অ্যারিস্টটল (Aristotle)

প্রথম পাতা » জীবনী » অ্যারিস্টটল (Aristotle)


অ্যারিস্টটল

অ্যারিস্টটল

(৩৮৫-৩২২খৃ. পূ.)
প্রাচীন গ্রীসের বিশ্বখ্যাত দার্শনিক, বিজ্ঞানী অ্যারিস্টটলের গ্রীক নাম আরিস্তোতেলেস। জন্মেছিলেন ঈজিয়ান সাগরের উত্তর পশ্চিম তীরে চেলিসিডিসের অন্তর্গত স্টেগিরা নামের ছোট্ট এক শহরে। সময়টা খ্রিস্টের জন্মের ৩৮৫ বছর আগে। তার বাবা নিকোমাখুস ছিলেন ম্যাসিড়নিয়ার রাজা অ্যামিনটাসের চিকিৎসক ও বন্ধু। অ্যামিনটাস ছিলেন দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডারের ঠাকুর্দা।

পরিবারের শিক্ষা ও সংস্কৃতির পরিমন্ডলে স্বভাবতঃই শিশু বয়স থেকেই তাঁর জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি প্রবল আগ্রহ জন্মায়।

প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন অ্যারিস্টটল। ফলে অতি অল্প বয়সেই অঙ্ক, বিজ্ঞান ইতিহাস দর্শন প্রভৃতি বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন।

কিশোর বয়সে তিনি মাঝেমাঝেই গিয়ে বসতেন ঈজিয়ানসাগরের ধারে। অশান্ত ঢেউয়ের ভাঙ্গা-গড়া, সমুদ্রের গর্জন শুনতে শুনতে আকাশের সুদূর প্রান্তে হারিয়ে যেত তাঁর ভাবালু দৃষ্টি।

বইতে পড়েছেন নানা দেশের কথা, সভ্যতার ভাঙ্গাগড়ার ইতিহাস, মনীষীদের রোমাঞ্চকর জীবন-কাহিনী ও আবিষ্কারের কথা।

তার মনও এই সময়ে অজানা জগতের রহস্য সন্ধানের স্বপ্ন দেখে, কল্পনায় নানা ছবি আঁকে।

সেই সময় রাজধানী এথেন্স ছিল সমগ্র গ্রীসের জ্ঞানচর্চার পীঠভূমি। বিশ্ববিখ্যাত সব পণ্ডিত সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় রত।

অ্যারিস্টটলের স্বপ্ন তিনিও এথেন্স যাবেন। সমুদ্র বিজ্ঞান ও প্রকৃতিবিদ্যার চর্চায় তাঁর গভীর আগ্রহ–সেখানে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতদের পদপ্রান্তে বসে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করবেন।

বাবার মৃত্যুর পর সতের বছর বয়সে ৩৬৭ খ্রি: পূর্বাব্দে এথেন্সে আসেন।

প্লেটোর লাইসিয়ামের তখন খুব নামডাক। প্রাচীন গ্রীসে মনীষীরা বড় হলঘরে বসে দেশ-বিদেশের ছাত্রদের শিক্ষা দিতেন। অনেকটা আমাদের দেশের প্রাচীন পোবন বা গুরুগৃহের ধারাতেই এথেন্সেও শিক্ষাগুরুরা শিষ্যদের মধ্যে জ্ঞান বিতরণ করতেন।

এই শিক্ষাশ্রমগুলোই লাইসিয়াম নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীকালে লাইসিয়ামেরই নাম হয়েছে আকাডেমী।

মহাজ্ঞানী প্লেটোর লাইসিয়ামটিই পরিচিত ছিল এথেন্স বিশ্ববিদ্যালয় নামে। জ্ঞান এবং অধ্যাপনার জন্য তাঁর খ্যাতি দেশের সীমা অতিক্রম করে বিদেশেও পৌঁছেছিল।

প্লেটো ছিলেন মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের সেরা ছাত্র। নানা বিষয়েই ছিল তার গভীর জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য।

অ্যারিস্টটল প্লেটোর লাইসিয়ামে নাম লেখালেন। এখানে তিনি স্বকীয় রুচিতে ও আচরণে সংশ্লিষ্ট সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন প্লেটোর প্রিয় ছাত্র।

দীর্ঘ কুড়ি বছরে সাহিত্য দর্শন, রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে অঙ্ক জ্যোতির্বিজ্ঞান, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা ও সমুদ্র বিজ্ঞানে ব্যুৎপন্ন হন।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের নানা বিষয়েও শিক্ষা নিয়েছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন প্লেটোর প্রিয় ছাত্র।

প্লেটো তার টাইমেয়াস গ্রন্থে প্রিয়শিষ্য অ্যারিস্টটলের অসাধারণ জ্ঞানের কথা উচ্ছ্বসিত প্রশংসার সঙ্গে লিপিবদ্ধ করেছেন।

এই দুই গুরুশিষ্যের চিন্তাধারার মধ্যে পার্থক্যও ছিল যথেষ্ট স্পষ্ট। প্লেটোর প্রিয় বিষয় ছিল অঙ্ক। ছিলেন কল্পনাবিলাসী। অঙ্ক নিয়ে চিন্তায় বিভোর থাকতেই ভালবাসতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, পৃথিবী গতিহীন এবং স্থির এক গ্রহ।

অন্যদিকে অ্যারিস্টটল ছিলেন বস্তুবাদে বিশ্বাসী। লৌকিক জগতের প্রতিই তার আকর্ষণ ছিল বেশি। সজীব পদার্থ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে চিন্তা করতেই তিনি বেশি ভালবাসতেন।

জীব জগতের অনেক কিছুরই শ্রেণীবিভাগ করেছিলেন অ্যারিস্টটল। সেই যুগে এই বিষয়ে মাথা ঘামাতে অপর কোন বিজ্ঞানীই উৎসাহ বোধ করতেন না।

পৃথিবী অ্যারিস্টটলের দৃষ্টিতে ছিল গতিময়।

মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সেই অ্যারিস্টটলের বিজ্ঞান ও দর্শনের খ্যাতি সমস্ত গ্রীসে ছড়িয়ে পড়েছিল।

৩৪২ খ্রি: পূ: প্লেটোর মৃত্যু হয়। তার পরে আকাঁদেমির চালক অধ্যাপক হতে চেয়েছিলেন অ্যারিস্টটল। কিন্তু এথেন্সের অধিবাসীরা তাঁকে বিদেশী বলেই মনে করত। তাই দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চালক অধ্যাপকের পদটি তার লাভ করা হল না।

এথেন্সে আর থাকতে মন চাইল না। অ্যারিস্টটল তখন এশিয়া মাইনরের অন্তর্গত আতরনিউস নামক শহরে চলে আসেন।

এখানে তাঁর এক সহপাঠী হেরমিআ বাস করতেন। বন্ধুর বাড়িতেই এসে উঠলেন তিনি।

এখানে তিন বছর ছিলেন তিনি। হেরমিআর বোন পুথিয়াকে (Pythia) বিয়ে করে অনেক উপহার লাভ করেন।

ম্যাসিডনের রাজপরিবারের সঙ্গে পিতার সূত্রেই পরিচয় ঘটেছিল অ্যারিস্টটলের। রাজকুমার ফিলিপের সঙ্গে জানাশোনাও ছিল। তাঁর তিনি তখন রাজা হয়েছেন। অ্যারিস্টটলের গুণগ্রাহী ও ভক্তদের মধ্যে রাজাও ছিলেন অন্যতম।

আতরনিউসে থাকার সময়েই অ্যারিস্টটল রাজা ফিলিপের একটি চিঠি পেলেন। রাজা তাঁর বালকপুত্র ফিলিপের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করবার ইচ্ছা প্রকাশ করে অনুরোধ পাঠিয়েছেন।

অ্যারিস্টটল সানন্দে এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন এবং ম্যাসিডনে ফিরে এলেন।

রাজকুমার আলেকজান্ডারের যখন চৌদ্দ বছর বয়স, সেই সময় অ্যারিস্টটল তাঁকে ছাত্র হিসেবে পান। প্রথম দর্শনেই দুজন দুজনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন।

সাতবছর সময়ের মধ্যেই অ্যারিস্টটল রাজকুমার আলেকজান্ডারকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছিলেন।

ভূগোল, ইতিহাস, বিজ্ঞান ও দর্শনে অসাধারণ জ্ঞানার্জন করেছিলেন আলেকজাণ্ডার। গুরুর কাছ থেকে তিনি আরও লাভ করেছিলেন বিশ্বকে জানবার তীব্র পিপাসা।

বিজ্ঞান মনস্কতা, অসামান্য তেজ ও সাহস।

এই আন্তর সম্পদের প্রেরণাতেই একদিন তিনি ঘর ছেড়ে বিশ্বজয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন।

একের পর এক দেশ তিনি জয় করেছেন, সেসব দেশের সভ্যতা ও কৃষ্টির সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। অ্যারিস্টটলের শিক্ষা এভাবেই সার্থকতা লাভ করেছিল শিষ্য আলেকজাণ্ডারের মধ্যে।

খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ অব্দে ম্যাসিডনের রাজা ফিলিপ মারা গেলেন। সিংহাসনে বসলেন আলেকজাণ্ডার। সেই সময় তার বয়স একুশ।

অ্যারিস্টটল চলে এলেন এথেন্সে। এখানে নিজেই একটি লাইসিয়াম খুললেন। শিক্ষাদানের সঙ্গে সঙ্গে চললো তাঁর গবেষণার কাজ। তিনি তাঁর বিদ্যালয়ের নাম দিলেন পেরিপ্যাটেটিক স্কুল।

মৃত্যুর পূর্বে পর্যন্ত রাজা ফিলিপ অ্যারিস্টটলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। আলেকজাণ্ডার রাজা হয়ে পিতার সেই দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন।

অ্যারিস্টটল একবার স্থির করলেন প্রকৃতি বিজ্ঞান সম্পর্কে একটি এনসাইক্লোপিডিয়া রচনা করবেন।

উপাদান সংগ্রহের জন্য এক হাজার সহকারী গবেষক নিযুক্ত করা হল। তারা পৃথিবীর নানাস্থানে প্রেরিত হয়েছিলেন। এ কাজে তিনি অর্থ সাহায্য পেয়েছিলেন রাজকোষ থেকে।

সংগ্রাহকরা ঈজিয়ান সাগরের উত্তর-পূর্ব উপকূলের জল ও স্থলভাগ থেকে, লেমবস দ্বীপ থেকে সংগ্রহ করে আনতো নানা উদ্ভিদ ও প্রাণীর নমুনা। সেসব পাঠিয়ে দেওয়া হত এথেন্সে অ্যারিস্টটলের গবেষণাগারে।

এ্যারিস্টটল এসব নমুনা একে একে শ্ৰেণী ধরে সাজিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেন। এইভাবেই দিনে দিনে জীববিদ্যা ও সমুদ্রবিদ্যার ভূমিপ্রস্তুত হয়ে চলল।

সব মিলিয়ে প্রায় ৫০০ জীবজন্তুর প্রজাতির গঠন ও প্রজনন কৌশল ধরে তিনি শ্রেণীবিন্যাস করেছিলন।

বিভিন্ন প্রাণীর নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবচ্ছেদ করে সেসবের পরিচয় ও কার্যকারিতার ব্যাখ্যাও করেছেন তিনি।

প্রাণী ও উদ্ভিদ বিদ্যা বিষয়ে অ্যারিস্টটলের সিদ্ধান্তই ১৮ শতক পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা অভ্রান্ত বলে মেনে নিয়েছেন।

জীবোৎপাদন ও জীবজন্তুর ওপর নানা বৈজ্ঞানিক বিবরণ নিয়ে তিনি প্রকাশ করেছিলেন হিস্টোরিয়া অ্যানিমিলিয়া বইটি।

বিশ্ববিখ্যাত জীববিজ্ঞানী লিনিয়াস ও কুভিয়ারের আবির্ভাবের পরে উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের নতুন শ্রেণীবিন্যাস সাধিত হয়েছিল। ফলে অ্যারিস্টটলের এই দুই বিভাগে অধিকাংশ কাজ বাতিল বলে গণ্য হয়েছিল।

যুক্তিবাদী অ্যারিস্টটল সকল কার্যেরই কারণ অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যা করতেন যুক্তি দিয়ে। তার এই কার্যকারণ তত্ত্ব নিয়ে রচিত হয়েছিল ন্যায়শাস্ত্রের বই আরগান। এই গ্রন্থের ভিত্তিতে প্রধানতঃ নীতিশাস্ত্রকার রূপেই তিনি বিখ্যাত ও প্রচারিত হয়েছেন বেশি।

বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গবেষণা করে তিনি ১০০০ মত তথ্যনিষ্ঠ বই রচনা করেছেন। তার বেশিরভাগ বইই অবশ্য মহাকালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। যেসব বই রক্ষা পেয়েছে তার অধিকাংশই দর্শন ও নীতিবিদ্যা সংক্রান্ত।

জ্যোতির্বিদ্যা ও পদার্থবিদ্যায় তাঁর যেসব তত্ত্ব রয়েছে তার ভিত্তি দার্শনিক ভাবনার ওপরেই গড়ে উঠেছিল।

তাঁর একটি সিদ্ধান্ত যেমন ভারী ও হাল্কা এই দুই বস্তু ওপর থেকে নিচে ফেলে দিলে দুটিই একসময়ে নিচে পড়বে।

বহু শতক পরে ইতালীয় বিজ্ঞানী গ্যালিলিও পিসা শহরে পরীক্ষা দ্বারা এই তত্ত্ব ভ্রান্ত বলে প্রমান করেছিলেন।

তিনি দেখিয়েছিলেন, বায়ুপূর্ণ স্থানে বায়ুঘাতের জন্য এরকম হতে পারে। কিন্তু বায়ুহীন স্থানে ভারী ও হাল্কা বস্তু একসঙ্গে নিচে ফেললে দুটিই একসময়ে নিচে পড়বে।

অ্যারিস্টটলের মত ছিল, স্থির বস্তুকে ধাক্কা দিয়ে বা বেগ সঞ্চার করে চির গতিময়তা দান করা যায়।

আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে নিউটন অ্যারিস্টটলের এই সিদ্ধান্তটিকে সংশোধন করে প্রকৃত সত্যের ভিত্তিতে আবিষ্কার করেছিলেন তাঁর প্রথম গতিসূত্র।

তিনি প্রমাণ করে দেখান, যে কোন গতিশীল বস্তুরই গতিপথ হয় সরল রেখা ধরে।

অ্যারিস্টটল বিশ্বাস করতেন পৃথিবী গঠিত হেয়ছে ক্ষিতি, অপঃ,তেজ ও মরুৎ এই চারটি মৌলিক বস্তৃদ্বারা। কিন্তু পরবর্তীকালে জানা গেছে পদার্থ সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের সিদ্ধান্তটি ভুল। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ অর্থাৎ মাটি, জল, আগুন ও বায়ু এগুলো কোনটাই মৌলিক পদার্থ নয়।

জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে যথেষ্ট যুক্তি প্রমাণ রেখেছেন অ্যারিস্টটল। কিন্তু পর্যবেক্ষণ পদ্ধতিতে ভুল থাকার জন্য তাঁর সিদ্ধান্তও সঠিক হতে পারেনি। তিনি জানিয়েছিলেন পৃথিবীই হল সৌরজগতের কেন্দ্র। একটি নির্দিষ্ট স্থানে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে গ্রহ ও নক্ষত্রেরা অবিরাম ঘুরছে। চাঁদের আলোকেও তার নিজস্ব আলো বলেই বর্ণনা করেছেন তিনি। বহু শতাব্দী পরে অ্যারিস্টটলের এই সব সিদ্ধান্ত শুধরে দিয়েছেন গ্যালিলিও কেপলার প্রমুখ বিজ্ঞানীগণ।

তারাপ্রমাণ করে দেখিয়েছেন পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ উপবৃত্তাকার পথে ঘুরছে সূর্যকে কেন্দ্র রেখে। দ্বিতীয়তঃ চাঁদের নিজস্ব আলো বলতে কিছু নেই। সূর্যের আলোতেই তার আলোকিত রূপ প্রকাশিত হয় জ্যোছনা হয়ে। চাঁদের ভেতর দিয়ে আসে বলেই জ্যোছনা তাপমুক্ত। প্লেটোর দার্শনিক চিন্তার সূত্র ধরে তাঁর শিষ্য অ্যারিস্টটল যা লিখে রেখে গেছেন, বৈচিত্র্যে ও বিস্তারে তা বিস্ময়কর প্রতিভার পরিচায়ক। রাষ্ট্রনীতি, নাটক, কাব্য, বস্তুবিদ্যা, ভেষজবিদ্যা, মনোবিজ্ঞান, ইতিহাস, তর্কবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, সৌন্দর্যতত্ত্ব, প্রকৃতিবিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র, অলংকার শাস্ত্র, জীববিজ্ঞান ইত্যাদি বহু বিষয়েই অ্যারিস্টটলের জিজ্ঞাসা ছিল অত্যন্ত প্রবল।

ঈশ্বর, রাষ্ট্র ও মানুষ–এই তিনটি বিষয়ে অ্যারিস্টটল নতুন কথা বলেছেন। ঈশ্বর সম্বন্ধে তিনি বলেছেন, ঈশ্বরকে প্রসন্ন করার অভিপ্রায়ের প্রার্থনা ব্যাপারটা মানুষের মুখতাই প্রমাণ করে। মানুষের সুখ-দুঃখ ঈশ্বরকে স্পর্শ করে না। তবে মানুষের সব চিন্তার প্রেরয়িতা ঈশ্বর। ঈশ্বরের চালক নেই, মানুষের আবেগ আছে, হৃদয়বৃত্তির প্রকাশ ঈশ্বরের ক্ষেত্রে থাকতে পারে না।

জগদব্যাপারের নিয়ম অনুসারে মানুষের পরিবর্তন ঘটে, কিন্তু ঈশ্বর অপরিবর্তনীয়। মানুষ ঈশ্বরকে ভালবাসে, ঈশ্বরের ভালবাসা বলে হৃদয়াবেগ থাকতে পারে না।

ঈশ্বরই মানুষের ভাগ্যনিয়ন্ত্রণ করে একথা ঠিক নয়, ঈশ্বর স্বপ্নচারী। বিশ্ব-প্রপঞ্চের মূল শক্তি বা Primal Energy বলতে আধুনিক বিজ্ঞানীরা যা বোঝেন অ্যারিস্টটলের ঈশ্বরও সেই শক্তি-সত্তা। রাষ্ট্র সম্পর্কে তিনি বলেছেন, স্বৈরতন্ত্র, রাজতন্ত্র, দলতন্ত্র (oli garchy), গণতন্ত্র কোন তন্ত্রই দুষ্টের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকেনা। এসবের মধ্যে স্বৈরতন্ত্র নিকৃষ্ট। অ্যারিস্টটল সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মনে করতেন সংবিধান সম্মত শাসন পদ্ধতি বা Constitutional Government। তাঁর মতে শ্ৰেণীতন্ত্র বা Dictatorship of a class স্বৈরতন্ত্রেরই সমকক্ষ।

সাম্যবাদ বা Communism তিনি গ্রহণযোগ্য মনে করতেন না। বলতেন, সাম্যবাদী শাসন ব্যবস্থায় হিংসার আগুন দেশকে ধ্বংস করবে।

দেশের উন্নতি যদি কাম্য হয় তাহলে নিশ্চয় ব্যক্তিগত মালিকানার প্রয়োজন আছে বলে মনে করতেন অ্যারিস্টটল।

তিনি বুঝেছিলেন, প্রবীণদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। বৃদ্ধ এবং প্রজ্ঞরা নির্দেশ দেবে, নবীনেরা তাদের আজ্ঞা পালন করবে। অ্যারিস্টটল বলতেন, শাসনতন্ত্রের একটি প্রধান লক্ষ হবে শিক্ষার উৎকর্ষ সাধন। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের সম্পর্ক বলতে গিয়ে অ্যারিস্টটল খাঁটি মানুষ তাকেই বলেছেন যার নিজে সুখী হবার এবং অপরকে সুখী করবার যোগ্যতা আছে। তিনি বলতেন, দয়া প্রদর্শন মানুষের কর্তব্য, তবে দয়া করা মানে অনুগ্রহ করা নয়। আশু ফল প্রদান না করলেও সৎকর্মের একটা নিজস্ব মূল্য থাকে।

পরনিন্দা, বিদ্বেষ, অপরের ক্ষতিসাধন–এসব প্রবণতা খাঁটি মানুষের থাকতেই পারে না। গ্রিস দেশের প্রাচীন সংস্কৃতি সমগ্র বিশ্বকে চিন্তার মুক্তির সাধনায় প্রেরণা দিয়েছে। এই প্রসেঙ্গ তিনজনের অবদান বিশ্ব মানস অবতন মস্তকে বহন করে চলেছে। এঁরা হলেন সক্রেটিস, প্লেটো আর অ্যারিস্টটল।

প্লেটো তাঁর গুরুর তত্ত্বাবলীর বিচারবিশ্লেষণ লিপিবদ্ধ করেছেন বলেই সক্রেটিসকে আজও আমরা জানতে পারছি।

প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টটলও তেমনই গুরুর তত্ত্ববাদের সূত্র ধরেই অবিস্মরণীয় কীর্তি স্থাপন করে গেছেন।

মহাজ্ঞানী মহাজন অ্যারিস্টটল খ্রি: পূর্ব ৩২২ অব্দে Eubaca-এর অন্তর্গত থালফিস নামক নগরীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

তাঁর প্রধান বইগুলোর ইংরাজি নাম Dialogues, On Monarchy, Alexander, The Custom of Barbarians, Natural History, Organon of The Instrument of Currect Thinking, On the Soul, Rhetoric, Logic, Eudemian Ethics, Physics, Metaphysics Politics, Poetics, 158 Constitutions (including The Constitution of Athens) প্রভৃতি।

তথ্যসূত্রঃ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী – মাইকেল এইচ. হার্ট / সম্পাদনায় – রামশংকর দেবনাথ




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ