় ১২ দিন পর ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ সালে মারা গেলেন কবি। সামরিক শাসনের সমস্ত নিষেধ উপেক্ষা করে পথে বার হল লক্ষ লক্ষ মানুষ কবিকে শেষ শ্রদ্ধা জানাবার জন্য। স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সেই তাদের প্রথম প্রতিবাদ।
তথ্যসূত্রঃ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী – মাইকেল এইচ. হার্ট / সম্পাদনায় – রামশংকর দেবনাথ