অধ্যক্ষ প্রতিভা মুৎসুদ্দি

প্রথম পাতা » জীবনী » অধ্যক্ষ প্রতিভা মুৎসুদ্দি


অধ্যক্ষ প্রতিভা মুৎসুদ্দি

প্রতিভা মুৎসদ্দি অসাধারণ প্রতিভাধর এক নারী। তাঁর জন্ম ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার মহামুণি পাহাড়তলী গ্রামে। তাঁর পিতা কিরণ বিকাশ মুত্সুদ্দি ছিলেন আইন ব্যবসায়ী, মাতা শৈলবালা ছিলেন সহজ-সরল অথচ সত্যাশ্রয়ী নিবেদিতা গৃহিণী। পিতা-মাতার নয় সন্তানের মধ্যে মুৎসুদ্দি ছিলেন তৃতীয়। শৈশবে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয় গ্রামের পাঠশালায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অস্থির সময়টিতে তাঁদের পরিবার চট্টগ্রাম ও গ্রামের বাড়িতে ঘন ঘন স্থানান্তরিত হয়। ফলে এ সময়টিতে গ্রাম ও শহরের স্কুলগুলোতে স্থানান্তরিত হন তিনি। তবে তাঁর চেতনায় শিক্ষাজীবনে গ্রামের মহামুণি এ্যাংলোপালি। ইনস্টিটিউশনটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তিনি ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে ডা. খাঙ্গীর স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে এবং এখান থেকে ১ম বিভাগে আই. এ. পাস করেন। চট্টগ্রাম কলেজ থেকেই ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্মান সম্পন্ন করেন। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও ঘাত- প্রতিঘাত মাথায় নিয়ে অর্থনীতিতে এম.এ পাস করেন। তারপর ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ভর্তি হন এবং এখান থেকে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে বি.এড ডিগ্রি লাভ কিশোর বয়স থেকেই তাঁর মধ্যে সংগঠনপ্রিয়তার উন্মেষ ঘটে। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়। সমাজের অবহেলিত ও নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় সোচ্চার ও তাত্ত্বিক ব্যঞ্জনাময় আন্দোলনের সম্ভবত এ যাবৎকালের সর্বাপেক্ষা বেগবান সময়কাল এটি। সময়ের এ মহার্ঘ চালিকা শক্তিই হয়তো মিস প্রতিভা মুৎসুদ্দিকে প্রভাবিত করেছে। তাইতো তিনি অত্যন্ত সততার সাথে এ আন্দোলনের মূল সুরকে ধারণ করেছেন দৃঢ়ভাবে। কৈশোরকাল থেকেই তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জামত হয়েছিল প্রবলভাবে। এ্যাংলোপালি বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই তিনি ছাত্রী সংসদ গঠন করেন। কলেজে পড়ার সময় থেকে তাঁর রাজনৈতিক তৎপরতা বহুগুণে বেড়ে যায়। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ঘনিষ্টভাবে জড়িয়ে পড়েন বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন সেবা ও কল্যাণমুখী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। তিনি যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে স্বাধিকার আন্দোলনের এক মিছিল থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দায়ে গ্রেফতার হন। তখন তিনি দু’সপ্তাহ হাজতবাস করেন। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে তদানীন্তন উইমেন্স হলের (বর্তমান রোকেয়া হল) ভি.পি নির্বাচিত হন। পড়াশোনার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ব্যস্ততা ও কাজের চাপে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে সঠিক সময়ে তিনি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় কোর্স সুসম্পন্ন করতে পারেননি। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে কক্সবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী প্রতিভা মুত্সুদ্দি এখানে বেশি দিন টিকতে পারেননি পারিপার্শ্বিক অব্যবস্থার জন্য। তিনি অন্যায় অসত্যের কাছে মাথা নোয়াতে পছন্দ করতেন না বলে এ চাকরিতে ইফা দেন। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ঢাকা জেলার জয়দেবপুর থানা (বর্তমানে গাজীপুর জেলা) সদরের একটি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন। এখানেও তিনি বাধার সম্মুখীন হন। আমলাতান্ত্রিক অবৈধ হস্তক্ষেপ তাঁকে ক্ষুব্ধ করে। বিদ্যালয়ের সভাপতি মহোদয়ের সাথে মতাদর্শের বিরোধের কারণে চাকরিতে ইস্তফা দেন। কিন্তু তাঁর মহৎ মন জ্ঞান বিতরণের একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র সন্ধানে ব্যাকুল হয়ে উঠলো। অবশেষে তাঁর ইচ্ছা পূরণ হলো টাঙ্গাইলের ভারতেশ্বরী হোমসে অর্থনীতির প্রভাষিকা হিসেবে ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে যোগদানের মধ্য দিয়ে। কর্মদক্ষতা গুণে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দ থেকে তিনি কুমুদিনী কমপ্লেক্সের প্রশাসক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। মির্জাপুর ভারতেশ্বরী হোমসের সোনালী দিনের কথা ভাবতে গেলে প্রতিভা মুৎসুদ্দির নাম ওঠে আসে সবার আগে। তিনি বর্তমানে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল (বাংলাদেশ) লিমিটেড-এর পরিচালক (শিক্ষা) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ প্রথম দিকে যখন দানবীর আর পি সাহার কনিষ্ঠা কন্যা মিসেস জয়াপতি সাহা তাঁকে ভারতেশ্বরী হোমসের দায়িত্বভার গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানালেন, তখন তিনি প্রথমে রাজি হননি। সম্পূর্ণ আবাসিক প্রতিষ্ঠানের গণ্ডিতে তিনি আবদ্ধ হতে চাননি। তিনি সব সময় চাইতেন সমাজের অবহেলিত ও দলিতদের মাঝে থেকে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে। মিসেস জয়াপতি তাঁকে বুঝাতে সক্ষম হন যে, এই ছোট্ট পরিসরে থেকেও যে কোন উদ্যমী মানুষ তাঁর ভাবনা, আদর্শ ও শিক্ষাকে ছড়িয়ে দিতে পারবেন সারা দেশব্যাপী। প্রতিভা মুৎসুদ্দি অবেশেষে রাজী হন এবং ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে যোগদান করেন। প্রতিভা মুৎসুদ্দির নিরলস শ্রম ও প্রগতিশীল চিন্তাধারা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ভারতেশ্বরী হোমস ও কুমুদিনী কমপ্লেক্সের সঙ্গে।চিরকুমারী, নিরামিষভোজী, নারী শিক্ষা প্রসারে এক কিংবদন্তি নারী প্রতিভা মুৎসুদ্দি সত্যি আমাদের গর্ব। কোমলে কঠোর মিস প্রতিভা মুৎসুদ্দি একজন অনন্য মানুষ। তিনি বরাবরই প্রচারবিমুখ। তবু তাঁর আন্তরিকতা, তাঁর নিষ্ঠাগুণের জন্যই তিনি পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে এসেছেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সম্মানিত ও পুরস্কৃত হয়েছেন। একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে বহু সংগঠন থেকে পদক পেয়েছেন। তার মধ্যে ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে ‘বেইস’ (BACD) থেকে ‘আজিজুর রহমান পদক” ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে ‘অনন্যা শীর্ষদশ পদক’ ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে ‘লায়ন নজরুল ইসলাম শিক্ষা স্বর্ণ পদক’, ২০০১ খ্রিস্টাব্দে লায়ন ক্লাব চট্টগ্রাম থেকে বিশেষ সম্মাননা পুরস্কার, ২০০২ খ্রিস্টাব্দে ২১শে পদক ও ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে প্রকাশনা শিক্ষা- সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘ছায়ানীড়’ প্রদত্ত ছায়ানীড় স্বর্ণপদক-২০০৬ উল্লেখযোগ্য। ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত সেমিনারে তিনি কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের প্রতিনিধিত্ব করেন।




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ