গঞ্জের আলী (gonger ali jibon)

প্রথম পাতা » জীবনী » গঞ্জের আলী (gonger ali jibon)


গঞ্জের আলী জীবন

গঞ্জের আলী   শৈশবকাল থেকেই শান্ত ভদ্র ও নম্র স্বভাবের ছিলেন। সাধারন শিশুর চেয়েছিলেন ব্যতিক্রম। তার শোভনীয় মোহনীয় আচরণ এবং ভিন্ন মাত্রার চলাফেরা দেখে এলাকার বয়স্ক মরুব্বিগন অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, আলী একদিন বড় মাপের কিছু হবে। সোনা বরন উজ্জ্বল গায়ের রং বুদ্ধিদ্বীপ্ত চেহারা মৃদুভাষী মিশুক গঞ্জের আলী। শৈশবেই গ্রামবাসীর নজর কাড়ে। সকলের হৃদয় নিসৃত স্নেহ ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আনন্দে উল্লাসে বেড়ে উঠেন। হাটি হাটি পা পা করে গঞ্জের আলীর ছয় বছর হয়। বাবা মা উপলব্দি করেন তাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে হবে। সচেতন দায়িত্ব পরায়ণ মাতা এছাতন বেওয়া হাত ধরে নিয়ে পাইকশা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। অত্র বিদ্যালয় থেকেই গঞ্জের আলী ৫ম শ্রেণি পাশ করেন। পড়া লেখায় মনোযোগী নিয়মানুবর্তী মেধাবী শান্ত ভদ্র বলে শিক্ষকগণ তাকে খুব স্নেহ করতেন। দেখতে সুন্দর আচরণ সুন্দর তাছাড়া তার গানের গলাটাও বেশ মিষ্টি। সহপাঠী বন্ধুরা প্রায়ই বায়না ধরতেন একটা গান ধর। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়াকালীন ৭ বছর বয়স থেকেই গঞ্জের আলী গান গাওয়া শুরু করেন। করবেন না কেন গান সুর তাললয় যে তার জন্মগত মজ্জাগত। শিরা উপশিরায় রক্তের কনায়কনায় অনু পরমানুত গানের সুর ভেসে বেড়ায়। কারন তার বাবা মরহুম হারান আলী গ্রামীণ জারী সারি লিখতেন, সুর করতেন গাইতেন। জারী সারির দল তৈরি করে তাদের কে গাওয়াতেন। বাড়িতে বাবা নিয়মিত সাপ্তাহিক গানের আসর বসাতেন। বলা যায় বান্ধা আসর । সঙ্গীতচর্চা গঞ্জের আলীর পারিবারিক ঐতিহ্য গত। পারিবারিক সূত্রে পাওয়া গানই গঞ্জের আলীর প্রাণ। তাঁতী সম্প্রদায়ে তার জন্ম তাই তাঁতী সম্প্রদায়ের গানের প্রতি বিশেষ অনুরাগ, তাছাড়া সিরাজগঞ্জের আঞ্চলিক গান,শিশুকাল থেকে শুনতে শুনতে অবচেতনভাবেই আঞ্চলিক গানের প্রতি আসক্ত জন্ম নিয়েছে। শুরু থেকেই আঞ্চলিক ও তাঁতির গান করেন। পড়া লেখা ও গানে সময় বয়ে যায়। অত্যন্ত ভাল ফলাফল নিয়ে ৫ম শ্রেণি তে উত্তীর্ণ হন ।
এবার ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তির পালা। অভাবের সংসার সামান্য খরচ করতে হাজারটা ভাবতে হয়। বাবা আদমজী জুট মিলে চাকুরি করেন।সামান্য বেতনের চাকুরি, যা দিয়ে কোনরকম সংসার চলে। গান বাবার নেশা। গানের প্রতি গভীর ভালোবাসার জন্যই গান। অর্থ প্রাপ্তির আশায় নয়,বরং প্রতিনিয়ত অর্থ ব্যয় হতো। গান কেন্দ্রিক বন্ধুবান্ধব শিষ্যবৃন্দ ভক্ত অনুরাগীদের যথাযোগ্য মর্যাদায় আপ্যায়ন করতে হতো। সামান্য বেতনের টাকায় এতসব খরচ সামলানোর জন্য হিমসিম খেতে হতো। যাই হোক বহু কষ্টে আদরের গঞ্জের আলীকে সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ থানাধীন কোনাবাড়ি ইছাহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করেন। এখন বই কিনতে হবে। ৬ষ্ঠ শ্রেণীর বইয়ের জন্য ৬ টাকা প্রয়োজন। ৫ম শ্রেণীর বই ৫ টাকায় বিক্রি করেছেন, আরো ১টি টাকা প্রয়োজন। কিন্তু ১টি টাকা কোনভাবেই যোগার হলোনা। ৩ মাস চলে গেলো, সহপাঠিদের বই ধার করে পড়া শিখে ক্লাসে স্যারদের পড়া দেন, গঞ্জের আলী। বন্ধুরা বিরক্ত। কত দিন এভাবেবই ধার দেবে। গঞ্জের আলী হতাশ, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। অনেক বড় হওয়া তার স্বপ্ন। যেই স্বপ্নের বাস্তব রূপ দেখতে প্রয়োজন পড়া লেখা। পড়া চালিয়ে যাবার প্রবল আকাঙ্ক্ষা তার। কিন্তু বাস্তবতাতাকে ঠেলে দেয় ভিন্ন পথে। অনেক কান্নাকাটি করেও বই না পাওয়ায় ডানা ভাঙ্গা পাখির মত ধাপড়াতে ধাপড়াতে ভগ্ন হৃদয়ে পড়া লেখা ছেড়ে দেন। কাল ক্ষেপণ না করে বড়ভাইয়ের তাঁতে বসে তাঁত বোনা শিখতে শুরু করেন। কারণ বাবা তখন আবসরপ্রাপ্ত অসুস্থ। প্রখর মেধাবী গঞ্জের আলী মাত্র দুই সপ্তাহে তাঁত বোনা শিখেন এবং বোনার কাজ শুরু করেন দিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাঁত বুনে সপ্তাহে ২.৫০/৩ টাকা উপার্জন হতো। তাঁত বুনতে বুনতে, তাঁতের গানের প্রতি বিশেষ ঝোক চলে আসে। স্বতন্ত্র বৈশিষ্টে সমোজ্জল তাঁতি সম্প্রদায়ের প্রাত্যাহিক জীবনধারা, আনন্দ বেদনা সুখ দুঃখমান অভিমান প্রেম বিরহ ধর্ম দর্শন ইহ লৌকিক পরলৌকিক চিন্তা ভাবনাসহ জীবনের নানা সরল জটিল অব্যক্ত কথামালা গানের কথা ও সুরের মূর্ছনায় খুজে পাওয়া যায়। জাতশিল্পী গঞ্জের আলী তাই তাঁতীর গানেই স্বীয় জনমের স্বফলতা খুঁজে পান। তিনি তাতির গান করেন হৃদয় থেকে। গভীর মমতায় গান করেন। আত্মিক প্রশান্তি খুঁজে পান এ গানে। স্বীয় সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে অন্তরঙ্গ মেলা মেশার ফলে একটু বেশিই ভালোবেসে ফেলেছেন তাদেরকে। তাদের চোখে জল দেখলে তার চোখে রক্ত আসে। শিক্ষা দীক্ষা অর্থ বিত্ত ও মানমর্যাদায়পিছিয়ে থাকা সুবিধা বঞ্চিত তাঁতীসম্প্রদায়ের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য কিছু করার তাড়না বুকে গভীর থেকে সদা তাড়িত করে। কিভাবে কি করা যায়, অন্তহীন ভাবনায় হারিয়ে যান, ভাবতে ভাবতে কোন এক শুভক্ষণে বুঝতে পারেন তাদের সকল সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা না থাকলেও এ সম্প্রদায়ের জীবন সম্ভাবনার কথা দেশ তথা সারাবিশ্বে গানে গানে সুরে সুরে তো পৌঁছে দিতে পারি। সেই থেকে গান গাওয়ার পাশাপাশি গান রচনা ও সুর করা শুরু করেন। ১৯৬৯ সালে লাহিরি বাড়ি পাইকশার আব্দুল গনি সাহেবের মেয়ে আনোয়ারা বেগম কে বিয়ে করেন তিনি গঞ্জের আলীর জীবনে আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ আশীর্বাদ হয়ে আসেন ৷ গুণবতী এই নারী সংসারের সব ঝামেলা সামলানোর পাশাপাশি গঞ্জের আলী কে গানে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। গঞ্জের আলী আউল বাউল এর মত এখানে সেখানে ঘুরে ঘুরে গা নকরতেন। তার স্ত্রী তাকে বাড়িতে বসে গান করার সুযোগ করে দেন। তার রেওয়াজে যেন কোন সমস্যা না হয় সে জন্য তিনি নজর রাখতেন । পাড়া প্রতিবেশী বাড়িতে ঢুকে যেন কোন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করতে পারে। তার প্রচেষ্টায় গুণজর আলী গানে একটু একটু করে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। কাল ক্রমে তার গানের ভক্ত অনুরাগী বাড়তে থাকে। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ে তার সুখ্যাতি। ক্রমান্বয়ে নিজ থানা জেলা অতিক্রম করে রাজধানী ঢাকা আরো অনেক জেলায় গানের দাওয়াত পান। ১৯৯৫ সালে বাংলার বাউল সম্রাট রহমান বয়াতির সাথে একান্ত আলোচনারত অবস্থায় বাংলা একাডেমীর লোকসংগ্রাহক ও গবেষক, লোকসংস্কৃতি বিশারদ মোহাম্মদ সাইদুর হাজির হন। আব্দুর রহমান বয়াতী সাহেব পরিচয় করিয়ে দেন, বলেন উনি তাঁতী সম্প্রদায়ের গান ও সিরাজগঞ্জের আঞ্চলিক গানের শিল্পী নাম গঞ্জের আলী জীবন। মোহাম্মদ সাইদুর একটি ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বলেন আগামীকাল আমার অফিস বাংলা একাডেমীতে আসবেন। গঞ্জের আলী পরদিন যথাসময়ে মোহাম্মদ সাইদুর সাহেবের সাথে দেখা করেন। সাইদুর সাহেব দুটি দায়িত্ব প্রদান করেন। (১) তাঁতী গান/সিরাজগঞ্জের আঞ্চলিক গান। (২) নকশিকাথা সংগ্রহ করতে বলেন। সেদিন থেকে গঞ্জের তাঁতীর গান রচনা পরিবেশনার পাশাপাশি সংগ্রহ করার কাজেও বিশেষ মনোনিভেষ করেন। মোহাম্মদ সাইদুরের সাথে বাংলাদেশের প্রায় বেশিরভাগ লোক সঙ্গীত শিল্পীর সুসম্পর্ক ও যোগাযোগ ছিল। সেই জন্য জাতীয় পর্যায়ে যে কোন সঙ্গীতানুষ্ঠান হলেই মোহাম্মদ সাইদুর সাহেবকে শিল্পী নির্বাচন ও আমন্ত্রনের দায়িত্ব দিতেন। সে সুবাদে তাঁতীর গানের জন্য গঞ্জের আলী জীবনকে বহুবার জাতীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠানে ডেকেছেন। যথাক্রমে বাংলা একাডেমী, জাতীয় শিল্পকলা একাডেমী, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘরসহ অগণিত প্রতিষ্ঠানে গঞ্জের আলীকে দিয়ে তাঁতীর গান করিয়েছেন। বিভিন্ন জেলার অনুষ্ঠানে ও গঞ্জের আলী তাঁতির গান আঞ্চলিক গান পরিবেশন করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। সেজন্য অগনিত মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা এবং অনেক পুরষ্কার সম্মাননা ও সনদ পেয়েছেন উল্লেখ্য কওমী জুট মিল সিরাজগঞ্জ ২০০৫ (সংবর্ধনা) শিল্পকলা একাডেমী সিরাজগঞ্জ ২০১৮ (সংবর্ধনা) মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়, ঢাকা ।
গুণজর আলী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখেন। উনি তাঁতের কাপড়ের ফেরিওয়ালা সেজে মুক্তিবাহিনির পক্ষে গুয়েন্দার কাজ করতেন। পাকিস্তানি মিলিটারির বিভিন্ন ক্যাম্পে গিয়ে খবরা খবর সংগ্রহ করে মুক্তি বাহিনীদের কাছে দিতেন। তিনি শরণার্থী শিবিরে গিয়ে গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপনা দিতেন। গুণজর আলী ও আনোয়ারা বেগমের সংসারে তিন ছেলে এক মেয়ে। (১) আনোয়ার হোসেন (২) জিয়াউর রহমান (৩) আমিনুল ইসলাম (৪) পারুল পারভিন। এই দম্পতি নিজেরা স্বল্পশিক্ষিত হলেও ছেলে মেয়েদের সর্ব উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন। বিশেষ করে আনোয়ারা খাতুন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। রাত দিন চরকায় সুতা কেটে ছেলে মেয়েদের খাতা কলমের যোগান দিতেন। এই মহীয়সী নারীর অবদানেই ছেলে মেয়েরা সর্ব উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত এবং কর্ম ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। গুণজর আলী রজীবনেএকজন বৈষ্ণবীর অবদান অবিস্মরণীয়। বৈষ্ণবী কে তিনি মা বলে ডাকতেন। বৈষ্ণবীর সান্নিধ্য গুণজর আলীকে আমূল পরিবর্তন করে দেয়। তার মধ্যে আধ্যাত্মিক চিন্তার উদয়করে। প্রাণবন্ত হাস্যেজ্জল এই মানুষটি প্রায়ই ভাবনার অতল গহীনে হারিয়ে যান। জাগতিক ভাবনা অতিক্রম করে স্রষ্টা সৃষ্টি প্রকৃতির ভাবনায় আচ্ছন্ন থাকেন। মহাজগতের মহাস্রষ্টার মহাপরিকল্পনায় পরিচালিত দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান ভ্রমান্ডের বিচিত্রলীলা অবলোকন করেন গভীর অভিনিবেশ সহকারে। কঠোর সাধনা ও সাধু সন্যাসীদের সান্নিধ্য তার জীবনকে করেছে প্রেমময় ও আলোকিত। যার প্রচ্ছন্ন ছায়া তার গানে বিচ্ছুরিত হয়েছে।

তথ্যসূত্র: .২০২২ সালে প্রকাশিত ‘গঞ্জের আলীর উওরবঙ্গের আঞ্চলিক তাঁতের গান’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।