স্যার আইজ্যাক নিউটন (Sir Isaac Newton )

প্রথম পাতা » জীবনী » স্যার আইজ্যাক নিউটন (Sir Isaac Newton )


স্যার আইজ্যাক নিউটন

স্যার আইজ্যাক নিউটন

(১৬৪২-১৭২৭)
বিজ্ঞানের আশ্চর্য প্রতিভা নিউটন মাত্র সাত মাস বয়সেই মায়ের গর্ভ থেকে জন্মে নিশ্চিত মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন আশ্চর্যভাবে। নিজের প্রতিভায় জগৎকে আশ্চর্য করবার, চমকিত করবার পালা শুরু হয় তাঁর তখন থেকেই। এরপর দীর্ঘ জীবনে একের পর এক আশ্চর্যের মালা গেঁথে বিশ্ববিজ্ঞানের ইতিহাসকে স্বকীয় কৃতিত্বের মালিকায় ভূষিত করেছেন।

জন্মের তিন মাস আগেই বাবা মারা গিয়েছিলেন। দুবছর বয়স হতে না হতেই মা দ্বিতীয়বার বিয়ে করে বসলেন।

নিউটনের নতুন বাবা ছিলেন পাদ্রী। তিনি রোগা পটকা নিউটনের দায়িত্ব নিতে রাজি হননি। ফলে উলসথরপের খামার বাড়িতে ঠাকুমার কাছেই মানুষ হতে থাকেন তিনি।

বাবাকে হারিয়েছেন, মা নেই, নেই কোন ভাইবোন। এই অবস্থায় একাকীত্বের মধ্য দিয়ে প্রকৃতির কাছাকাছি আসবার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। চারপাশের সবকিছু খুঁটিয়ে দেখার অভ্যাস তৈরি হয়েছিল তখন থেকেই।

আর এই অভ্যাসের ফলেই তো পরিণত বয়সে একদিন গাছ থেকে আপেল পড়ার সামান্য ঘটনা থেকে মাধ্যাকর্ষণের সূত্র আবিষ্কার করে গোটা পৃথিবীকে চমকে দিয়েছিলেন।

বয়স বারো বছর পূর্ণ হতেই ঠাকুমা নিউটনকে পাঠিয়ে দিলেন গ্রাণঘাম শহরে তাঁর পরিচিতি ক্লার্ক নামে এক ভদ্রলোকের বাড়িতে।

ক্লার্ক-এর স্ত্রী ছিলেন নিউটনের মায়ের বান্ধবী। সেই সূত্রে এখানেই প্রথম তিনি মাতৃস্নেহের স্বাদ পান।

ক্লার্ক ভদ্রলোক ওষুধের ব্যবসা করতেন। নিজেই বাড়িতে তৈরি করতেন সেসব। বিজ্ঞানের বিশেষ করে রসায়ন ও পদার্থ বিদ্যায় যথেষ্ট পড়াশোনা ছিল তাঁর। পারিবারিক অবস্থাও স্বচ্ছল।

এখানে চার বছর ছিলেন নিউটন। এখানেই বিজ্ঞানী নিউটনের জীবনের ভিত তেরি হয়েছিল বলা যায়।

বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে হঠাৎ একদিন রত্নভান্ডার আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন নিউটন। চিকিৎসাবিদ্যা, রসায়ন, সৌরজগতের বিষয়ে প্রচুর বই জড়ো করা ছিল সেই ঘরে।

নিউটন সেই সব বইতে ডুবে গেলেন। সব কি আর বুঝতে পারেন, তবু পড়ার নেশায় পড়ে যান।

এইভাবে ক্লার্কের ওষুধ তৈরির ল্যাবরেটরির সন্ধানও পেয়ে যান একদিন। কৌতূহল নিয়ে কাঁচের যন্ত্রপাতি, রসায়নিক বোঝাই শিশি-বোতল সব নাড়াচাড়া করে দেখেন।

এই বাড়ির নিরিবিলি চিলেকোঠায় বসেই সর্বপ্রথম সৃষ্টির নেশায় মেতে উঠেছিলেন বালক নিউটন।

বাতাসি কলযন্ত্রের গাড়ি, জলঘড়ির নানা মডেল বানিয়েছেন তিনি। কখনও নানা রসায়নিকের গুণাগুণ পরীক্ষা করে দেখেছেন।

ক্লার্ক ভবনে নিউটনের সঙ্গী ছিল ক্লার্কের একমাত্র মেয়ে স্টোরি। বন্ধুত্বের সহজ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তাদের মধ্যে।

নিউটনের যখন মোল বছর বয়স, তখন উলসথরপ থেকে মায়ের চিঠি পেয়ে জানতে পারেন তার নতুন বাবা মারা গেছেন। জামিদারির ব্যাপার নিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন তিনি।

ক্লার্ক পরিবারের চার বছরের জীবনে ছেদ পড়ে এরপর। নিউটন উলসফরপ মায়ের কাছে চলে আসেন।

কিন্তু জমিদারির লাভক্ষতি আর চাষ-আবাদের হিসেবের মধ্যে অল্পদিনেই হাঁপিয়ে ওঠেন নিউটন। মাকে জানালেন কলেজে পড়বেন। লেখাপড়ায় ছেলের আগ্রহ দেখে মা খুশি হন। ছেলেকে পাঠিয়ে দেন কেমব্রিজে। নিউটন ভর্তি হন ট্রিনিটি কলেজে।

এই কলেজে আইজ্যাক ব্যারো নামে অঙ্কের অধ্যাপক ছিলেন খাঁটি জহুরী। নিউটনের সুপ্ত প্রতিভার পরিচয় তার কাছে গোপন রইল না।

ব্যারো নিজে ছিলেন এক প্রতিভা। বিজ্ঞান, বিশেষ করে পদার্থ বিদ্যায় তাঁর ছিল অসামান্য দখল।

নিজস্ব কিছু গবেষণাও ছিল তাঁর। ব্যারোর সুপারিশে কলেজ কর্তৃপক্ষ নিউটনকে অঙ্কে ছাত্রবৃত্তি পড়ার সুযোগ দিলেন।

এই সময় থেকেই অধ্যাপক ব্যানোর প্রেরণায় নিউটনের বিজ্ঞান প্রতিভার উন্মেষ ঘটতে থাকে। নিউটনকে তিনি জ্যামিতি ও আলোকবিজ্ঞানের রহস্যালোকের সন্ধান দেন।

অল্প সময়ের মধ্যেই গণিতের মূলনীতিগুলো নিউটন চমৎকার রপ্ত করে ফেললেন।

তবে বিশুদ্ধ গণিতের চেয়ে ব্যবহারিক গণিতই তার পছন্দ ছিল বেশি। এই গণিতের মধ্যেই ছিল প্রকৃতি জগৎ ও সৌরবৈচিত্র্যের রহস্যালোকের চাবিকাঠি।

ব্যারোর তত্ত্বাবধানে থেকে নিজের বিচারবুদ্ধি ও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিশ্লেষণ নিয়ে মেতে রইলেন নিউটন।

নিউটন বৃত্তি পান ১৬৬৪ খ্রি:। সেই বছরই গোড়ার দিকে ইংল্যান্ড জুড়ে মহামারীর আকারে দেখা দিল প্লেগ। কাতারে কাতারে লোক মরল। দিশাহারা লোক জন দলে দলে যে যেদিকে পারল শহর ছেড়ে পালাতে লাগল। অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। মড়ক-পীড়িত লণ্ডন ছেড়ে উলসথরপের খামার বাড়িতে চলে এলেন নিউটন।

এখানে এসে মায়ের সঙ্গে জমিদারি দেখাশোনার কাজে হাত লাগালেন। তবে পাশাপাশি বিজ্ঞানের গবেষণাও চালিয়ে চললেন।

উলসথরপে দেড় বছর ছিলেন নিউটন। এই সময়ের মধ্যে এক এক করে তিনটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কাজ সম্পূর্ণ করলেন।

তার প্রথম আবিষ্কার দ্বিপদতত্ত্ব অর্থাৎ দুই অংশযুক্ত রাশি ও দ্বিতীয় আবিষ্কার প্রভেদক গণনা গণিতের মৌলসূত্র।

এই দুটির বৈজ্ঞানিক নাম যথাক্রমে বাইনোমিরাল থিয়োরেম ও ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাস।

প্রভেদক গণনা গণিতের সাহায্যে অনবরত পরিবর্তনীয় রাশির পরিবর্তনের হার বার করা যায়। এই রাশিগুলোর নাম হল প্রবাহপুঞ্জ বা Fluxions।

কিছুদিনের মধ্যেই প্রবাহপুঞ্জের বিকল্প প্রবাহেরও সন্ধান পেয়ে গেলেন নিউটন। এইভাবেই পাওয়া গেল গণনা গণিতের এক শাখা অখন্ড গণনা গণিত বা ইনটিগ্রাল ক্যালকুলাস।

এই সঙ্গেই আরও একটি কাজ করলেন নিউটন। শংকুর কোন এক অংশ নিয়ে যে বক্ররেখা বা কারভ রচিত হয় সেই পরা বলয়ের ক্ষেত্রফল ও ঘনবস্তুর আয়তনের পরিমাপের উপায়ও বার করে ফেললেন।

এইভাবে জমিদারির কাজ আর নিজের গবেষণা নিয়ে দেখতে দেখতে দেড়টি বছর কেটে গেল। নিউটন আবার কেমব্রিজে ফিরে এলেন।

এখানে এসে তাঁর তিনটি গবেষণা প্রকাশ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে গণিত বিজ্ঞানী মহলে সাড়া পড়ে গেল। প্রভেদক গণনা গণিতের উদ্ভাবক হিসাবে বিজ্ঞানী মহল তাকে স্বীকৃতি জানাল।

কোপারনিকাশের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব থেকে নিউটন জেনেছিলেন, গ্রহমণ্ডলী অধিবৃত্ত পথে নিজ নিজ কক্ষে ঘুরপাক খায়। গ্যালিলিওর গতিসূত্র ও চলমান বস্তুর যান্ত্রিকতা সম্পর্কেও তাঁর ধারণা পরিষ্কার ছিল। এই ধারণার ভিত্তিতেই তাঁর দ্বিতীয় আবিষ্কার রূপ পেয়েছিল।

সেইকালে বিজ্ঞানীরা জানতেন না গ্রহরা নিজ নিজ কক্ষপথে কার প্রভাবে নিয়মিতভাবে আবর্তিত হয়ে চলেছে।

নিউটন তার অঙ্কের সাহায্যে বুঝতে পারলেন যে সূত্রের সাহায্যে পৃথিবীর সমস্ত বস্তু ও তাদের গতির নিয়ন্ত্রণ ঘটে সেই একই সূত্রের প্রভাবে সৌরজগতের গ্রহতারকাদের কক্ষনির্ভর আবর্তনও নিয়ন্ত্রিত হয়। যে সূত্র বা বলের টানে গাছের আপেল আকাশে না উঠে মাটিতে এসে পড়ে, সেই একই বল সৌরমন্ডলের গ্রহতারাদেরও পরিচালিত করে।

নিউটন এই বলেরই নাম দিলেন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি। যে সূত্রের সাহায্যে তিনি এই। বলকে প্রকাশ করলেন তারই নাম হল মাধ্যাকর্ষণ সূত্র বা Law of gravitation।

এরপর নিউটন দেখলেন যেই অভিকর্ষ বলকে কেন্দ্র করে সৌরস্তুদের নড়াচড়া সেই কেন্দ্র থেকে সৌর বস্তুর দূরত্বের বর্গের বিষয়ানুপাতিক। অর্থাৎ কেন্দ্র থেকে সৌর বস্তুর দূরত্ব যদি বাড়ে অভিকর্ষ কমে আসে, আবার যদি দূরত্ব কমে অভিকর্ষ বলের পরিমাণও বেড়ে যায়।

নিউটন তার আবিষ্কৃত মাধ্যাকর্ষণ সূত্র ও অভিকর্ষ বলের কথা বাইরে প্রকাশ করবার আগেই বুঝতে পারলেন, এই মহাসত্য ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই পদার্থ বিজ্ঞান ও সৌরবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিপ্লব উপস্থিত হবে, নিয়ে আসবে নতুন যুগ।

আবিষ্কৃত সত্যকে দৃঢ় মূল ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য পুনঃ পুনঃ বিশ্লেষণ ও পরীক্ষার দরকার। তাই নিয়েই মেতে উঠলেন তিনি।

১৬৬৫-৬৬ খ্রি: মধ্য নিউটন আবিষ্কার করলেন আলোর প্রতিসরণ সূত্র বা Law of Refraction of light।

তিনি দেখলেন, এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে ঢুকবার সময় আলো যে বাঁক নেয়, তার পরিমাণ নির্ভর করে মাধ্যমের ঘনত্বের ওপর।

ইতিপূর্বে তেলা কাঁচ মাধ্যম বা প্রিজম আর লেনস–এই দুই বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন কাঁচের সাহায্যে দৃষ্টি বিবর্ধক চশমা তৈরি সম্ভব হয়েছে, সম্ভব য়েছে দূরবীন তৈরি।

লিউয়েন হক তৈরি করেছিলেন জীবজগতের সূক্ষ্মতম অধিবাসীদের দেখবার উপযোগী অণুবীক্ষণযন্ত্র।

নিউটন প্রিজন ও লেনস নিয়ে নাড়াচাড়া করে দূরবীনের একটি মারাত্মক ক্রটি আবিষ্কার করে ফেললেন।

দূরবীনের লেনসে সৌরজগতের যে ছবি ভেসে উঠত, তাতে থাকত নানা বর্ণের রেখার বর্ণবৃত্ত। এর ফলে গ্রহনক্ষত্রের সঠিক অবস্থান নির্ণয়ে কাজ বড় রকমের বাধার সম্মুখীন হত। এই বর্ণঘটিত বিভ্রাটকে বলা হয় CHROMATIC ABERRATION বা বর্ণঘটিত স্থানচ্যুতি।

আলোক বিজ্ঞানীরা দূরবীনের এই ত্রুটি সম্পর্কে বিলক্ষণ ওয়াকিবহাল ছিলেন। কিন্তু তারা মনে করতেন দূরবীনের এই ক্রটি প্রকৃতিগত অর্থাৎ ন্যাচারাল ফ্লো–এই ত্রুটিমুক্ত দূরবীন তৈরি অসম্ভব।

নিউটন এই বর্ণবিভ্রাট মুক্ত দূরবীন তৈরি করলেন। এর সাহায্যে গ্রহনক্ষত্রদের প্রকৃত দূরত্ব নির্ণয় করতে গিয়ে বর্ণঘটিত স্থান চ্যুতির বিঘ্ন থাকল অতি সামান্য মাত্রায়।

পরে ১৭৬০ খ্রি: তাঁর অনুসরণেই সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত দূরবীন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন আলোকবিজ্ঞানী জন ডোনাল্ড।

আলো ও বর্ণঘটিত নানা তত্ত্বও তথ্য যখন প্রকাশ করেন তখন নিউটনের বয়স ত্রিশের কোঠা ছুঁই ছুঁই।

তার এই গবেষণা প্রবন্ধ ইউরোপের বিজ্ঞানীমহলে প্রবল বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিল। লন্ডনের বিখ্যাত রয়াল সোসাইটি তাঁর প্রতিভার স্বীকৃতি জানালেন তাকে সংস্থার সদস্য পদে নির্বাচিত করে।

এই সম্মান প্রাপ্তির পর নিউটন কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ নিজের বর্ণঘটিত ত্রুটিমুক্ত দূরবীনটি রয়াল সোসাইটিতে উপহার পাঠিয়ে দেন।

১৬৬৭ খ্রি: নিউটনকে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে অঙ্কের অধ্যাপক পদে নিয়োগ করা হয়। দীর্ঘ ২০ বছর তিনি এই মহাবিদ্যালয়ের কাজে ছিলেন। এই সময়ে অঙ্ক আর পদার্থবিদ্যা নিয়ে একের পর এক গবেষণা করেছেন তিনি। রসায়ন নিয়েও কিছুকাল কাজ করেছেন।

ক্ষারীয় বা ক্ষারধর্মী ধাতুকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে সোনায় পরিণত করা যায় কিনা তা নিয়েও পরীক্ষা করেছেন।

নিরন্তর গবেষণার মধ্যে থেকে বয়স তিরিশ হতে না হতেই সমস্ত চুল ধবধবে সাদা হয়ে গেল তার।

যে কোন বিষয়ে একনিষ্ঠ মনঃসংযোগের বিরল ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তিনি। যে কোন বিষয় একবার মাথায় ঢুকলে তার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিন্ত হতে পারতেন না। তাঁর সবচেয়ে মহৎ গুণ যেটি ছিল তা হল অপ্রয়োজনীয় প্রসঙ্গ এড়িয়ে মূল লক্ষে এগিয়ে যাবার ক্ষমতা। তাঁর প্রতিটি গবেষণার কাজ এগিয়েছে নির্দিষ্ট নিয়মের পথ ধরে। প্রথমে বিষয় নির্বাচন, পরে মূলনীতি নির্ধারণ। সবশেষে বিশ্লেষণের মাধ্যমে ধাপে ধাপে এগিয়ে চলা।

১৬৮৪ খ্রি: এক তরুণ সৌরবিজ্ঞানী কেমব্রিজে এসে নিউটনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। এই বিজ্ঞানীর নাম এডমুন্ড হ্যানি। তাঁর নামেই পরে একটি বিশেষ ধূমকেতুর নাম হ্যানির ধূমকেতু রাখা হয়েছিল।

প্রকৃতির মহাশক্তি অভিকর্ষের ওপর গবেষণা করার আগ্রহ প্রকাশ করে হ্যানি নিউটনের সহযোগিতা প্রার্থনা করলেন।

নিউটন এতদিন তাঁর যে গবেষণার কথা চেপে রেখেছিলেন, তা প্রথম প্রকাশ করলেন হ্যানির কাছে।

জানালেন, বারো বছর আগেই তিনি এ সম্পর্কে প্রচুর গবেষণা করেছেন। বিভিন্ন তত্ত্ব আবিষ্কারও করেছেন।

হ্যালির প্রশ্নের উত্তরে তিনি এও জানালেন যে বিশেষ কারণেই তিনি তাঁর আবিষ্কৃত মূল্যবান তত্ত্ব দীর্ঘকাল গোপন করে রেখেছেন।

কারণটিও গোপন করলেন না নিউটন। তার আলোক বিজ্ঞানের ওপর গবেষণা প্রকাশিত হবার পর তাঁকে বহু মিথ্যা সমালোচনার শিকার হতে হয়েছিল। বহু বিশিষ্ট বিজ্ঞানীও এই দলে ছিলেন।

তাঁদের নীচতা দেখে তাঁর মন এমনই ভেঙ্গে পড়েছিল যে জীবনে আর কোন গবেষণার কথাই প্রকাশ করবেন না বলে সিদ্ধান্ত করেন।

তরুণ বিজ্ঞানী হ্যানির আগ্রহ ও তৎপরতায় শেষ পর্যন্ত নিউটন তার গবেষণা প্রকাশ করবেন বলে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হলেন।

টানা দুই বছর পরিশ্রম করে তিনি তাঁর যে গবেষণা প্রবন্ধটি তৈরি করেন তা বিশ্ববিজ্ঞানের এক অমূল্য সম্পদ। বইটির নাম রাখা হয় ফিলোসফিয়া নেচারালিস প্রিনসিপিয়া ম্যাথেমেটিকা যা ইংরাজি করলে দাঁড়ায় Mathematical Principle of Natural Philosophy

তরুণ হ্যানি এই সময় নানাভাবে নিউটনকে সাহায্য করেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁর আগ্রহেই বইটি তৈরি হয়েছিল, প্রকাশও করলেন নিজের পয়সায়।

নিউটনের এই বই-এর ভিত্তি উচ্চশ্রেণীর জ্যামিতি হলেও এর মধ্যে যেমন রয়েছে গভীর দর্শন তেমনি জটিল গণিত ও অসাধারণ সব বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত। বইটির সংক্ষিপ্ত নাম প্রিন্সিপিয়া। ইংরাজি প্রিনসিপল শব্দের ল্যাটিন উচ্চারণ হল প্রিন্সিপিয়া।

পরপর তিনটি বইয়ের সংকলন হল প্রিন্সিপিয়া। প্রথম বইটির আলোচ্য বিষয় গতিসূত্র। এতে রয়েছে পরপর তিনটি সূত্র।

প্রথম সূত্র হল : Every body continues in its state or rest or of uniform motion in a straight line unless it is compelled by external force to change that state of inertia

দ্বিতীয় সূত্র হল : Rate of Change of momentum is proportional to the force acting, and the Change takes place in the direction in which the force acts

তৃতীয় সূত্র : To every action there is an equal and oppoite reaction।

প্রিন্সিপিয়ার দ্বিতীয় বইতে নিউটন আলোচনা করেছেন প্রতিরোধী বস্তুর মাধ্যমের ভিতরে যে কোন বস্তুর গতি নিয়ে।

প্রতিরোধী বস্তু হিসেবে তিনি তরল ও বায়বীয় এই দুই পদার্থকেই গ্রহণ করেছেন।

নিউটনের মতে যে কোন গ্যাসই অসংখ্য স্থিতিস্থাপক পরমাণুর মিশ্রণ। গ্যাসের ওপর চাপই তার আয়তন নিয়ন্ত্রণ করে।

প্রিন্সিপিয়ার তৃতীয় খণ্ডে রয়েছে সৌরজগৎ ও প্রকৃতির অভিকর্ষ বলের কথা। তিনি পরিষ্কারভাবে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন কিভাবে পৃথিবীর বুকে পতনশীল বস্তুর ওপর অভিকর্ষ বল কাজ করে এবং এই একই বলের প্রভাবে মহাকাশের গ্রহতারা তাদের নিজ নিজ কক্ষপথে থেকে নির্দিষ্ট নিয়মে কাজ করে।

এই অভিকর্ষ বলের টানেই যে সমুদ্রে জোয়ার ভাটা খেলা করে সেই কখাও তিনি বলেছেন।

নিউটনের বক্তব্যের অর্থ হল, সৃষ্টির প্রতিটি বস্তুর পিছনেই রয়েছে নির্দিষ্ট যুক্তি ও অবিসংবাদি কারণ।

প্রিন্সিপিয়া প্রকাশের পর এবারে নিউটন পেলেন অকুণ্ঠ প্রশংসা, সাধুবাদ আর অপ্রতিহত খ্যাতি।

খ্যাতির সঙ্গে এল প্রাপ্তি। ১৮৮৯ খ্রি: ইংল্যাণ্ডের পার্লামেন্ট নিউটনকে সদস্য পদে বরণ করল। কেমব্রিজের বিজ্ঞান বিভাগ পরিচালনার সময় দায়িত্বও তিনি পেলেন।

১৭০১ খ্রি: পেলেন দেশের সমস্ত টাকশালের অধ্যক্ষপদ। অবশ্য এই পদ পাবার পর তিনি পার্লামেন্ট থেকে অবসর নেন। ১৭০৩ খ্রি: তিনি রয়াল সোসাইটির সভাপতি পদে বৃত হলেন। আমৃত্যু ১৭২৭ খ্রি: তিনি এই পদ অলঙ্কৃত করেছেন।

১৭০৫ খ্রি: মহারানী অ্যান নিউটনকে নাইট উপাধিতে সম্মানিত করলেন। তাঁর নামের আগে যুক্ত হল স্যার। এই বিরল সম্মান বিজ্ঞানীদের মধ্যে তিনিই প্রথম লাভ করেন।

পদ বা পদক যাই জুটুক না কেন নিজ প্রতিভাগুণেই নিউটন জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের একজন বলে স্বীকৃত হয়েছেন। তাঁর আবিষ্কারের সূত্র ধরেই আধুনিক বিজ্ঞানধারণা সুদূরপ্রসারী ফল ফলিয়ে চলেছে।

তথ্যসূত্রঃ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী – মাইকেল এইচ. হার্ট / সম্পাদনায় – রামশংকর দেবনাথ