নিতুন কুণ্ডু

প্রথম পাতা » জীবনী » নিতুন কুণ্ডু


নিতুন কুণ্ডু
খ্যাতিমান ভাষ্কর
যুগে যুগে এমন কিছু মানুষ জন্ম নেন পৃথিবীর বুকে, যারা তাদের অনন্য মেধা, প্রতিভা, ত্যাগ, কৃতকর্ম দ্বারা রেখে যান এমন কিছু অবিস্মরণীয় নিদর্শন- যা তাকে অমর করে রাখে অনন্তকাল। আমরা তাদের বলি খ্যাতিমান বা খ্যাত মানুষ। তেমনি একজন খ্যাতিমান মানুষ নিতুন কুণ্ডু। যিনি বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন তার শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের মেটাল ফার্নিচারের সূচনা তার হাতেই। দক্ষিণ এশিয়ার একটি অন্যতম ব্র্যান্ড ‘অটবি’র প্রতিষ্ঠাতা তিনি। অটবি তার স্বপ্নের সৃষ্টি। গুণগত মান, ডিজাইনের নতুনত্বের মধ্য দিয়ে ফার্নিচার তৈরি বিপণন কেন্দ্র হিসেবে অটবির এ বিশাল অর্জনের পেছনে মূল ভূমিকা নিতুন কুণ্ডুর । নিতুন কুণ্ডুর জন্ম ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর দিনাজপুর জেলা শহরের বড় বন্দর এলাকায়। পুরো নাম শ্রী নিত্য গোপাল কুণ্ডু। তার বাবার নাম- জ্ঞান্দ্রেনাথ কুণ্ডু, মার নাম- বীণা পানি কুণ্ডু। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে নিতুন কুণ্ডু ৪র্থতম। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে মগরাজা গিরিজানাথ হাই স্কুল থেকে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিক পাস করেন। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন বেশ মেধাবী ও সৃজনশীল মনোভাবাপন্ন, বিশেষ করে চিত্রকর্মের প্রতি ছিল তার প্রচণ্ড ঝোঁক। অবশ্য পরিবার থেকেও এ বিষয়ে যথেষ্ট অনুপ্রেরণা পান তিনি। ছাত্রাবস্থায়ই কাজ করেছেন এক সময়ের খ্যাতিমান চলচ্চিত্র অভিনেতা ও পরিচালক সুভাষ দত্তের সহকারী হিসেবে। সহকারী হিসেবে তিনি ব্যানার, সাইনবোর্ড লেখা ও সাজসজ্জার কাজ করতেন। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা চলে আসেন এবং ভর্তি হন তৎকালীন আর্ট কলেজে (বর্তমানে চারুকলা ইনস্টিটিউট), ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে এখান থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। কলেজে পড়াশুনার পাশাপাশি নিয়মিত সাইনবোর্ড ব্যানার লেখার কাজ করতেন। আর্ট কলেজের ছাত্রাবস্থায় তার শিল্পকর্মের জন্য সহপাঠী ও শিক্ষকদের কাছে ব্যাপক প্রশংসিত হন। ঢাকাস্থ মার্কিন তথ্যকেন্দ্রে আর্টিস্ট পদে তার কর্মজীবন শুরু। ১১ বছর এখানে কর্মরত থাকার পর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা যুদ্ধে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য প্রবাসী সরকারের তথ্য ও প্রচার বিভাগে যোগদান করেন। ষাট ও সত্তর দশকের বড় বড়যত আন্দোলন ও অনুষ্ঠান হতো তার অধিকাংশেরই ব্যানার, ফেস্টুন, প্লেকার্ড, অঙ্গসজ্জা করতেন নিতুন কুণ্ডু। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সহায়ক আন্দোলন হিসেবে যে সাংস্কৃতিক ও সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক আন্দোলন চলছিল তিনি ছিলেন তার অন্যতম অংশীদার। স্বাধীনতার পর তিনি তার আগের চাকরিতে ফিরে যাননি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে শুরু করেন স্ক্রিনপ্রিন্টের কাজ। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে দি ডিজাইনার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এভাবে ব্যবসায়িক বিভিন্ন প্রক্রিয়া বা ধাপ পেরিয়ে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে অটবি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি বিটপির মালিক রেজা আলীর সঙ্গে পার্টনারশিপে। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে রেজা আলীর সঙ্গে সমঝোতাপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে অটবির একক মালিক হন তিনি। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়েও নিজের চেষ্টা শ্রমে অটবিকে পৌঁছে দেন সাফল্যের চূড়ায়। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে অটবি লি. কোম্পানি হিসেবে যাত্রা শুরু করে। আন্তর্জাতিক মানের ফার্নিচার তৈরি ও ডিজাইনের নতুনত্বের কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় এ পর্যন্ত ৮ বার এককভাবে প্রথম পুরস্কার লাভ করে অটবি। শুধু তাই নয়- ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় চেয়ার রফতানির মাধ্যমে অটবি আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করে, বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজারে অটবির পণ্য রফতানি হ ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর নিতুন কুণ্ডু মারা যান। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত শিল্পকর্মের যে কাজগুলো করে গেছেন তন্মধ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধের পোস্টার ডিজাইন ১৯৭১ ‘ইন্দিরা মঞ্চ’ (১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে ইন্দিরা গান্ধীর আগমন উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নির্মিত মঞ্চ) জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ, বাংলাদেশ টেলিভিশনের নতুনকুড়ি পুরস্কার, প্রেসিডেন্ট শিশু-কিশোর ফুটবল কাপ, শিল্প মেলা ট্রফি, এশিয়া কাপ ক্রিকেট পুরস্কার, একুশে পদক’র নকশা ও নির্মাণ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তার উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্মের মধ্যে ম্যুরাল (পিতল), হোটেল শেরাটন, ঢাকা। ন্যারাল (তেল রঙ), জনতা ব্যাংক, ঢাকা। ম্যুরাল (কাঠ, লোহা, পিতল) মধুমিতা হল, ঢাকা। সাবাশ বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য, রাজশাহী। সার্ক        ফোয়ারা, কারওয়ান বাজার, ঢাকা। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররাম এর দক্ষিণ গেট, ঢাকা উল্লেখযোগ্য। শিল্পকর্মে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় চিত্রকলা পুরস্কার, ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে ভ্রাম্যমাণ প্রদর্শনী/চিত্রকলায় স্বর্ণপদক, ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে পান রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদক, ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে মার্কেন্ট ব্যাংক লি. পুরস্কার ইত্যাদি। তিনি ২০১১ খ্রিস্টাব্দে পরলোকে গমন করেন।

 




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ