মুস্তাফা জামান আব্বাসী

প্রথম পাতা » জীবনী » মুস্তাফা জামান আব্বাসী


মুস্তাফা জামান আব্বাসী

বহুমাত্রিক সঙ্গীতজ্ঞ ও লেখক

মুস্তাফা জামান আব্বাসী বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব। কণ্ঠশিল্পী-সুরকার-গীতিকার-সঙ্গীত পরিচালক-প্রবন্ধকার-ঔপন্যাসিক-গবেষক- সম্পাদক-সংগ্রাহক-                                                                                                  উপস্থাপক-সমাজসেবক- ব্যবসায় নির্বাহী। মোস্তফা জামান আব্বাসী উপমহাদেশের এক প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিবারের সন্তান। পিতা আব্বাস উদ্দীন আহমেদ পল্লীগীতি সম্রাট। ইসলামী গান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি ইত্যাদি সঙ্গীত সাধনায় তিনি ছিলেন অনন্য সাধারণ শিল্পী। এদেশের পল্লীসঙ্গীতকে তিনিই প্রথম বিশ্বের দেশে দেশে জনপ্রিয় করেছেন। তার সুরেলা সঙ্গীতে মুগ্ধ হয়েছেন মহাচীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইসহ বিশ্ববরেণ্য অনেক রাষ্ট্রনায়ক। চাচা আব্দুল করিম ছিলেন পল্লীগীতি ও ভাওয়াইয়া ভাটিয়ালি গানের জনপ্রিয় শিল্পী। বড় ভাই বিচারপতি মোস্তফা কামাল দেশবরেণ্য আইনবিশারদ হলেও সঙ্গীত-সংস্কৃতির সমজদার মোস্তফা কামালের কন্যা নাশিদ কামালও একজন বরেণ্য শিল্পী। বোন ফেরদৌসী রহমান দেশের প্রথিতযশা বহুমাত্রিক প্রতিভার সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে সমাদৃত। মোস্তফা জামান আব্বাসী ভারতের কোচবিহার জেলার বলরামপুর গ্রামে ৮ ডিসেম্বর ১৯৩৬খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব ও কৈশোর কাল কলকাতায় কাটে। এই পরিবারটির সাথে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অত্যন্ত ঘনিষ্টতা ছিল। মোস্তফা জামানের শিক্ষাজীবন কলকাতায় শুরু হয়। তিনি ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স এবং ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে এমএ পাস করেন। তিনি সঙ্গীতসাধনা ও সাহিত্যচর্চায় নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। সঙ্গীত বিষয়ক গবেষণাতেও তিনি সিদ্ধহস্ত। তিনি বেতার ও টেলিভিশনে সঙ্গীতবিষয়ক অনেক অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন। পত্র-পত্রিকাতে তিনি একজন সুখপাঠ্য কলাম লেখক হিসেবেও সুপরিচিত। তার রচিত দৈনিক প্রথম আলোর ‘গোধূলির ছায়াপথে’ কলামটি বেশ পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে। গণকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স ও এমএ, হার্ভার্ড গ্রুপ থেকে মার্কেটিং অধ্যয়ন, দীর্ঘদিন শিল্পগোষ্ঠীর মহা-ব্যবস্থাপক, ব্যবসা সফল ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক। কণ্ঠশিল্পী সুরকার গীতিকার ও সঙ্গীত পরিচালক মুস্তফা জামান আব্বাসীর সফল উপস্থিতি দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর রেডিও টেলিভিশন রেকর্ড ও ফিল্মে। পঁচিশটি দেশে ভাটিয়ালি, বিচ্ছেদী, ভাওয়াইয়া, চটকা, নজরুলগীতি পরিবেশন করে খ্যাতি অর্জন করেন। দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব ও সঙ্গীত পরিবেশন করেন। ইউনেস্কোর ছত্রছায়ায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিটি অব মিউজিকের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এগার বছর, একাধিকবার বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন সঙ্গীতজ্ঞদের বিশ্ব অধিবেশনে। ‘মাহরাজানে বাবেল’ অর্থাৎ ব্যাবিলন সঙ্গীত সম্মেলনে ইরাকে পর পর পাঁচবার সঙ্গীতদলের নেতা ও শিল্পী হিসেবে সঙ্গীত পরিবেশন করেন, অস্ট্রেলিয়ার পার্থে অনুষ্ঠিত প্রথম ইন্ডিয়ান ওশান আর্ট ফেস্টিভালে সঙ্গীত পরিবেশন। নানা শহরে ছিল তার সঙ্গীতের আসর, বিশেষ টোকিও, করে: কলকাতা, দিল্লী, মুম্বাই, ব্যাংগালোর, মাদ্রাজ, লাহোর, করাচী, লন্ডন, নিউইয়র্ক, লসএ্যাঞ্জেলেস শহরে। নানা দেশে তিনি গান করেছেন, বক্তৃতা করে ফিরেছেন: ভিয়েনা, জাপান, কোরিয়া, চীন, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, রাশিয়া, সৌদি আরব, তুরস্ক, ইরান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র। জাপানে বেশ কয়েকবার এশিয়ান কালচারাল ইনস্টিটিউটের আমন্ত্রণে লোকসঙ্গীতের প্রবক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত। জাপান ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে জাপানের আটটি শহরে তার প্রতিষ্ঠান ফোক মিউজিক রিসার্চ গ্রুপের দশজন শিল্পীসহ অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন। সংগ্রাহক ও গবেষক হিসেবে বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিতে তার অবদান উল্লেখের দাবি রাখে। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ফোক মিউজিক রিসার্চ গ্রুপের পরিচালক ও সংগ্রাহক হিসেবে কয়েক হাজার গান তার সংগ্রহে। অন্যকোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি এত বিপুল সংগ্রহের দাবিদার নন। বাংলা লোকসঙ্গীতের মূল্যবান লালনের গান, ভাটিয়ালি, বিচ্ছেদী, ভাওয়াইয়া, চটকা তার সংগ্রহে। সম্পাদিত ‘দুয়ারে আইসাছে পালকি’ ও স্বাধীনতা দিনের গান’ উল্লেখযোগ্য সংকলন গ্রন্থ। ‘জার্নাল অব ফোক মিউজিকের’র সম্পাদক। ‘লোকসঙ্গীতের ইতিহাস’, ‘ভাওয়াইয়ার জন্মভূমি’। (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড), ‘ভাটির দ্যাশের ভাটিয়ালি’ প্রথম খণ্ডে সর্বমোট ছ’শত গান স্বরলিপি ও বিবক্ষণসহ প্রকাশিত, দেশে বিদেশে প্রশংসিত। কবি, লেখক ও গবেষক মুস্তফা জামান আব্বাসীর ২১টি গ্রন্থ পাঠকনন্দিত। ৫৫০ পৃষ্ঠায় মুহাম্মদের নাম (স.) বাংলা ভাষায় নবী জীবনের আগ্রহ ভরে পঠিত জীবনীসমূহের মধ্যে একটি (তৃতীয় সংস্করণ)। তার অনুদিত ‘মুহাম্মদের (স.) বাণী’ লক্ষাধিক কপি মুদ্রিত ও প্রচারিত। মাওলানা জালালউদ্দিন রুমির কবিতা ও দর্শন নিয়ে লেখা ‘রুমির অলৌকিক বাগান’ এদেশে রুমিচর্চার নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে। জাপানের সংস্কৃতি নিয়ে লেখা: ‘জাপান: সূর্য উঠেছে যেখানে কয়েকটি সংস্করণ বেরিয়েছে। উপন্যাস ‘হরিণাক্ষি’, কাব্যগ্রন্থ ‘যুগলবন্দী, সেতারে নয় কবিতায়’ (আসমা আব্বাসীর সঙ্গে), সুফি কবিতা: রুমি, নিফফারী, সুলতান বাহু ও অন্যান্য’। রম্য রচনা: ‘স্বপ্নরা থাকে স্বপ্নের ওধারে,’ ‘গোধূলীর ছায়াপথে’ ও ইংরেজিতে নবীর জীবনী ‘দিন নেম অব মুহাম্মদ (স.), সাহিত্যমহলে উচ্চ প্রশংসিত। ‘চেনা অচেনা চীন’, ‘আমেরিকার টুকরো স্মৃতি, (ভ্রমণ কাহিনি), ‘নদী উপনদী’ (উপন্যাস) ও ইংরেজি ‘মাই ফাদার্স লাস্ট ড্রিম এন্ড আদার এসেস’ প্রকাশিতব্য। তার লেখা নজরুলের জীবনভিত্তিক উপন্যাস ‘পুড়িব একাকী, প্রকাশ করেছে অন্যপ্রকাশ । কোহিনূর পাবলিশার্স চট্টগ্রাম প্রকাশ করেছে: ‘নজরুল-আব্বাউদ্দিন স্মৃতিময় অ্যালবাম’ যা ইতোমধ্যে পাঠকসমাজে সাড়া ফেলেছে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ তাকে নজরুল-আব্বাসউদ্দিন স্কলার হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছে নজরুল ও আব্বাসউদ্দিনের ইংরেজি ভাষায় দু’টি জীবনী গ্রন্থ রচনার জন্য। উপস্থাপক মুস্তফা জামান আব্বাসী বিটিভিতে ‘ভরা নদীর বাঁকে’, ‘আমার ঠিকানা’, ‘লৌকিক বাংলা’, ‘আপন ভুবন’ লোকসংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরেন। দর্শকের ড্রইংরুমে দীর্ঘদিন এই অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত গ্রাম বাংলা থেকে তুলে আনা শত শত শিল্পী। এর ভিডিও প্রবাসী বাঙালিদের ঘরে স্থান পেয়েছে। সমাজসেবক মুস্তফা জামান আব্বাসী ছিলেন ঢাকা রোটারি ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশ রোটারি ক্লাবগুলোর জেলা গভর্নর। গৃহিহীনদের মধ্যে চারশটি বাড়ি, চক্ষু শিবির, সবুজ গ্রাম প্রকল্প, পোলিও প্লাস ও রোটারির নানা কর্মকাণ্ডে দীর্ঘ শয়তাল্লিশ বছর ধরে যুক্ত। কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলার উপদেষ্টা, বুলবুল ললিতকলা একাডেমির উপদেষ্টা, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড এশিয়াটিক সোসাইটির জীবন সদস্য, বাংলাদেশ ফোকলোর পরিষদের সহ-সভাপতি হিসেবে নানা কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন। তিনি নানা পদকে ভূষিত, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, লালন পুরস্কার, নজরুল একাডেমি পুরস্কার, আব্বাসউদ্দিন গোল্ড মেডেল, এ্যাপেক্স ফাউন্ডেশন পুরস্কার, একুশে পদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব লেখক পুরস্কার, সিলেট মিউজিক পুরস্কার, মানিক মিয়া পুরস্কার, নাট্যসভা উপস্থাপক পুরস্কার, বাংলা সন চৌদ্দশতবার্ষিকী পুরস্কার ইত্যাদি। এশিয়া মিডিয়া সামিট, আন্তর্জাতিক রুমি কর্মকাণ্ড, আন্তর্জাতিক সুফি সম্মেলন, লোকসংস্কৃতি সেমিনার, রেডিও টেলিভিশনে বক্তব্য ও গানের জলসা নিয়ে ব্যস্ত। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে হজ্ব ও ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে ওমরাহ হজ্ব করে বর্তমানে লেখালেখি ও মসজিদে সময় ব্যয় করেন। তার স্ত্রী আসমা আব্বাসীও একজন প্রথিতযশা শিক্ষক ও সাহিত্যিক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনিও শ্রেষ্ঠ কলেজ শিক্ষক স্বর্ণপদক ও মাদার্স ক্লাবের শ্রেষ্ঠমাতা পুরস্কার অর্জন করেন।




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ