প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ(জীবনী)
প্রথম পাতা » জীবনী » প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ(জীবনী)প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ । প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, লেখক ও রাজনীতিক। প্রতিভা সবারই থাকে। তবে একই সাথে অনেক প্রতিভার সমন্বয় খুব কম মানুষের মধ্যে পাওয়া যায়। যাদের মধ্যে এতসব প্রতিভা, মেধা ও গুণের সমন্বয় থাকে তাঁরাই আলোকিত মানুষ । এই আলোকিত মানুষদের মধ্যে অনেকেই আবার তাঁর কর্মগুণে, প্রজ্ঞাগুণে হয়ে উঠেন অনন্য আলোকিত; তাঁরাই হন দেশবরেণ্য বা দেশবিখ্যাত। প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ তেমনই একজন। তিনি বিশেষ কোন ব্যক্তি নন। তিনি যুগ সন্ধিক্ষণের এক নতুন পথের দিশারী, এক যুগ স্রষ্টা, শতাব্দীর অন্যতম ইতিহাস মানব।তিনি এমনই একজন মানুষ, যাঁর পরিধি ও ব্যাপ্তি সুবিস্তৃত ও সুবিশাল। প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ’র নাম জানে না সারাদেশে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বাংলার আকাশে তিনি একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র, যার আলোর ঝিকিমিকি দেশ জুড়ে বিরাজমান-এমনকি দেশের বাইরেও। ইতিহাসের প্রেক্ষাপট বিচার-বিশে]ষণ করলে দেখা যায়, বিশ্বের প্রত্যেক মনীষীর নিজস্ব ভাব ও কল্পলোকে সুন্দর স্বপ্ন ও পরিকল্পনা থাকে, যা তাঁর অনুসন্ধিৎসু অন্তরদ্রষ্টাকে অনুপ্রাণিত করে, উৎসাহ দেয় এবং চলার পথে দুর্জয় শক্তি জোগায়। তাঁদের সেই স্বপ্ন ও পরিকল্পনা সযতনে লালিত-পালিত হতো। কিভাবে ব্যক্তি, সমাজ, দেশ ও জাতির প্রভূত মঙ্গল সাধিত হয়-পরিবেশ, পরিস্থিতি ও সময়ের উপযোগিতার প্রেক্ষিতে তিনি আজীবন সংগ্রামী ও আত্মনিবেদিত ছিলেন। বিজ্ঞজনদের কাছ থেকে, তাঁর একান্ত ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকে এবং তাঁর জীবনালেখ্য ও স্মৃতিচারণ বিষয়ক নানা লেখা পড়ে যতটুকু জানা গেছে, সেই প্রেক্ষিতে বলা যায়, ব্যক্তি হিসেবে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ ছিলেন স্বকীয় স্বাতন্ত্র্যের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে গড়া একজন মানুষ। এতগুলো মানবীয় গুণাবলীর সমাবেশ একজন মানুষের মধ্যে খুব কমই পরিলক্ষিত হয়, যা তাঁর মধ্যে ছিলো। তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরোপকারী, সংবেদনশীল একজন মানুষ। শত কর্মব্যস্ততার মাঝেও তিনি আনন্দকে খুঁজে পেতেন রসময়তায়। তিনি কথা-বাতায়, ভাষা ব্যবহারে ও চাল- চলনে লোকায়ত স্টাইল অনুসরণ করতেন নিতান্ত সাধারণ মানুষের মতো। তাঁর আরবি-ফারসি মিশ্রিত ভাষা ও কথা বলার ঢং মানুষকে কাছে টানা। তিনি জীবন রসিক, স্বল্প ও মিষ্টভাষী, অমিতচারী ছিলেন, তেমনি গল্প বলে মজলিশী আসর বসিয়ে দীর্ঘক্ষণ মানুষকে বিমুগ্ধ রাখতে পারতেন। তিনি নিজে খেতে ভালবাসতেন, তেমনি অন্যকে খাওয়াতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। সকল মানুষকে তিনি ভালবাসতেন (বিশেষ করে শিশুদেরকে বেশি ভালবাসতেন)। ধর্ম, কর্ম, রাজনীতি, সামাজিকতা- সব কিছুর উর্ধ্বে তিনি স্থান দিয়েছেন মানুষকে। তিনি ধর্মপরায়ণ ছিলেন, কিন্তু ধর্মান্ত ছিলেন না। ফলে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন মানুষের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। এ জন্যই মানুষকে ভালোবেসে ইবরাহীম ছিলেন স্নেহপ্রবণ, আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন, বিচক্ষণ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, প্রচারবিমুখ, নিরহংকারী সহজ-সরল মানুষ। জ্ঞানতাপস, শিক্ষাবিদ, সুসাহিত্যিক, সমাজসেবক ও সংস্কারক, রাজনীতিক, আদর্শ শিক্ষক ও শিক্ষানুরাগী-এক কথায় বহুমুখী প্রতিভায় প্রতিভান্বিত ও ঐশ্বর্যমণ্ডিত এই মহামানবের জন্ম ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার বিরামদী (বর্তমানে শাহবাজনগর) গ্রামে। তবে তাঁর পাঠান বংশীয় পূর্ব পুরুষের বসবাস ছিলো টাঙ্গাইলের বাশাইল গ্রামে। ইবরাহীম খাঁ’র ছয় পুরুষ আগে এ বংশীয় দু’ভাই ভূঞাপুরের ফসলকান্দি গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। ইব্রাহিম খাঁর পিতা শাহবাজ খাঁ পরবর্তীতে বিরামদীতে স্থায়ী হন। তিনি আদর্শবান ছিলেন। শরীর ও মনের অসাধারণ জোর ছিলো তাঁর। তিনি ছিলেন আত্মপ্রত্যয়ী ও ধর্মপ্রাণ। বাবা-মার সংসারে ইবরাহীম খাঁ ছিলেন ৬ষ্ঠ। বাড়িতে বড় ভাইয়ের কাছে বাংলা এবং মুন্সীর কাছে আরবি শিক্ষার মধ্য দিয়ে। ইবরাহীম খাঁ’র শিক্ষা জীবনের হাতেখড়ি। ফসলকান্দি পাঠশালা হতে কি প্রাইমারি ও লোকেরপাড়া পাঠশালা হতে উচ্চ প্রাইমারি পাস করেন। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে হেমনগর হাইস্কুল হতে ৫ম শ্রেণি পাস করে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে পিংনা হাই স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে সেখান থেকে ১ম বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেন। ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ হতে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিভাগে এফ.এ, ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার সেন্ট পলস কলেজ (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) হতে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সসহ বি.এ, একই বছরে প্রিলিমিনারি, ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ল-ইন্টার, ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে প্রাইভেট এম.এ পাস করেন এবং ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে আইন শাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করেন। টাঙ্গাইলের করটিয়ার প্রখ্যাত জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নী ওরফে চাঁদ মিয়ার অনুরোধে তাঁর বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত করটিয়া হাফেজ মাহমুদ হাই স্কুলে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৮ নভেম্বর প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তবে এর আগে অর্থাৎ ছাত্রাবস্থায় তিনি দু’বার দুস্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। প্রথমবার ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে ভূঞাপুর মিডল মাদরাসায় মাত্র আড়াই মাস। ২য় বার এফ.এ পরীক্ষা দিয়ে ফল বের হবার পূর্ব পর্যন্ত ময়মনসিংহ জেলা সদরের জাটিয়া মাইনর স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। মাত্র দু’মাস তিনি এ স্কুলে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জজকোর্টে ওকালতি শুরু করেন। কিন্তু ওকালতি ব্যবসায় তাঁর মন টেকেনি। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ওকালতি ব্যবসা করে তারপর বাদ দেন। তাঁর পুনঃআগমনে ওয়াজেদ আলী খান পন্নী যারপর নাই খুশি হন। এরপর ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর উদ্যোগে করটিয়ায় কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন এবং ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে কলেজ প্রতিষ্ঠা হলে তিনি এ কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তৎকালীন আসাম ও অবিভক্ত বাংলায় সা’দত কলেজ মুসলমান প্রতিষ্ঠিত প্রথম কলেজ এবং ইবরাহীম খাঁ ছিলেন প্রথম মুসলিম প্রিন্সিপাল। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৪ নভেম্বর তিনি সরকারের আমন্ত্রনে পূর্ব বাংলায় মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই তিনি কর্মজীবন থেকে অবসর নেন। অবসর জীবনেও তিনি ‘প্রিন্সিপাল’ হিসেবেই সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর নামের সঙ্গে প্রিন্সিপাল’ শব্দটি এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে যে, এর থেকে তাঁকে কিছুতেই আলাদা করা যায় না। ইবরাহীম খাঁ মানেই প্রিন্সিপাল, আর প্রিন্সিপাল মানেই ইবরাহীম খাঁ; বিশেষ্য আর বিশেষণ মিলে একাকার আর কি। দেশেতো অনেক কলেজ হয়েছে, অনেকেই এ সব কলেজে প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এবং অনেকে এখনও করে আসছেন। কিন্তু কারও নামের পূর্বে ‘প্রিন্সিপাল’ বিশেষণটা এমন যথার্থভাবে জুড়ে গিয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। ইবরাহীম খাঁ’র নামের পূর্বে ‘প্রিন্সিপাল’ শব্দটা যথার্থ বলতে হবে এই জন্য যে, তাঁকে শুধু একজন আদর্শ শিক্ষক বললে কম বলা হবে। বরং বলা উচিৎ তিনি একটা ‘গ্রেট ইনস্টিটিউশন’। অন্য দশজন মানুষের মতো তিনি নিজেকে পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখেননি। শিক্ষাব্রতী এই মানুষটি বৃহত্তর মানব সমাজের কল্যাণ ও উন্নয়নে সদা ব্যাপৃত থেকেছেন।
ওয়াজেদ আলী খান পন্নী অর্থাৎ চাঁদ মিয়ার সহায়তায় করটিয়ায় সা’দত কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলেও, বলতে গেলে কলেজকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন ও প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত করে তুলেছেন প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ-ই। তৎকালীন কলেজে ছাত্র জোগাড় করা, ছাত্রদের জায়গীর রাখা ও জায়গীর করে দেয়াসহ সকল দায়িত্ব ছিলো তাঁর উপর। ২২ বছর এ কলেজে প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্বরত অবস্থায় তিনি একক প্রচেষ্টায় কলেজটিকে একটি প্রথম শ্রেণির কলেজে রূপান্ডুরিত করেছিলেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কারণেই বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে করটিয়া সা’দত কলেজের গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছিলো। মফস্বলের একটি কলেজ অথচ এখানে বাংলা, বিহার ও আসামের নানা প্রান্তের শিক্ষার্থীরা এসে ভিড় জমাতো। কলেজকে গড়ে তোলার জন্য তিনি জীবনের শ্রেষ্ঠ ,সময়গুলো এখানে ব্যয় করেছিলেন বলেই তৎকালীন এমন অজপাড়াগাঁয়ে প্রতিষ্ঠিত একটি কলেজ ‘বাংলার আলীগড়’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলো। অবিভক্ত বাংলার অনগ্রসর মুসলিম সমাজকে, পল্লী এলাকার সাধারণ মানুষকে সর্বক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে শিক্ষা ও সংস্কৃতির পরিবেশ নির্মাণে যে অনবদ্য ভূমিকা তিনি রেখেছেন, তাতে তাঁর নামের পূর্বে ‘প্রিন্সিপাল’ বিশেষণটি বিশেষায়িত হয়ে জুড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ’র ঐকান্তিক আজন্ম শিক্ষানুরাগ ও গঠনমূলক উৎসাহ আর অনুপ্রেরণা না থাকলে করটিয়ার বুকে ‘বাংলার আলীগড়’ সৃষ্টি হতো না কোন দিন। শিয়ালডাকা ভূঞাপুরে প্রতিষ্ঠিত হতো না কোন ডিগ্রি কলেজ। ঢাকার বকশিবাজারে বাঙলা কলেজ (যেটি বর্তমানে মিরপুরের কাছে স্থানান্তর করা হয়েছে) প্রতিষ্ঠায় প্রিন্সিপাল মোহাম্মদ আবুল কাশেম, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সাথে তিনিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দীর্ঘদিন এই কলেজ পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। করটিয়া সা’দত কলেজ প্রতিষ্ঠা ও ঈর্ষণীয় সাফল্যের কারণে সমাজের বৃহৎ একটি উপকার হয়েছিলো। করটিয়ার মতো এমন অজপাড়াগাঁয়ে একটি কলেজ যখন টিকে গেলো, তখন এর দেখাদেখি বিভিন্ন জায়গায় আরও অনেক কলেজ প্রতিষ্ঠা করার সাহস পেল অনেকে। প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ প্রচণ্ড উৎসাহ ও সাহস দিয়ে তাঁদেরকে কলেজ প্রতিষ্ঠায় প্রেরণা যোগাতেন। তাঁর পরোক্ষ সহযোগিতায় সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা প্রভৃতি জেলায় কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। শিক্ষা বিস্তার ও শিক্ষা সেবার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি এই মহাপুরুষ। পাশাপাশি সমাজ উন্নয়নে, সমাজ ভাবনা ও সমাজ সংস্কারে যে অবদান তিনি। রেখেছেন তা বলে শেষ করবার নয়। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, জনহিতকর প্রতিষ্ঠান, উন্নত রাস্তাঘাট, হাট-বাজার, অফিস-আদালত ও উন্নত সমাজ কাঠামোতে। প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খা। ঝোঁপঝাড়, হিংস্র শ্বাপদ ও শৃগালের চারণভূমি-আবাসস্থল ঐশ্বর্যমণ্ডিত যে ভূঞাপুরকে আজ আমরা দেখি, এর অন্যতম রূপকার হচ্ছেন। ভুঞাপুরকে তিনি নবজীবন দান করেছেন। এলাকার অজ্ঞ, ভুখা, নাঙ্গা, কৃষক, শ্রমিক, কামার, তাঁতী ও উৎসাহী নারী-পুরুষদের সাহায্যকল্পে তিনি এর পেছনে অর্থ কিলেজসহ প্রতিষ্ঠা করেছেন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। এ ছাড়া এখানে সাব-রেজিস্ট্রার। ও সম্পদ দুটোই ব্যয় করেছেন। ভূঞাপুরকে আদর্শ জনপদে রূপান্ডুর করার জন্য অফিস, কাজী অফিস, পোস্ট অফিস, ফিসারি অফিস, থানা সদর দফতর (যা বর্তমানে উপজেলায় রূপ লাভ করেছে), দাতব্য চিকিৎসালয়, টেলিগ্রাম অফিসসহ বিভিন্ন অফিস প্রতিষ্ঠায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ভূঞাপুরবাসীও তাঁর এ জনসেবামূলক কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ভূঞাপুর কলেজের নাম পাল্টে ‘প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ মহাবিদ্যালয়’ রাখা হয়েছে। পাঠাগারটির নামকরণ করা হয়েছে তাঁর নামে। যে কীর্তিমান মানুষটির অবদানে ভূঞাপুরবাসী হয়েছে স্নিগ্ধতায় অভিষিক্ত তাঁর সেই অবদানের মূল্যায়ন তো করতেই হয়।
জনসেবক, সমাজসেবক হিসেবে তিনি কতটুকু আত্মনিবেদিত ছিলেন, সে বিষয়ে বর্ণনা দিতে গিয়ে তাঁর নাতনী জামাই- দেশের প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক ও জনপ্রিয় লেখক, চলচ্চিত্রকার ও নির্মাতা হুমায়ুন আহমেদ বলেছেন, প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ’র বাড়ির নাম ‘দখিন হাওয়া’। নাম শুনলেই মনে হয় সারাক্ষণ উথাল-পাতাল হাওয়া বইছে। আসলে কিন্তু সে রকম নয়। মূলত তাঁর বাড়ির দখিন দরোজা ছিলো সব সময় সবার জন্য খোলা। যেই আসে তাকেই হৃদয় খুলে অভ্যর্থনা। বিনীত ভঙ্গিতে আহ্বান “কি করতে পারি আপনার জন্য?” বিনা প্রয়োজনে তাঁর কাছে বাড়িতে কেউ কোন দিন আসেনি। বেশির ভাগই আসতো সাহায্যপ্রার্থী। দরিদ্র ছাত্র, বেতন দিতে হবে; পরীক্ষার ফিস দিতে হবে; জীবন ধারণ করতে পারছে না। স্কুল- কলেজের ব্যাপারে সাহায্যপ্রার্থীর সংখ্যা ছিলো বেশি। অমুক স্কুল মঞ্জুরী পাচ্ছে না, অমুক কলেজের ফান্ডে টাকা নেই, অমুক জায়গায় নতুন কলেজ হবে-তিনি গিয়ে বক্তৃতা দিলে বড় ভালো হয়, মেয়েদের স্কুল দেয়া হবে-এতে অনেকে বিরোধিতা করছেন, আপনি গিয়ে যদি একটু দেখেন…. ইত্যাদি নানা বিষয়ে। কেউ সাহায্য চেয়ে তাঁর কাছ থেকে খালি হাতে ফিরে গেছে-এমন অপবাদ তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রুও দিতে পারবে না।” ভূঞা? ও করটিয়ার মধ্যেই তাঁর সেবার পরিসর সীমাবদ্ধ ছিলো না। বলা যায়, তিনি ছিলেন সমগ্র বাংলাদেশের সেবক। আন্তর্জাতিক পরিসরেও তাঁর সেবার হাত বিস্তৃত রয়েছে। তরুণ বয়সে তিনি খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে স্বদেশিকতায় দীক্ষিত হয়েছিলেন। বাল্যকালে দেখেছেন সাধারণ চাষী রায়তের উপর জমিদার ও ধনী মহাজনদের জুলুম অত্যাচারের নানা দৃশ্য। বিশেষত দরিদ্র চাষী মুসলমানের দুঃখ-দুর্দশায় তিনি ছিলেন প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তাই এদের দুঃখ-দুর্দশা দূরীকরণের জন্য তিনি জমিদার ও মহাজন বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। তরুণ বয়সে বলকান যুদ্ধের সময় বিপন্ন তুরস্কের সাধারণ মানুষদের সাহায্যার্থে চাঁদাতুলে তুরস্কে পাঠিয়েছিলেন। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক হিংসা-বিদ্বেষবশত সংঘটিত দাঙ্গায় প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে যাতে শাম্ডি বজায় থাকে তার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। এর জন্য বারবার তাঁকে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এমনকি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন বারবার, তবে বেঁচে গেছেন কপালের জোরে।
শর্তহীন সমাজ ভাবনা, সামাজিক কল্যাণকর্ম, আত্মোৎসর্গ, সমাজের আধমরা মানুষদের ও ঘুমন্ত সমাজকে জাগিয়ে তোলা, তাদের উৎসাহিত, অনুপ্রাণিত এবং উদ্বুদ্ধ করার মধ্য দিয়ে এক আলোকিত সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিলো তাঁর মূল ধ্যান জ্ঞান ও সাধনা। যত দিন তিনি জীবিত ছিলেন ততদিন সমাজহিতৈষী কর্মকাণ্ড আর ভাবনা চিন্তায় দিন অতিবাহিত করে গেছেন।
তিনি সামাজিক কল্যাণার্থে রাজনৈতিক অঙ্গনেও পদার্পণ করেন। এ পথেও তিনি তাঁর মেঘা ও প্রতিভার দ্বারা সফলকাম হন।১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের নিখিল ভারত মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে ‘পাকিস্সন’ প্রস্তাব গৃহীত হয়। তদানীন্তন বাংলার মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভার প্রধান এ. কে ফজলুল হক। পাকিস্তান প্রস্তাবের যৌক্তিকতা বুঝাবার জন্য জিন্নাহর নেতৃত্বে দিল্লিতে মুসলিম লীগের যে বিরাট কনভেনশন অধিবেশন হয়, তাতে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম প্রমুখ নেতার সাথে যোগদান করেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলার প্রাদেশিক আইনসভা এবং ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মুসলিম লীগ দলের সদস্য হিসেবে আইন পরিষদে প্রবেশ করে তিনি জাতীয় কল্যাণকর নানা কাজ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পুরস্কার স্বরূপ একবার তুরস্কের ইস্তাম্বুলে আন্তঃপার্লামেন্টারি সম্মেলনে যোগ দেবার সুযোগ পান। এ উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র, সিরিয়া, লেবানন, মিসর, আরব, ইরাকসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র ভ্রমণের সুযোগ লাভ করেন। এ ছাড়া একবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানের অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। দেশের খিলাফত, অসহযোগ, মুসলিম লীগ, রায়ত ও পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে বিভিন্ন পত্রিকায় বিবৃতি প্রকাশের মাধ্যমে রাজনীতি থেকে অবসর নেন তিনি। তিনি ছিলেন মনে-প্রাণে একজন সংগঠনপ্রিয় মানুষ। সেই সাথে সফল সংঠকও বটে। তিনি নিজেও অনেকগুলো সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি যখন কলকাতা সেন্ট পলস কলেজে বি.এ পড়তেন তখন তাঁর কিশোরগঞ্জের সহপাঠী ও বন্ধু রোকন উদ্দিন আহমদকে সঙ্গী করে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘ময়মনসিংহ মুসলিম ছাত্র সমিতি’। ময়মনসিংহ জেলা হতে আগত গরীব মুসলিম ছাত্রদের জন্য জায়গীর করে দেয়া এবং আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা করা ছিলো এ সমিতির উদ্দেশ্য। এ সমিতি থেকে সাহায্য প্রাপ্তদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের এক কালের প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীন এবং ময়মনসিংহ জেলা বোর্ডের এককালীন চেয়ারম্যান খান বাহাদুর শরফউদ্দীন আহমদ অন্যতম। ইবরাহীম খাঁ ময়মনসিংহে গঠন করেন। আল হেলাল সাহিত্য সমিতি’। করটিয়া
সা’দত কলেজকে কেন্দ্র করে একটি সাহিত্য পরিমণ্ডল গড়ে ওঠেছিলো এবং এ পরিমণ্ডলের মধ্যমণি ছিলেন প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ। এখানে পড়াতে ও পড়তে এসে যাঁরা সাহিত্য চর্চা করেছেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই বাংলা সাহিত্যে সুপরিচিত। প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে বড়দের সাহিত্য চর্চার জন্য ‘মহুয়া মজলিশ’ প্রতিষ্ঠা করেন। ‘মহুয়া মজলিশ’-এর সাহিত্য আলোচনা, প্রবন্ধ ও কবিতা পাঠসহ বাংলায় মোশায়েরার ব্যবস্থা করা হয়। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের মধ্যে যাতে সাহিত্য প্রতিভা সৃষ্টি করা যায়, তার জন্য ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন
‘টাঙ্গাইল মাহফিল’, যা বর্তমানে ‘টাঙ্গাইল জেলা সমিতি’ হিসেবে সুপরিচিত। তিনি লেখক সংঘের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে গণচীনে সফর করার সুযোগ পান এবং দলের নেতৃত্বের দায়িত্ব ছিলো তাঁর উপর। এ ছাড়া শিক্ষা-সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের
সদস্য হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়া মাইনরের কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেন। সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনের নানামুখী কর্মকাণ্ডে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সাহিত্য চর্চা ছিলো তাঁর প্রিয় অনুষঙ্গ। সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যেখানে তাঁর বিচরণ
ছিলো না। নাটক, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, জীবনী, ভ্রমণ কাহিনী, শিশুদের জন্য লেখা, ধর্মীয় রচনা, পত্র লেখা, স্মৃতিকথা থেকে শুরু করে সাহিত্যের সব শাখাতেই স্বচ্ছ সমাজ ভাবনা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক চিন্তা চেতনা, সংস্কার ও সমন্বয়বাদী মনোভাব এবং সর্বোপরি একটা সগৌরব বাঙালি মানসলোক নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়। সাহিত্যে মানবতাবাদী চিন্তানায়ক ছিলেন তিনি। তাঁর আত্মকেন্দ্রিক রচনাগ্রন্থ ‘বাতায়ন’-এ বলেছেন ‘সাহিত্যকে বড় লোকের ইমারতের সামগ্রী না করে আমি দীনহীন দরিদ্র জনতার দরবারে কিছু কিছু খবরাখবর দেবার কোশেশ করেছি।” সে যুগের ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র পত্রিকা, ‘সওগাত’ ‘মোহাম্মদীয়া’র পৃষ্ঠায় এবং আরও অন্যান্য পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রবন্ধ, নাটক, গল্প প্রকাশ হয়েছে একাদিক্রমে। বড়-ছোট সবার জন্যই তিনি লিখেছেন এবং এ জন্যই সকলের মন জয় করেছেন অনায়াসে। ছোটদের জন্য লিখেছেন রূপকথা, নাটিকা, জীবনী ও ছড়া। তন্মধ্যে ‘নীল হরিণ’, ‘তুর্কি উপকথা’, ছেলেদের শাহনামা’, ‘জঙ্গী বেগম’, ‘নিজাম ডাকাত’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। শিশুদের জন্য মহাপুরুষদের জীবনকথা’র মধ্যে ‘বাবর’, সালাউদ্দিন’, ‘আমাদের মহানবী’, ‘ওমর ফারুক’, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। শিশুরা এসব লেখা পড়ে যেন আনন্দ ও শিক্ষা দুটোই পায়, এই ছিলো তাঁর লক্ষ্য। বড়দের জন্যেও তাঁর রচনার পরিমাণ ও বিষয়বৈচিত্র্য যথেষ্ট। তন্মধ্যে-’মনীষী মজলিশ’, গল্পদাদুর আসর’, ‘মানুষ’, ‘ওস্তাদ’, ‘পাখির বিদায়’, গল্পগ্রন্থগুলো উল্লেখযোগ্য। উপন্যাস লিখেছেন একটি নাম ‘বৌ বেগম’, গ্রাম্য জমিদার পরিবারের এক তেজস্বিনী মহিলার অসামান্য জীবন কাহিনী এটি। নাটক রচনার মধ্য দিয়ে তিনি মুসলমান সমাজের একটি বড় অভাব পূরণ করেছেন। মুসলমান সমাজ নাট্য রচনা ও নাট্যাভিনয়ে খুবই অনগ্রসর ছিলো। ইবরাহীম খাঁ-ই মুসলমান জীবনাশ্রয়ী নাটক লিখে মুসলমান সমাজে নাট্যচর্চার প্রেরণা জুগিয়েছিলেন। তাঁর রচিত নাটকগুলোর মধ্যে কামাল পাশা’, ‘আনোয়ার পাশা’, ‘কাফেলা’, ‘ঋণ পরিশোধ’, ‘ভিত্তি বাদশা’, ‘মায়ের বুলি’ উল্লেখযোগ্য। নাটকগুলো এত জনপ্রিয় ছিলো যে, গ্রাম বাংলায় বার বার অভিনীত হয়েছে। বিশেষ করে খিলাফত আন্দোলনের পটভূমিতে তাঁর রচিত কামাল পাশা’ ও ‘আনোয়ার পাশা’ সে যুগের তরুণদের মধ্যে প্রচণ্ড আবেগের সঞ্চারকরেছিলো বলে জানা যায়। তাঁর রচিত ভ্রমণ কাহিনীগুলোও বর্ণনাগুণে অত্যন্ত উপভোগ্য। তন্মধ্যে-’ইস্তাম্বুল যাত্রীর পত্র’, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের পথে-ঘাটে’, নয়াজগতের পথে’ ‘নয়াচীনে এক চক্কর’ উল্লেখযোগ্য। ইসলামের আদর্শে তিনি ছিলেন আমূল শ্রদ্ধাশীল। আর তাইতো সাহিত্য সাধনায়ও তিনি মুসলিম ঐতিহ্য ও মুসলমানের গৌরব তুলে ধরতে কার্পণ্য করেননি। ইসলামিক ভাবধারায় রচিত ‘ইসলামের মর্মকথা’ প্রবন্ধে তিনি ইসলামের প্রকৃতি ও সকল মানুষের জন্য এই ধর্মের কল্যাণকামিতার বিষয় পর্যালোচনা করেছেন।মানুষের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়’, ‘ইসলাম ধর্মে বৈরাগ্য নেই, সংসারে থেকে পরিবার পরিজন নিয়ে জীবন যাপন করে আল্লাহকে স্মরণ করাই ইসলামের আদর্শ’। এই প্রবন্ধে মহানবীর অমিয়বাণী ও কোরআনের চিরন্তন প্রচারণীই হচ্ছে মূল প্রতিপাদ্য। ধর্ম বিষয়ক তাঁর গ্রন্থগুলোর মধ্যে-‘মহানবী মুহম্মদ’, ‘ইসলাম সোপান’ ও ‘বাংলায় ছোটদের মিলাদুন্নবী’ উল্লেখযোগ্য। সমাজ ও শিক্ষা বিষয়ক রচনার মধ্যে রয়েছে ‘আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা’, ‘ইসলামের মর্মকথা’ ইত্যাদি। যুদ্ধ বিষয়ক রচনারমধ্যে রয়েছে- ‘খালেদার সমর স্মৃতি’ ও ‘জঙ্গী জীবন’। এ ছাড়া বিদেশী ভাষা থেকে অনুবাদ করেও অনেক লেখা তিনি পাঠককে উপহার দিয়েছেন। যেমন- ‘সূর্যি মামার রথে’, ‘আরব জাতি’, ‘চেঙ্গিস খাঁ’, আইনস্টাইন’, ‘বরফের দেশে’, ‘সিন্দাবাদ জাহাজী’, ‘বাবরের স্মৃতিকথা’ ইত্যাদি। রম্য রচনায়ও তিনি বেশ পারদর্শী ছিলেন। ব্যঙ্গ ও ভাবের পরিমণ্ডলে হাস্য-কৌতুক উপস্থাপন করে আসল আলোচ্য বিষয়টি সুন্দরভাবে তুলে ধরতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। এ জাতীয় রচনার মধ্যে আলু বোখারা’ অত্যন্ত আনন্দদায়ক। তিনি তাঁর আত্মজীবনীমূলক বিশাল গ্রন্থ ‘বাতায়ন’- এও রম্যরস ও কৌতুকে বৈষয়িক বৈচিত্র আনতে চেষ্টা করেছেন। তাঁর অধিকাংশ লেখা বাংলাতে রচিত হলেও ইংরেজিতেও বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য রচনা তিনি লিখে গিয়েছেন। তন্মধ্যে- ‘Anecdotes From Islam, Gleanings in Golden Field, To my students, A Peet into our Rebel Poet’ উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে Anecdotes From Islam বইটি দেশ-বিদেশে সমাদৃত হয়েছে। শোনা যায়, ইন্দোনেশিয়ার উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বইটি পাঠ্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলো। ব ভিন্নধরনের রচনার পাশাপাশি তিনি বেশ কিছু পাঠ্যবইও রচনা করেছিলেন। তন্মধ্যে- ‘সুনীতি-সোপান’ ও ‘সুনীতি কুসুম’ স্কুলপাঠ্য রচনা হিসেবেএককালে খুবই সমাদৃত হয়েছিলো। বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে দীপ্ত পদচারণা ছিলো তাঁর। সমাজসেবায় রেখেছেন অসামান্য অবদান এবং সাহিত্যে রেখেছেন অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর। এ সকল কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতিস্বরূপ অনেক পদক, সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। শিক্ষা বিস্তার ও সাহিত্য সাধনা এই বিবিধ কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশ সরকার কর্তৃক ‘খান বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত হন। তবে পরাধীন দেশে এই খেতাব তিনি গ্রহণ করেননি এবং ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে তা বর্জন করেন। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মার্চ পূর্ববঙ্গ সাহিত্য সংসদ তাঁকে বিশেষ সংবর্ধনা প্রদান করে। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান কর্তৃক ‘তঘমা-এ কায়েদে আজম’ খেতাব পান, তবে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ সে খেতাব বর্জন করেন। সাহিত্য সেবার পুরস্কার হিসেবে বাংলা একাডেমি কর্তৃক নাট্য সাধনার স্বীকৃতিমূলক আর্থিক পুরস্কার ও সনদ লাভ করেন ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদের পক্ষ থেকে বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে জাতীয়ভাবে সংবর্ধিত হন। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘২১-শে পদক’-এ ভূষিত হন। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে কায়কোবাদ সাহিত্য মজলিশ’ কর্তৃক গণ সংবর্ধনায় অভিষিক্ত হন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে টাঙ্গাইলের বড় বাশালিয়া গ্রামের রঈস মমতাজ উদ্দিন খাঁ ওরফে নয়া মিয়ার কনিষ্ঠ কন্যা আনজুমননেছার সঙ্গে শুভ পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। সংসার জীবন তাঁদের প্রথম দিকের একটি সন্তান আতুড় ঘরেই মারা যায়। প্রথম পুত্র শামসুজ্জামান খাঁ তুলা মিয়া আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ পড়াকালীন মৃত্যুবরণ করেন। দ্বিতীয় পুত্র আসাদুজ্জামান খাঁ সুজা মিয়া বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক। একমাত্র কন্যা বেগম খালেদা হাবিব একজন সমাজসেবী, শিক্ষাবিদ এবং তিনি পাকিস্তান পার্লামেন্টের দু’বার এম.পি.এ ও পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছেন। তৃতীয় পুত্র আমিনুজ্জামান খাঁ (আমিন) ভূঞাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন, তিনি বর্তমানে বিলেতে বসবাসরত। প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ আজ আমাদের মাঝে নেই। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনন্য সাধক, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবক-এক কথায় বহুমুখী প্রতিভার সমন্বয়ে গড়া অনন্য অসাধারণ মানুষটি পরিবার পরিজন, অগণিত ছাত্র-ছাত্রী, ভক্ত অনুরাগী, শুভাকাঙ্ক্ষীকে শোকসাগরে ভাসিয়ে ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মার্চ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ভূঞাপুরস্থ ইবরাহীম খাঁ মহাবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে স্ত্রীর কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন এই মহাপুরুষ।