রাজিয়া মজিদ

প্রথম পাতা » জীবনী » রাজিয়া মজিদ


রাজিয়া মজিদ
সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবক
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সাহিত্যের বিভিন্ন ধারায় যে সব নারী নানা পেশায় নিয়োজিত থেকে সাহিত্য ও সমাজসেবায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন রাজিয়া মজিদ তাদের মধ্যে অন্যতম। বহুমাত্রিক এই প্রতিভাধর ব্যক্তি শিক্ষকতার পাশাপাশি সাহিত্য ক্ষেত্রে যেমন অবদান রেখেছেন, তেমনি স্বাধীনতা যুদ্ধের ক্ষেত্রে তার অবদান অনন্যসাধারণ। দশ বৎসর বয়স থেকে পয়ষট্টি বছর পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন এবং একাগ্রচিত্তে সাহিত্য চর্চায় মগ্ন আছেন। তার কালজয়ী রচনাসমূহ আমাদের সমাজ জীবনের অন্বেষার মহৎ ছবি। কি শৈল্পিকগুণে কি বৈচিত্রের বর্গে, কি অভিজ্ঞতায় বিশাল ভাণ্ডারে সমৃদ্ধ করেছেন আমাদের বাংলা সাহিত্যকে। ১০ বছর বয়স থেকেই যখন লেখালেখির হাতেখড়ি তখন থেকেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশ হতে থাকে। তার প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় আজাদ পত্রিকায়। রাজিয়া মজিদের জন্ম ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুরে। পিতা প্রফেসর আব্দুস সবুর সিদ্দিকী। মাতা কামরুননেসা। প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি ফরিদপুর হালিমা জুনিয়র মাদ্রাসা থেকে। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুর হালিমা জুনিয়র মাদ্রাসা থেকেই পঞ্চম শ্রেণি পাস করেন এবং অবিভক্ত বাংলার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে তৃতীয় স্থান অধিকারসহ সরকারি বৃত্তি ও স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে ঈশান ইনস্টিটিউট, ফরিদপুর হতে লেটারসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে ল্যাঙ্গুয়েজে মেরিট প্রথম স্থান অধিকার ও মারহাবা পুরস্কার প্রাপ্ত হন। লেডিবাবোর্ন কলেজ, কলকাতা থেকে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিভাগে আইএ পাস করেন। একই কলেজ থেকে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে বিএ পাস করেন। ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে ১৯৫০-৫১ খ্রিস্টাব্দেগিতে বিটি পাস করে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। ১৯৪৯ স্টাব্দে আপওয়া, ফরিদপুর জেলা সম্পাদক হন। ১৯৫১-৫৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষা স্পেশালিস্ট হিসাবে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে শিক্ষা বিভাগে যোগদান করেন। ১৯৫৫-৬১ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২-৬৭ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষাণালয়, খুলনা বিভাগীয় সহকারী স্কুল পরিদর্শক হন। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দেবিভাগীয় গার্লস গাইড খুলনার বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে ছিলেন। মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা সমিতির সভাপতি ১৯৬৩-৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। খুলনা সরকারি গার্লস হাইস্কুল বয়বা- এর প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন ১৯৬৭-৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা বিদ্যালয়, ময়মনসিংহে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন ১৯৭০-১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। কামরুন্নাহার সরকারি বালিকা বিদ্যালয়, ধানমণ্ডি, ঢাকায় ১৯৭৬-৮২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২-৮৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে শেরেবাংলানগর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৮২-৮৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারি শিক্ষক ফেডারেশনের সহসভাপতি ছিলেন। এসব দায়িত্ব থেকে বর্তমানে তিনি অবসর গ্রহণ করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে বিশিষ্ট রাজনীতিক ও সমাজসেবী এস এমআহমেদ মজিদ এমএনএ-এর সহধর্মিণী ও এক কন্যার জননী। মেয়ে বর্তমানে আমেরিকাতে বসবাসরত। তিনি সাহিত্য জীবনে প্রবেশ করেন ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ থেকে। মাত্র ১০ বছর বয়সে লেখিকা জীবন শুরু হয়। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ হতে কোলকাতার ইত্তেহাদ পত্রিকায় আগুনের ফুলকি ও পরে বড়দের পাতায় এবং বেগম পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকায়ও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতে তার লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। তিনি টেলিভিশন এবং রেডিওতে নাট্যকার ও পেনশন’ ছায়াছবির কাহিনিকার হিসেবে বহুল পরিচিত। তার অজস্র লেখার মধ্যে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গল্প, উপন্যাস গবেষণাধর্মী, ভ্রমণকাহিনি রয়েছে। উপন্যাসমূহ হল- দিনের স্বপ্ন ১ম সংস্করণ ১৯৬৭, তমসা বলয় ১৯৬৬, নক্ষত্রের পতন ১৯৮২, সেই তুমি ১৯৮৪, মেঘে জল তরঙ্গ, অশাঙ্কিনী সুদর্শনা ১৯৮৪, দিনের আলো রাতের আঁধার ১৯৮৪, এই মাটি এই প্রেম ১৯৮৫, দাঁড়িয়ে আছি একা ১৯৮৭, সুন্দরতম ১৯৮৮, অরণ্যে জনতা ১৯৮৭, অন্তরলোকে জ্বলে জোনাকি ১৯৯৬, (জীবনীমূলকউপন্যাস)। বৃষ্টি ভেজামুখ, যুদ্ধ ও ভালবাসা- ১৯৯৬, আঁধারে প্রদীপ জ্বলে (১৯৭২ ১ম সংস্করণ) শিক্ষামূলক উপন্যাস- শতাব্দীর সূর্যশিখা ১ম খণ্ড- ১৯৮৪, ঐতিহাসিক উপন্যাস- জ্যোৎস্নার শূন্য মাঠ ১৯৮৯, শতাব্দীর সূর্য শিখা (২য় খণ্ড ১৯৯৫), দোলা ২০০৩, উপন্যাসের সংকলন ২০০৫, কালো মেঘ। আগুন নীল আকাশ নীল উপন্যাস বেগম পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সূর্য তমসা ১৯৭৯, রং ফেরানোর পালা ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে বেগম পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। মহাসাগরের মহাদেশ ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিরোধ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এটি তার বিখ্যাত ভ্রমণ কাহিনি। তার অনেক ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে যেমন- আকাশে অনেক রং ১৯৭৯, রাজিয়া মজিদের সেরা গল্প-২০০০, রাজিয়া মজিদের সেরা গল্প সংগ্রহ ১৯৯৮, ফুলে ফুলে সৌরভ- ২০০৯, The girl in Love - ২০০৮, রাজিয়া মজিদের গল্প সংগ্রহ-২০০২, ভালবাসার সেই মেয়েটি ২য় সংস্করণ, কাঠুরিয়ার মেয়ে- শিশুদের ছোট গল্প, সিন্দাবাদ কিশোরদের ছোট গল্প। তার ভ্রমণ কাহিনি গ্রন্থও রয়েছে। যেমন করাচীর চিঠি ১ম সংস্করণ, ২য় সংস্করণ (১৯৮৬ ৩য় সংস্করণ) মক্কা মদিনা ঘুরে এলাম ১৯৮৪, এক মহান কর্মবীর (১৯৮০ জীবনী), মহানবীর মহাগুণ ১৯৮২, (মহানবীর জীবনী), সোনার মেয়ে রূপবতী (জীবনী) ময়েজ মঞ্জিলের সোনার ছেলে ১৯৮৭ (জীবনী) ইতিহাস কথা বলে ১৯৮৯ (ভ্রমণ কাহিনি), মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কেও তিনি প্রচুর ছোট গল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তার আত্মত্যাগ অবিস্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অন্যত্র চলে যাওয়ার পরে ফিরে এসে মুক্তি যোদ্ধাদের অনেকের স্ত্রী এবং সম্পনকে রাজিয়া মজিদ নিজের জীবন বিপন্ন করে নিজগৃহে আশ্রয় দান করেছেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যাওয়ার জন্য সাহায্য করেছেন। প্রতিকূল পরিবেশে তিনি তার বিদ্যালয়ে কিছুদিনের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং নেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। সাহিত্য সমাজসেবা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের স্বর্ণপদক লাভ। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে একুশে পদকে ভূষিত হন। কবি জসিম উদ্দিন স্বর্ণপদক লাভ করেন ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে। উপন্যাসে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠচক্র পদক পান। অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী হিসেবে জাতীয় সাহিত্য সংসদ পদক ২০১০ খ্রিস্টাব্দে ও আল্পনা প্রকাশনী থেকে ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে শ্রেষ্ঠ উপন্যাসিক পদক পান। বেগম পত্রিকা সম্মাননা ২০০৫ লাভ করেন।




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ