এ. কে. এম. হানিফ (হানিফ সংকেত)

প্রথম পাতা » জীবনী » এ. কে. এম. হানিফ (হানিফ সংকেত)


এ. কে. এম. হানিফ (হানিফ সংকেত)

বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

এ. কে. এম. হানিফ। তবে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছে ‘তানি সংকেত’ নামেই সুপরিচিত তিনি। সদ হাস্যোজ্জ্বল, বাকপটু মানুষ হিসেবে ধে আমরা অনন্য জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদির মঞ্চে উপস্থাপক হিসেবে বিগত প্রায় দুই যুগ ধরে দেখে আসছি। প্রতিভা, মেধা, মনন, প্রজ্ঞায় অনন্যসাধারণ বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় এই মানুষটির জন্ম ফেনী জেলায় ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অক্টোবর। বাবা আব্দুল হালিম ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা এবং মা সৈয়দুন্নেসা বেগম। বাবা-মার সংসারে তারা ৩ ভাই, ৩ বোন, ভাইবোনদের মধ্যে তিনি ৪র্থতম। ভাই-বোনদের প্রত্যেকেই উচ্চশিক্ষিত, বিবাহিত এবং স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
হানিফ সংকেতের শিক্ষাজীবন শুরু চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড স্কুলে। হানিফ সংকেত যখন বুঝতে শিখেছিলেন তখনই বাবার চাকরির বদলিজনিত কারণে তাকে পরিবারের অন্য সকলের সঙ্গে সীতাকুণ্ডে চলে আসতে হয়। কারণ স্থান বদলের কারণে চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় কেটেছে তার। তবে কৈশোরের বেশির ভাগ সময় পার করেছেন তিনি পটিয়ায়। পটিয়া হাই স্কুলে পড়ালেখা করেছেন নবম শ্রেণি পর্যন্ত। এরপর পরিবরের সঙ্গে চলে আসেন কুমিল্লায় । তিনি কুমিল্লা হাই স্কুল থেকে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে কৃতিত্বের সঙ্গে এস.এস.সি., ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে এইচ.এস.সি. পাস করেন। এরপর চলে আসেন ঢাকায়, অনার্সে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। এসময় তার লেখালেখির প্রবণতা বেড়ে যায় এবং পড়ালেখায় মনোযোগী না হয়ে পত্রিকা অফিসগুলোতে আড্ডা মেরে সময় কেটে যেতে থাকে তার। তার এ প্রবণতা লক্ষ্য করে বাবা তাকে চট্টগ্রামের কাপ্তাইয়ে তদানীন্তন সুইডিশ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি করে দেন। এখান থেকে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে পাড়ি জমান আমেরিকায় কম্পিউটারের উপর একটি টেকনিক্যাল কোর্স কমপ্লিট করার জন্য, সাফল্যের সঙ্গে কোর্সটি কমপ্লিট করে যান ফ্রান্সে। এখান থেকেও কম্পিউটারের উপর আরও একটি উচ্চতর প্রশিক্ষণ কোর্স কমপ্লিট করেন । তারপর দেশে ফেরেন। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দের শুরুর দিকে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে মহাকাশ বিজ্ঞান গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানে তার কর্মজীবন শুরু। তিনি বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানে উচ্চতর প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
হানিফ সংকেতের পরিচয় এখানেই শেষ নয়। একদিকে তিনি যেমন মেধাবী ও প্রতিভাবান উপস্থাপক, তেমনি তিনি একজন সরস লেখক, ঔপন্যাসিক, কলামিস্ট, নাট্যকার, নির্মাতা, পরিচালক, অভিনেতা, গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক। সব কিছুতেই রয়েছে তার চমৎকার ও অনায়াস দখল। সবকিছু ছাপিয়ে তার অন্যতম পরিচয়, তিনি জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’-এর নির্মাতা, পরিকল্পনাকারী, উপস্থাপক ও পরিচালক। রচনা, করিকল্পনা, তথ্য নির্মাণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনিই প্রথম ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে ব্যতিক্রম ধারার জন্ম দিয়েছেন। তিনি তার ইত্যাদিতে বিনোদনের পাশাপাশি সিরিয়াস বিষয় সন্নিবেশ ঘটিয়ে যেমন আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন তেমনি তার ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করে সর্বাধিক সংখ্যক শিল্পী তারকাখ্যাতি অর্জন করেছেন। হানিফ সংকেতের ইত্যাদিই একমাত্র ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান যেটির সর্বাধিক পর্ব সিএনএন-এ প্রচারিত হয়েছে। যেটি প্রায় দুইযুগ ধরে ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তাকে অক্ষুণ্ণ রেখে প্রচার হচ্ছে। হানিফ সংকেত যখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তখন থেকেই সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। সে সময় পটিয়া ক্লাবে অফিসার্স এসোসিয়েশন আয়োজিত ‘টিপু সুলতান’ নাটকে তিনি একটি শিশু চরিত্রে অভিনয় করেন। ঐ সময়েই তার লেখা প্রথম গল্প ‘সেঁজুতি দি’ স্কুলের বার্ষিক ম্যাগাজিনে ছাপা হয়, এমন কি সেই বার্ষিকীর সম্পাদনার দায়িত্বও তিনি পালন করেন। তিনি নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন কুমিল্লা চলে আসেন, এখানেই তার সংস্কৃতিচর্চার ভিতটা মজবুত হয়। এ সময় তিনি নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন। বিশেষ করে তদানীন্তন পূর্বদেশ পত্রিকার ছোটদের পাতা চাঁদের হাট-এ ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে তার প্রথম ছড়া ছাপা হয়। এরপর দৈনিক জনপদ এবং কিশোর ‘জনপদ’-এ গল্পটি ছাপা হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রচুর লিখেছেন, এখনও লিখে চলেছেন। ৮২ খ্রিস্টাব্দে তিনি যোগ দেন ফজলে লোহানীর তৎকালীন জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘যদি কিছু মনে না করেন’ এর সঙ্গে। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি টিভি নাটকে অভিনয় শুরু করেন। টিভিতে তার অভিনীত প্রথম নাটক ‘মৃত সৈনিক’, পরবর্তী সময়ে ‘আয়না’ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এরপর থেকে নোঙ্গর, আমি তুমি সে, সাত সমুদ্দুর, কুসুম প্রভৃতি নাটকের উল্লেখযোগ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত ছবিগুলোর মধ্যে চাঁপা ডাঙার বউ, আগমন উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া ফজলে লোহানীর দুটি অসমাপ্ত ‘সোহাগী বধূ’, ‘ডাঙ্গা’ ছবিতে অভিনয় করেন। ‘ঝলক’ নামক একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে টিভির পর্দায় এককভাবে আবির্ভূত হন তিনি। এটি চলে প্রায় এক বছর। বিদেশ চলে যান কয়েক মাসের জন্য। তারপর ১৯৮৭-৮৮ খ্রিস্টাব্দে শুরু করেন নতুন একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘বঙ্গের কথা’। তিনি ছিলেন এর মূল পরিকল্পক। উপস্থাপনা করতেন বিভিন্ন জন। কোন কোন অনুষ্ঠান তিনি নিজেও উপস্থাপনা করতেন। এভাবেই নিজেকে একজন পূর্ণাঙ্গ উপস্থাপক হিসেবে তৈরি করেন তিনি। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে থেকে শুরু করেন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’। তারপর আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন ব্যাপারটা এমন হয়ে গেছে যে, আমরা ইত্যাদির নাম নিলেই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে হানিফ সংকেতের হাস্যময় মুখ, আবার হানিফ সংকেতের নাম নিলেই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে ইত্যাদির আকর্ষণীয় মঞ্চ, মনে দাগ কাটা থিম সং কেউ কেউ অবিরাম চুপি চুপি, চেহারাটা পাল্টে যাবে বহুরূপী… ইত্যাদি, ইত্যাদি। অর্থাৎ কর্তা-কর্মের বিশেষ্য বিশেষণ মিলেমিশে একাকার। তিনি এ যাবত অনেক পুরস্কার পদক ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ২০১০ খ্রিস্টাব্দে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয় ।




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ