নভেরা আহমেদ

প্রথম পাতা » জীবনী » নভেরা আহমেদ


নভেরা আহমেদ
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের অন্যতম স্থপতি
নভেরা আহমেদ বাংলাদেশের প্রথম মহিলা ভাস্কর। যিনি ভাস্কর্যের মত স্পর্শকাতর ও শ্রমসাধ্য শিল্পে নিশ্চিত করেছেন নারীর উপস্থিতি। বলতে গেলে তাঁর হাতেই উত্থান ঘটেছে এ শিল্পের। অন্তঃপুরের অন্ধকারাচ্ছন্ন গৃহকোণ ছেড়ে সামাজিক কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামী উপেক্ষা করে বুকে সাহস নিয়ে বাইরে বের হয়ে এসেছেন। ননট্র্যাডিশনাল একটি পেশাকে বেছে নিয়েছেন। বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে পুরুষের সাথে কাজ করেছেন সমান তালে। তিনি শিল্প কর্মে ঐতিহ্য অন্বেষণ ও বিশ্ববীক্ষায় পরিশীলিত নতুন প্রকরণ ও শৈলী নির্মাণ করেন। তাঁর শিল্পকর্মে আছে অসাধারণত্বের প্রতিশ্রুতি। তাছাড়া তিনি বাঙালির অহংকার ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনারের অন্যতম প্রধান রূপকার। শহীদ মিনারের মূলনকশা প্রণয়নের সাথে রয়েছে তাঁর সম্পৃক্ততা। অগ্রচারী, সৃজন-নিপুণ পথিকৃৎ দুঃসাহসী শিল্পী নভেরা আহমেদের জন্ম ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে কোলকাতায়। তাঁর পিতার নাম সাঈদ আহমেদ। পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রাম । বর্তমানে তিনি ফ্রান্সের বাসিন্দা। নভেরা কোলকাতার লরেটা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশ বিভাগের পর তাঁর পিতা কুমিল্লায় বদলি হয়ে আসেন। পিতার সাথে নভেরাও আসেন কুমিল্লায় ৷ ভর্তি হন ভিক্টোরিয়া কলেজে। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি লন্ডনে ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টস এন্ড ক্রাফটস-এ ন্যাশনাল ডিপ্লোমা-ইন-ডিজাইনের মডেলিং ও স্কাল্পচার কোর্সে ভর্তি হন। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ডিপ্লোমা পান। ওই স্কুলের ভাস্কর্য বিভাগে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অধ্যক্ষ ছিলেন চেকোস্লোভাকিয়ার অধিবাসী ড. কেলে ফোগেল। সৃজনশীল ও উদ্ভাবনাময় প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি। ছাত্র-ছাত্রীদের সৃজনশীল করে তোলার ব্যাপারে ছিল তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগ। তাদের মডেলের সূক্ষ্ম বৈচিত্র্য, রসানুভূতি ও সংবেদনশীলতা সৃষ্টিতে সব সময় উদ্বুদ্ধ করতেন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে নভেরা দেখতে যান প্রখ্যাত ফরাসি ভাস্কর রঁদ্যার মিউজিয়াম। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারি মাসে নভেরা ভাস্কর্যের নগরী ও ইউরোপীয় স্মৃতিকাগার ফ্লোরেন্স যান। এখানে তিনি পাঁচ মাস থাকেন। এ সময় তিনি ভাস্কর ভেম্ব্ররিনো ভেস্তুরির কাছে ভাস্কর্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণকালে তিনি পরিচিত। হন বেশ ক’জন ধ্রুপদী শিল্পীর বিখ্যাত কাজের শিল্পশৈলীর সাথে। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি দেশে ফেরেন। একই সঙ্গে শিল্পী হামিদুর রহমানও দেশে আসেন। বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার তখন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি। ঢাকায় আধুনিক ইমারত হিসেবে ছিল দর্শনীয়। সদ্য নির্মিত সেই ভবনের নিচতলার দেয়ালে এ দুই শিল্পী ভাষা আন্দোলনের ম্যুরাল করার জন্য কমিশন পান। কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরিতে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভাস্কর নভেরা আহমেদ ও শিল্পী হামিদুর রহমানের যৌথ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। একই খ্রিস্টাব্দে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সুপারিশক্রমে নভেরা আহমেদ ও শিল্পী হামিদুর রহমান বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নকসা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কাজ শুরু করেন। শহীদ মিনারের বেমেটের কক্ষে ভাষা সংগ্রামের একটি ম্যুরাল চিত্র প্রণয়নের কাজেও তাঁরা হাত দেন। কিন্তু শহীদ মিনারের মূল বেদীসহ স্তম্ভ নির্মাণের পর দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয় । ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে অক্টোবর মাসে দেশে সামরিক শাসন জারি হয়। তাঁদের কাজটি বন্ধ করে দেয়া হয়। শৈশব থেকে সঙ্গীত, নৃত্য ও শিল্পকলার প্রতি তাঁর বিশেষ আকর্ষণ ছিল। কোলকাতায় থাকাকালীন সময় তিনি সাধনা বোসের কাছে কিছুদিন নাচের তালিম নেন। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে ভারত নাট্যম শেখার জন্য বোম্বে পাড়ি জমান। মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারত নাট্যমের মুদ্রা, অঙ্গ সঞ্চালন ও রসকলা ভাস্কর্যে ব্যবহার করা। কিন্তু অতিরিক্ত পরিশ্রমে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার জন্য বিলেত যান। শল্য চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হন। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে শিল্প সাধনায় অনুকূল পরিবেশের আশায় তিনি প্যারিস গমন করেন। এখানে তাঁর পরিচয় ঘটে ভাস্কর নৃপতি সজার এবং জিয়াকোমেত্তির সাথে। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি হংকং যান। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে শেষ হয় তাঁর থাইল্যান্ড সফর। প্রত্যাবর্তন করেন প্যারিসে। ভ্রমণ বিলাসী নভেরা ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে থাইল্যান্ডের উদ্দেশ্যে প্যারিস ছাড়েন। ভ্রমণ করেন কম্বোডিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া ও লাওস। লাওস থেকে সংগ্রহ করেন আমেরিকার যুদ্ধবিমানের ভগ্নাবশেষ। এরপর ফিরে আসেন থাইল্যান্ডে। প্রস্তুতি নিতে থাকেন পরবর্তী প্রদর্শনীর। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে ভ্রমণ করেন নেপাল ও ভারত। এ সময় তিনি বিভিন্ন মন্দির পর্যবেক্ষণ করেন। অবশেষে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে ৩৩টি মনুমেন্টাল ভাস্কর্য নিয়ে পি.আই.এ ও আলিয়ঁস ফ্রঁসেসের যৌথ উদ্যোগে ব্যাংককে তাঁর একটি একক প্রদর্শনী হয়। ভাঙ্গা বিমান দিয়ে তৈরী ভাস্কর্যগুলোতে ছিল সুসংবদ্ধ নির্মিতির দক্ষতা। এ কাজগুলোতে শিল্পী নভেরার ক্ষুরধার পর্যবেক্ষণ ও দার্শনিকতার ছাপ ছিল। প্রদর্শনী শেষে নভেরা প্যারিসে ফিরে যান। এরপর আর কোনদিন তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন নি। কনে তাঁর সকল সুহৃদ, আত্মীয়স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতে থাকেন। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি গ্রিল ভ্রমণ করেন। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে ৫ই জুলাই তাঁর আর একটি একক প্রদর্শনী হয় প্যারিসে। ১২টি ভাস্কর্য ও ১২টি চিত্রকলা ওই প্রদর্শনীতে স্থান পায়। ভাবের উষ্ণতায় আর গড়নে আয়তনে তা ছিল জীবনস্পর্শী। ফরাসি সরকার ওই প্রদর্শনী থেকে ‘পাখি’ শিরোনামের কাজটি ক্রয় করেন। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি আকস্মিকভাবে এক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন। এ দুর্ঘটনার পর পাল্টে যায় তাঁর জীবন দর্শন। ভাস্কর্য শিল্পে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে সরকার ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে তাকে একুশে পদক প্রদান করে। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বর্তমানে স্বামী যোগয়া দ্য ব্রহজের সাথে প্যারিসে বসবাস করছেন। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ