ফিওদর মিখাইলভিচ দস্তয়ভস্কি (Fyodor Mikhail Dostoevsky)
প্রথম পাতা » জীবনী » ফিওদর মিখাইলভিচ দস্তয়ভস্কি (Fyodor Mikhail Dostoevsky)ফিওদর মিখাইলভিচ দস্তয়ভস্কি
(১৮২১-১৮৮১)
তাঁর সম্বন্ধে বলা হয় তিনি লেখকের লেখক ফিওদর দস্তয়ভস্কি (জন্ম অক্টোবর ৩০, ১৮২১। মৃত্যু ২৮ জানুয়ারি, ১৮৮১)। সাত ভাইবোনের মধ্যে দস্তয়ভস্কি ছিলেন পিতামাতার দ্বিতীয় সন্তান। পিতা মিখায়েল আন্দ্রিয়েভিচ ছিলেন মস্কোর এক হাসপাতালের ডাক্তার। কয়েক বছর পর দস্তয়ভস্কির পিতা টুলা জেলায় Darovoye তে একটা সম্পত্তি কিনলেন। প্রতিবছর গ্রীষ্মের ছুটিতে মা ভাই বোনেদের সাথে নিয়ে সেখানে বেড়াতে যেতে দস্তয়ভস্কিকে পাঠিয়ে দেওয়া হল Chemak’s বোর্ডিং স্কুলে। তিন বছর সেখানে (১৮৩৪-৩৭) পড়াশুনা করার পর বাড়িতে ফিরে এলেন দস্তয়ভস্কি। এক বছরের মধ্যে মার মৃত্যু হল।
স্ত্রী মৃত্যু মাইকেলের জীবনে এক পরিবর্তন নিয়ে এল। শহরের পরিমণ্ডলে থাকতে আর ভাল লাগল না, হাসপাতালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে পাকাপাকিভাবে গ্রামে গিয়ে বসবাস করতে আরম্ভ করলেন। দস্তয়দস্কি আর তার ভাইকে ভর্তি করে দিলেন মিলিটারি ইনজিনিয়ারিং একাডেমিতে।
গ্রামে গিয়ে অল্পদিনেই সম্পত্তি বাড়িয়ে ফেললেন মাইকেল। মাইকেলে অত্যাচার অন্যায় আচরণে প্রজাদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠতে থাকে। কয়েকজন তাঁর কোচওয়ানের সাথে শলাপরামর্শ করে নির্জনে নিয়ে গিয়ে তাকে হত্যা করল। পিতার মৃত্যু দস্তয়ভস্কির জীবনে নিয়ে এল বিরাট আঘাত।
পিতা নিহত হবার পর এক অপরাধবোধ তাঁর মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। পিতার মৃত্যুর পর নিজেকেই অপরাধী বলে মনে হল তাঁর। এর থেকে জন্ম নিল এক অসুস্থ মনোবিকার। তাই পরবর্তীকালে কোন মৃত্যু শোক আঘাত উত্তেজনার প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এলেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তেন, ঘন ঘন দেখা দিত মৃগীরোগ। সমস্ত জীবনে আর তিনি এই রোগ থেকে মুক্তি পাননি।
ইনজিনিয়ারিং একাডেমি থেকে পাশ করে সামরিক বিভাগে ডিজাইনারের চাকরি নিলেন। নিঃসঙ্গতা ক্লান্তি ভোলবার জন্য জুয়ার টেবিলে গিয়ে বসেন দস্তয়ভস্কি। অধিকাংশ দিনই নিজুের শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে আসেন। মাইনের টাকা কয়েকদিনের মধ্যেই ফুরিয়ে যায়।
অর্থ সংগ্রহের তাগিদে ঠিক করলেন ফরাসী জার্মান সাহিত্য অনুবাদ করলেন। তিনি এবং তার ভাই মিখায়েল একসঙ্গে ফরাসী সাহিত্যিক বালজাকের উপন্যাস অনুবাদ করতে আরম্ভ করলেন। ১৮৪৪ সালে একটি রাশিয়ান পত্রিকায় তা প্রকাশিত হতে আরম্ভ হল। কিছু অর্থও পেলেন।
ক্রমশই চাকরির জীবন অসহ্য হয়ে উঠল। সাহিত্য জগৎ তাঁকে দুর্নিবারভাবে আকর্ষণ করছিল। তিনি চাকরি ছাড়লেন। নিজেকে পুরোপুরি উৎসর্গ করলেন সাহিত্য সাধনায়।
৩০শে সেপ্টেম্বর ১৮৪৪ তার ভাইকে একটা চিঠিতে দস্তয়ভস্কি লিখলেন “একটা উপন্যাস শেষ করলাম। এটা সম্পূর্ণ আমার নিজের লেখা। এখন পাণ্ডুলিপি থেকে নকল করছি। একটা পত্রিকায় পাঠাব। জানি না তারা অনুমোদন করবে কি না। তা আমি এই রচনায় সন্তুষ্ট হয়েছি।”
প্রথম উপন্যাস পুতুর ফোক বা অভাজন প্রকাশিত হওয়ার পর কয়েকটি ছোট গল্প রচনা করলেন দস্তয়ভস্কি। তারপর লিখলেন তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস “দি ডবল”। প্রথম উপন্যাসে তিনি লেখক হিসাবে পরিচিতি পেয়েছিলেন, দ্বিতীয় উপন্যাসে পেলেন খ্যাতি। তার লেখার মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছিল মানুষের বেদনাময় জীবনের ছবি। মানুষ সহজেই। তাঁর রচনার প্রতি আকৃষ্ট হল। সমাজের শিল্পী সাহিত্যিক সমালোচক মহলের দ্বার তার কাছে উন্মুক্ত হল।
এই সময় দস্তয়ভস্কির জীবনে নেমে এল বিপর্যয়। রাশিয়ার সম্রাট জার ছিলেন এক অত্যাচারী শাসক। তাঁর শাসনের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছিল ছোট ছোট সংগঠন। এক বন্ধুর মারফত দস্তয়ভস্কি পরিচিত হলেন এর একটি সংগঠনের সাথে এদের আসর বসত প্রটাসভস্কি নামে এক তরুণ সরকারী অফিসারের বাড়িতে।
কিন্তু অত্যাচারী জার প্রথম নিকোলাসের গুপ্তচরদের নজর এড়াল না। তাদের মনে হল এরা রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। রিপোের্ট গেল সরকারী দপ্তরে। যথারীতি একদিন প্রটাসভস্কির আসর থেকে বাড়িতে ফিরে এসে খাওদা-দাওয়া করে রাত্রিতে ঘুমিয়ে পড়লেন দস্তয়ভস্কি। হঠাৎ শেষ রাতে পুলিশের পদশব্দে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। চেয়ে দেখলেন তাঁর ঘরে জারের পুলিশ বাহিনী। কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই তাঁকে গ্রেফতার করা হল (এপ্রিল ১৩,১৮৪৯)।
অন্য অনেকের সাথে তাকে বন্দী করে রাখা হল আলোবাতাসহীন ছোট্ট একটি কুঠুরিতে। দিনে মাত্র তিন-চারবার ঘরের বাইরে আসার সুযোগ মিলত। এক দুঃসহ মানসিকতার মধ্যেই তিনি রচনা করলেন একটি ছোট গল্প “ছোট্ট নায়ক” A little Hero)।
নানান প্রশ্ন অনুসন্ধান-তারপর শুরু হল বিচার। বিচারে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য দণ্ডাদেশ পত্র পাঠিয়ে দেওয়া হল সম্রাট নিকোলাসের কাছে। সম্রাট তাদের মৃত্যুদণ্ড রোধ করে সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দিলেন। দস্তয়ভস্কির চার বছরের জন্য সাইবেরিয়ায় নির্বাসন আর তারপর চার বছর সৈনিকের জীবন যাপন করবার আদেশ দেওয়া হল।
খ্রিস্টমাস ডেতে পায়ে চার সের ওজনের লোহার শেকল পরিয়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল সাইবেরিয়ার বন্দীনিবাসে (জানুয়ারি ১৮৫০)। চারদিকে নরকের পরিবেশ। খুনী বদমাইশ শয়তানের মাঝখানে দস্তয়ভস্কি একা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত। ছোট অন্ধকার কুঠুরিতে শীতকালে অসহ্য ঠাণ্ডা। ছাদের ফুটোদিয়ে বরফ ঝরে পড়ে মেঝেতে পুরু হয়ে যায়। কনকনে তুষারজড়ে হাত-পা ফেটে রক্ত ঝরে। গ্রীষ্মের দিনে আগুনের দাবদাহ।
তারই মাঝে হাড়ভাঙা খাটুনি। ক্লান্তিতে, পরিশ্রমে শরীর নুয়ে পড়েছে। সে তার জীবনের এক মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার কথা পরবর্তীকালে জ্বলন্ত অক্ষরে লিখে গিয়েছেন তাঁর The house of the Dead (মৃত্যুপুরী) উপন্যাসে।
দীর্ঘ চার বছর (১৮৫০-১৮৫৪) সাইবেরিয়ার বন্দীনিবাসে কাটিয়ে অবশেষে লোহার বেদির বন্ধন থেকে মুক্তি পেলেন।
ওমস্কের বন্দীনিবাস থেকে দস্তয়ভস্কিকে পাঠানো হল সেমিপালতিনস্ক শহরে। কিন্তু সামরিক জীবনের নিয়ম-শৃঙ্খলা কুচকাওয়াজ তার রুগ্ন শীর্ণ অসুস্থ অনভ্যস্ত শরীরে মাঝে মাঝে অসহনীয় হয়ে উঠত। তবুও নিজের যোগ্যতার কিছুদিনের মধ্যেই সামরিক বিভাগে উঁচু পদ পেলেন।
এই সময় শহরের প্রধান সেনানায়ক জানতে পারলেন তাঁর সৈন্যদলের মধ্যে একজন শিক্ষিত লেখক আছেন। তিনি দস্তয়ভস্কিকে ডেকে পাঠালেন। তারপর থেকে প্রতিদিন দস্তয়ভস্কি তার বাড়িতে গিয়ে তাঁকে খবরের কাগজ পড়ে শোনাতেন।
এখানেই একদিন পরিচয় হল এক মদ্যপ সরকারী কর্মচারী আলেকজাণ্ডার ইসায়েভ এবং তার সুন্দরী তরুণী স্ত্রী মারিয়া ডিমিট্রিয়েভনার সাথে। তারপর থেকে শুরু হল তাঁর সেখানে যাতায়াত।
এর কিছুদিনের মধ্যে ইসায়েভ বদলি হয়ে গেলেন চারশো মাইল দূরের এক শহরে। মারিয়ার অদর্শনে আবার মানসিক দিক থেকে বিপর্যয় হলে গেলেন দস্তয়ভস্কি।
কয়েক মাস পর তার স্বামী মারা গেলেন। বছর খানেক পর একদিন দস্তয়ভস্কি গেলেন মারিয়ার কাছে। সেখানে গিয়ে যা দেখলেন তাতে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। মারিয়া এক তরুণ স্কুল শিক্ষকের প্রেমে পড়েছে। অনেক অনুনয়-বিনয় করে তার মত পরিবর্তন করতে সক্ষম হলেন।
১৮৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুজনের বিয়ে হল। সারা দিনের পরিশ্রম উত্তেজনায় বাসরঘরেই মূৰ্ছিত হয়ে পড়লেন দস্তয়ভস্কি। সুখের পাত্র পূর্ণ হবার আগেই অপূর্ণ রয়ে গেল সব আকাঙ্ক্ষা।
আরো দুবছর থাকার পর শেষ হল তাঁর বন্দী জীবন। সামরিক বিভাগের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে স্ত্রী পুত্রকে নিয়ে এসে বাসা বাঁধলেন মস্কোর কাছাকাছি টিভর শহরে।
এবার সাইবেরিয়ার নির্বাসিত জীবনের অভিজ্ঞতাকে অবলম্বন করে লিখলেন The house of the Dead (মৃতের পরী)।
কিন্তু কে প্রকাশ করবে এই অখ্যাত তরুণের লেখা! দস্তয়ভস্কির বড় ভাই মাইকেলের সঙ্গে মিলিতভাবে প্রকাশ করলেন একটি পত্রিকা “সময়” (Time)। এতেই প্রকাশিত হল The house of the Dead।
প্রকাশের সাথে সাথে দস্তয়ভস্কির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। সাইবেরিয়ার বন্দী জীবনের ছবি ইতিপূর্বে আর কোন লেখকের রজনাতেই এমন মূর্ত হয়ে ওঠেনি। খ্যাতির সাথে অর্থও আসতে আরম্ভ করল। কিন্তু মারিয়ার বিলাস-ব্যসনের সাথে তাল রাখতে ব্যর্থ হলেন দস্তয়ভস্কি।
যন্ত্রণা হতাশা ভোলবার জন্য ক্রমশই তিনি সৃষ্টির গভীরে ডুব দিলেন। এই সময় দস্তয়ভস্কির জীবনে এল পলিনা। এক প্রাণ-উচ্ছল সুন্দরী তরুণী।
দুজনে গেলেন ফ্রান্সে। কিন্তু পলিনাকে কাছে পেলেন না দস্তয়ভস্কি। এক পুরুষে মন ভরে না তার। বিচ্ছেদ ঘটে গেল দুজনের। ততদিনে হাতের অর্থও ফুরিয়ে এসেছে। জুয়ার নেশায় মাতালের দস্তয়ভস্কি। এক একদিন সব হারিয়ে গায়ের কোট খুলে দিয়ে আসতেন। কোনদিন বা জিততেন কিন্তু তার পরদিন আবার সব হারাতেন। এই জুয়াড়ি জীবনের অভিজ্ঞতাকে অবলম্বন করেই তিনি পরবর্তীকালে লিখেছিলেন “জুয়াড়ি”।
ইতিমধ্যে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল মারিয়া। তার সেবা-যত্নের কোন ত্রুটি করলেন। কিন্তু তাঁর সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে ১৮৬৪ সালের এপ্রিল মাসে মারা গেল মারিয়া।
স্ত্রীর মৃত্যুর মাত্র তিন মাস বাদে মারা গেলেন বড় ভাই মাইকেল। মাইকেলের মৃত্যু তাঁর কাছে অনেক বেশি আঘাত নিয়ে এল। তাঁর জীবনের অনেকখানি জুড়ে ছিল ভাইয়ের অস্তিত্ব।
এই দুঃখের মধ্যেই রচনা করলেন তাঁর “অপরাধ এবং শাস্তি” Crime and Punishment)। এক অনন্য সাধারণ উপন্যাস। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে যে কটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস আছে, এটি তার মধ্যে একটি। কাহিনীর নায়ক রাসকলনিভ। দরিদ্র, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, আদর্শবাদে বিশ্বাসী। কিন্তু দারিদ্র্যের চাপে তার আদর্শবাদের বন্ধনটুকু শিথিল হয়ে পড়তে থাকে। বাড়ি থেকে খবর আসে সংসারের অভাব দূর করবার জন্যে ছোটবোন দুনিয়া ধনী লুজানকে বিয়ে করতে চলেছে। এক প্রচণ্ড মানসিক অস্থিরতার মধ্যে সে কিছু অর্থ ধার করতে গেল শহরের এক বুড়ির কাছে। বুড়ির বন্ধকী ব্যবসা। একাই থাকে বুড়ি। তার ঘরে জমিয়ে রাখা সোনা-দানা দেখে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারল না রাসকলনিভ। বুড়িকে হত্যা করল। এই সময় বুড়ির বোন এসে পড়ায় নিজেকে বাঁচাবার জন্য তাকেও হত্য করল রাসকলনিকভ। সামান্য যা পেল তাই নিয়েই পালিয়ে এল কিন্তু এবার তার মধ্যে শুরু হল মানসিক যন্ত্রণা। মনে হতে লাগল পুলিশ বুঝি সব সময় তার পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ক্রমশই এক অপরাধ বোধ তার মনের মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। এই সময় রাসকলনিকভের সঙ্গে দেখা হল সোনিয়ার। সে পতিতা। নিজের বিপন্ন পরিবারকে ক্ষুধার হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে সে এই পথ বেছে নিয়েছে। কিন্তু রাসকলনিকভ উপলব্ধি করতে পারল পাপের মধ্যে থেকেও সোনিয়ার অন্তর জুড়ে রয়েছে শুধু পবিত্রতা। তাই নিজেকে সোনিয়ার কাছে উৎসর্গ করে না। শুরু হল পাপ-পুণ্যের দ্বন্দ্ব। শেষ পর্যন্ত নিজের অপরাধ স্বীকার করে সোনিয়ার কাছে। পুলিশও বুড়ির হত্যা রহস্য উদ্ধারের জন্য চারদিকে অনুসন্ধান করতে থাকে। তারা অনুমান করে রাসকলনিকভ খুনী। কিন্তু প্রমাণের অভাবে তাকে ধরতে পারছিল না। রাসকলনিকভের মনে হল সে যে অপরাধ করেছে তার জন্যে তাকে ধরতে পারছিল না। রাসাকলনিকভের মনে হল সে যে অপরাধ করছে তার জন্যে তাকে শাস্তি পেতেই হবে। সোনিয়ার প্রেমের আলোয় সে তখন এক অন্য মানুষ। তাই পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করল। সোনিয়াও তার সাথে যাত্রা করল। সে বাসা বাধল জেলের কাছে এক গ্রামে। ভালবাসা, ত্যাগ আর পবিত্রতার মধ্যে দুজনে প্রতীক্ষা করে নতুন জীবনের।
ক্রাইম এ্যাণ্ড পানিশমেন্ট উপন্যাস রচনার পেছনে যখন তার সমস্ত মন একাগ্রতাটুকু অর্পণ করেছিলেন তখন প্রকাশকের সঙ্গে চুক্তিমত তাকে নতুন উপন্যাস জমা দেবার দিন এগিয়ে আসছিল। কিন্তু একটি লাইনও তখনো তিনি লিখে উঠতে পারেননি। হাতে মাত্র দু মাস সময়। কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। এমন সময় তার এক বন্ধু পরামর্শ দিল স্টেনোগ্রাফার রাখতে। বন্ধু তার চেনা-জানা একটি মেয়েকে পাঠিয়ে দিলেন তার কাছে।
১৮৬৬ সালের ৪ অক্টোবর কুড়ি বছরের সাদামাটা চেহারার অ্যানা এসে দাঁড়াল দস্তয়ভস্কির দরজায়।
চব্বিশ দিনের মাথায় শেষ করলেন “এক জুয়াড়ির গল্প”-এ জুয়াড়ি আর কেউ নয়, দস্তয়ভস্কি নিজেই।
চব্বিশ দিন দস্তয়ভস্কির সংসারে যাতায়াত করতে করতে অ্যানা পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করেছিলেন তার মানসিক, সাংসারিক অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলতা।
দস্তয়ভস্কির মনে হল মারিয়া, পলিনা তাঁকে যা দিতে পারেনি, সেই সংসারের সুখ হয়তো দিতে পারবে অ্যানা। তাই সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। দস্তয়ভস্কির বয়স তখন ৪৫, অ্যানার ২০। সকলের বিরোধিতা সত্ত্বেও তাঁদের বিয়ে হল।
দেনার টাকা শোধ করবার জন্য লিখতে আরম্ভ করলেন “দি ইডিয়ট”।
ইডিয়ট উপন্যাস শেষ করে কয়েক মাস আর কিছু লেখেননি দস্তয়ভস্কি। ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। এক দেশ থেকে আরেক দেশ। দারিদ্র্য তাঁর নিত্যসঙ্গী। এরই মধ্যে লিখলেন “দি এটারনাল হ্যাঁসবেন্ড” (The etemal husband), পরে দীর্ঘ উপন্যাস “দি পজেজড” (The possesed)।
দেখতে দেখতে চার বছর কেটে গেল। যাযাবরের মত ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন দস্তয়ভস্কি।
দেশে ফেরার জন্য মন টানছে কিন্তু কেমন করে ফিরবেন। হাত শূন্য। স্ত্রী, শিশুকন্যার জন্যে রাখা শেষ সম্বলটুকু নিয়ে গিয়ে জুয়ার টেবিলে বসলেন। কিন্তু সেটুকুও হারাতে হল।
এই বিপদের দিনে এগিয়ে এলেন তার এক বন্ধু। তার কাছে থেকে অর্থ সাহায্য পেয়ে দীর্ঘ চার বছরের প্রবাস জীবনের পর জুলাই ৪, ১৮৭১ স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে পিটসবার্গে ফিরলেন দস্তয়ভস্কি।
আর্থিক সংকট থেকে পুরোপুরি মুক্তি না পেলেও তাঁর সমস্ত মন জুড়ে তখন চলছিল সেই মহতী সৃষ্টির প্রেরণা। দীর্ঘ চার বছর লেখার পর ১৮৮০ সালে প্রকাশিত হল “দি ব্রাদার্স কারামাজোভ”। এক মহাকাব্যিক উপন্যাস। ব্যাপ্তিতে, গভীরতায়, চরিত্র সৃষ্টিতে ক্রাইম এ্যাণ্ড পানিশমেন্টের পাশাপাশি এই উপন্যাসও তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।
সমস্ত দেশ জুড়ে তিনি পেলেন এক অভূতপূর্ব শ্রদ্ধা আর ভালবাসা। তাকে বলা হল জাতির প্রবক্তা। ক্রমশই তার শরীর ভেঙে পড়ছিল। শেষে অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
সন্ধ্যেবেলায় চিরনিদ্রায় নিদ্রিত হয়ে পড়লেন দস্তয়ভস্কি। ৩১ বছর আগে যে পথ দিয়ে শৃঙ্খলিত অবস্থায় লোকের ধিক্কার কুড়োতে কুড়োতে গিয়েছিলেন সাইবেরিয়ার বন্দীনিবাসে, আজ সেই পথ দিয়ে হাজার হাজার মানুষের বেদনা আর ভালবাসার মধ্যে দিয়ে চললেন অমৃতলোকে।
তথ্যসূত্রঃ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী – মাইকেল এইচ. হার্ট / সম্পাদনায় – রামশংকর দেবনাথ