নূরজাহান বেগম

প্রথম পাতা » জীবনী » নূরজাহান বেগম


নূরজাহান বেগম
নারী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ
বাংলাদেশের মিডিয়া জগতের একটি বিশেষ ব্যক্তিত্ব নূরজাহান বেগম। বেগম সম্পাদিকা হিসেবে তাঁর পরিচয় আপামর জনসাধারণের কাছে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে আজ অবধি সুনিপূণ হাতে তিনি সাপ্তাহিক ‘বেগম’ সম্পাদনা করে যাচ্ছেন। ‘বেগম’ এদেশের নারী সমাজের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি, অবরোধবাসিনীদের সক্রিয়ভাবে শিক্ষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অনুপ্রেবেশে উৎসাহিত করেছে। বাংলা ভাষায় নারীদের জন্য প্রথম সচিত্র সাপ্তাহিক হিসেবে ‘বেগম’ বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। এ পত্রিকার
মাধ্যমে নূরজাহান বেগম তাঁর সামাজিক দায়দায়িত্ব পালন করে চলেছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে। নূরজাহান বেগমের জন্ম ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুন, চাঁদপুর জেলার চালিতাতলি গ্রামে। মা, ফাতেমা খাতুন ও পিতা মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের একমাত্র সন্তান তিনি। পিতা ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাহিত্যসেবী ও সমাজহিতৈষী। সওগাত সম্পাদক হিসেবে ছিল তাঁর পরিচয়ের ব্যাপ্তি। স্বল্প শিক্ষা, স্বল্প পুঁজি নিয়ে তিনি ভাগ্যান্বেষণে গিয়েছিলেন কোলকাতায়। নানা প্রতিবন্ধকতা, নানা কাজে লিপ্ত থেকে স্বীয় সংকল্পে অটল থেকে জন্ম দিলেন বাংলার মুসলমানদের জন্য সর্বপ্রথম চিত্রবহুল প্রগতিশীল মাসিক পত্র ‘সচিত্র মাসিক সওগাত’ ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে। সেকালে মুসলিম সমাজে বই বা পত্রপত্রিকায় ছবি ছাপা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু তিনি এ কুসংস্কার ভঙ্গ করেন। তিনি তাঁর স্ত্রী ফাতেমা বেগমকে বোরকা পরতে দেননি। বাড়িতে গৃহ শিক্ষিকা রেখে নূরজাহানকে বাংলা, ইংরেজি এবং হাতের কাজ, সেলাই শেখান। মেয়েকে গড়ে তোলেন যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে। শৈশবে তাঁর বেশ কিছুটা সময় কাটে নিজ গ্রাম চালিতাতলিতে। গ্রাম্য বালিকা নূরজাহান বেগমের শহর জীবন শুরু হয় ১১নং ওয়েলেসলি স্ট্রিটে। সাঁতার না জানার কারণে গ্রামের বাড়ির পুকুরে পড়ে যাওয়ার সংবাদে বিচলিত প্রবাসী পিতা স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে আসেন নিজের কাছে । নূরহাজান যখন কোলকাতায় আসেন সে সময় সওগাত অফিসটিতে ছিল কবি সাহিত্যিকদের জমজমাট আড্ডা। এ আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ।নূরজাহান বেগমের শিক্ষা জীবন শুরু হয় সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলে। বেগম রোকেয়ার আগ্রহ ও একান্ত অনুরোধে তাঁর পিতা তাঁকে ওই স্কুলে ভর্তি করান। স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে তাঁর মা’র ঘোর আপত্তি ছিল ।

তিনি চাননি অল্পবয়সে মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত স্কুলে থাকাটা তাঁর মা’র পছন্দ ছিল না। কিন্তু এ আপত্তি ধোপে টেকেনি পর্দাওয়ালা গাড়ি চড়ে দিব্যি স্কুলে যাবার ব্যবস্থা চালু হয়ে গেল। ড্রাইভার এসে কোলে করে তাঁকে বাসে উঠিয়ে দিতো। ওই স্কুলে পড়ার প্রচণ্ড চাপ ছিল। বাংলা, উর্দু, ইংরেজি, আরবিসহ যে, চাপ তা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তাই এ স্কুল থেকে পরে তাঁকে ‘বেলতলা গার্লস হাই স্কুলে’ স্থানান্তরিত করা হয়। নতুন স্কুলে কয়েক বৎসর নির্বিঘ্নে লেখাপড়া চালানোর পর বেগম রোকেয়ার পুনঃঅনুরোধে তাঁর পিতা ফের তাঁকে সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল স্কুলে পাঠান। ইতোমধ্যে স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থায় বেগম রোকেয়া বেশ কিছু পরিবর্তন আনতে সমর্থ হন। দ্বিতীয়বার ভর্তি হবার পর ওই স্কুলে লেখাপড়ার ব্যাপারে বেগ পেতে হয়নি নূরজাহানের ।
নূরজাহান বেগম ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন এবং উত্তীর্ণ হন। এ স্কুলের মাধ্যমেই শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাঁর অনুপ্রবেশ ঘটে। এখানে লেখাপড়ার পাশাপাশি ছাত্রীদের নিজস্ব ইচ্ছা ও রুচি অনুযায়ী সেলাই, ড্রইং, বাগান করা, বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজাবার সুযোগ ছিল। মেধা ও মননের বিকাশের একটি পরিবেশ স্কুলে তৈরী করে। আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতা, সেলাই প্রদর্শনী, ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়। তিনি সব কিছুতেই অংশ নিতেন। এভাবে তাঁর একটি সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে ।
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে নূরজাহান বেগম ভর্তি হন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। কলেজের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য অনুষ্ঠান করার দায়িত্ব তাঁর ওপর বর্তায়। এ সবের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় লেখালেখি ও সম্পাদনা করার অভিজ্ঞতা। সমৃদ্ধ হয় তাঁর জ্ঞানভাণ্ডার ।
সে সময় অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন স্থান থেকে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য মেয়েরা এসে ভিড় জমাতো লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। এ কলেজের শতকরা ১০ ভাগ ছাত্রীই ছিল মুসলিম সম্প্রদায়ের। কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামী অনেকটা শিথিল হয়ে আসার ফলে মুসলিম মেয়েরা শিক্ষা, সঙ্গীত, নৃত্য ও অভিনয় জগতে পা রাখতে উৎসাহ বোধ করে। মুসলিম মেয়েরা সাহসী হতে থাকেন ক্রমে ক্রমে ।
নূরজাহান ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে স্নাতক পরীক্ষায় অংশ নেন। স্নাতক পরীক্ষার পর শুরু হয় দেশজুড়ে রাজনৈতিক অশান্তি । এ সময়টাতে নূরজাহান বেগম শিল্প সাহিত্যের অঙ্গন হতে কিছুটা বিছিন্ন হয়ে পড়েন। সে সময় কোলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গা হয়। ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করার জন্য নূরজাহান বেগম সেবাশ্রমে যোগ দেন অন্যান্য ছাত্রীদের সাথে।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুলাই কোলকাতা থেকে মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে নারীদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ‘সচিত্র সাপ্তাহিক বেগম’ প্রকাশ করেন। এ সাপ্তাহিকের প্রথম সম্পাদিকা ছিলেন সুফিয়া কামাল। নূরজাহান বেগম ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদিকা। বাংলা ভাষায় নারীদের জন্য বেগমই হচ্ছে সর্ব প্রথম প্রকাশিত বাংলা সাপ্তাহিক। সুফিয়া কামাল সে সময় পুরোপুরি গৃহিণী ছিলেন । সংসারকর্ম ছাড়া বাইরে বের হয়ে অফিস করার মতো সময় তখন তাঁর একেবারেই ছিল না। সে জন্য নূরজাহান বেগমকে সম্পাদিকার দায়িত্ব পালন করার জন্য মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন নিয়োগ দেন। সেই থেকে পিতার সাথে সাধ্যমত কাজ করা শুরু হয়। নারীদের সাহিত্য ক্ষেত্রে উৎসাহিত করার জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন এবং এখনও করছেন। পিতার মৃত্যুর পর আজো তিনি একাগ্রচিত্তে তাঁর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। প্রথম যখন সাপ্তাহিক বেগম প্রকাশিত হয়, সে সময়টা মুসলিম নারীদের জন্য অনুকূল ছিল না। নারীদের দায়িত্ব ছিল প্রধানত রান্নাঘর কেন্দ্রিক। শিক্ষিত নারীদের বাইরে এসে কাজ করার মত পরিবেশ তখন পর্যন্ত ছিল না। সমাজও ভালো মনে করতো না। নারীদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ সুবিধা ছিল না । এ সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও মুসলিম নারী সমাজকে সামনের দিকে টেনে আনার উদ্যোগ নেন নাসির উদ্দিন।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বেগম নিয়মিত তিন বৎসর কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। এরমধ্যে ৩টি বিশেষ সংখ্যাও ছিল। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ঈদ সংখ্যা ‘বেগম’ বের হয়। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ঈদ সংখ্যা ও বিশ্বনবী সংখ্যা একত্রে বের হয়। বিশ্বনবী সংখ্যা প্রকাশের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রথমত ধর্ম সম্পর্কে, নিজের অধিকার সম্পর্কে ইসলাম কি দিয়েছে, সে বিষয়ে মেয়েদের সচেতন করা।
১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ৬৬, লয়ালস্ট্রীট, পাটুয়াটুলীতে তিনি ‘বেগম’ ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। এ ক্লাবের সভানেত্রী ছিলেন শামসুন্নাহার মাহমুদ এবং সম্পাদিকা ছিলেন নূরজাহান বেগম। ১৫ থেকে ১৬ জন মহিলা নিয়ে শুরু হয় বেগম ক্লাবের অগ্রযাত্রা। এক সময় এর সদস্য সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়ে যায়। এ ক্লাবের মাধ্যমে তৎকালীন ঢাকার বিভিন্ন স্তরের গুণী নারীরা একত্রিত হয়ে নানান সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন। পরে সুষ্ঠু সমাধান দিতেন। এ ছাড়া নিজেদের মধ্যে অভিজ্ঞতাও বিনিময় করতেন। এভাবে তারা একে অপরের কাছাকাছি আসার সুযোগ লাভ করেন। ধর্ম, বর্ণ, সব মিলিয়ে এ ক্লাবটি ছিল একটি ধর্ম নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান ।১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে নূরজাহান বেগমের বিয়ে হয় শিশু সাহিত্যিক রোকনুজ্জামান খানের সাথে। সে সময় বেগম পত্রিকার বয়স ছিল পাঁচ। বিয়ের পর তিনি তাঁর কর্মক্ষেত্রে পান স্বামীর অকুণ্ঠ সহযোগিতা ।
সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য বিভিন্ন সংস্থা থেকে তিনি যুগপৎভাবে পুরস্কৃত ও সংবর্ধিত হয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও লেখিকা সংঘ। অনেক বন্ধুর পথ অতিক্রম করে আজ তিনি সাফল্যের শীর্ষে। নূরজাহান বেগম নারীদের সমস্যা হিসেবে নারীর অশিক্ষাকেই দেখেন। এছাড়া ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতন তাঁকে ভীষণ ভাবে পীড়া দেয়। ২০১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি একুশে পদক লাভ করেন।
২০১৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি পরলোক গমন করেন।




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ