নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (Napoleon Bonaparte)

প্রথম পাতা » জীবনী » নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (Napoleon Bonaparte)


নেপোলিয়ন বোনাপার্ট

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট

(১৭৬৯-১৮২১)
ইতালির অন্তর্গত কর্সিয়া দ্বীপের আজাশিও নামে একটি ছোট শহরে বাস করতেন এক আইনজীবী, নাম চার্লস। তিনটি সন্তান তার। চতুর্থ সন্তানের জন্মের সময় চিন্তিত হয়ে পড়লেন। স্ত্রীর শরীরের অবস্থা ভাল নয়। কিন্তু ঈশ্বরের আশীর্বাদে যথাসময়েই চার্লসের স্ত্রী চতুর্থ পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন। দাই এসে সংবাদ দিতেই ঘরে ঢুকবেন চার্লস। নতুন কেনা গদির উপর শুয়ে রয়েছেন তাঁর স্ত্রী আর নবজাত শিশুসন্তান। সমস্ত গদির উপর যুদ্ধের ছবি আঁকা।

সেই দিন চার্লস কল্পনাও করতে পারেননি যুদ্ধের ছবির উপর জন্ম নিল যে শিশু, যুদ্ধ হবে তার জীবনসঙ্গী। যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে হবে তার প্রতিষ্ঠা। যুদ্ধের মধ্যে দিয়েই একদিন তিনি ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করবেন। আবার যুদ্ধই তাঁর ধ্বংসের কারণ চার্লসের সেই নবজাত শিশু সন্তান (জন্ম ১৫ আগস্ট ১৭৬৯) ভবিষ্যতের বীর নায়ক নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। যে সমস্ত মানুষ তাঁদের ব্যক্তিত্ব, কৃতিত্ব,কর্মপন্থা, অপরিসীম সাহস ও শক্তি দিয়ে ইতিহাসের গতি পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছিলেন, নেপোলিয়ন তাঁদের অন্যতম।

চার্লস বোনাপার্ট ছিলেন সুদর্শন, প্রতিভাবান, আইনজীবী। বক্তা হিসাবেও তাঁর খ্যাতি ছিল। পুত্রদের প্রাথমিক শিক্ষার সব ভার তিনি নিজেই গ্রহণ করেছিলেন।

শিশু নেপোলিয়ন দাদাদের সাথে পড়াশুনার অবসরে দ্বীপের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াতেন। ভবিষ্যৎ জীবনে নেপোলিয়নের চরিত্রে কর্সিয়ার প্রাকৃতিক প্রভাব সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। সেখানকার পাহাড়-পর্বতের মতই অনমনীয় দৃঢ়তা, শান্ত অটল প্রকৃতি নেপোলিয়নের জীবনে মূর্ত হয়ে উঠেছিল।

নেপোলিয়নের মা ছিলেন উদার শান্ত প্রকৃতির মহিলা। বাবা-মার চারিত্রিক প্রভাবও নেপোলিয়নের জীবনকে অনেকাংশে প্রভাবিত করেছিল।

নেপোলিয়নের বাল্যশিক্ষা শুরু হয় তাঁর বাড়িতে পিতার কাছে। দশ বছর বয়সে একটি ফরাসী স্কুলে ভর্তি হলেন। প্রথমে কর্সিয়া ছিল জেনোয়ার অধিকারে। পরে এই দেশ ফরাসীরা দখল করে নেওয়ার ফলে কর্সিয়া ফরাসী অধিকারভুক্ত হয়। নেপোলিয়ন ফরাসী নাগরিক হিসাবে জন্মগ্রহণ করলেও ফরাসীদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন না। কারণ তাঁর মনে হত ফরাসীরা তাঁদের স্বাধীনতা হরণ করেছে।

ছেলেবেলা থেকেই নেপোলিয়নের ইচ্ছা ছিল সৈনিক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। স্কুলের পাঠ শেষ করে তিনি ভর্তি হলেন একটি সামরিক কলেজে। সামরিক শিক্ষায় নিজেকে গড়ে তুললেও ইতিহাস ও দর্শনের প্রতি তাঁর ছিল গভীর আগ্রহ। তিনি প্লেটো, ভলতেয়ার, রুশো প্রভৃতি দার্শনিকদের রচনা গভীর মনোযোগ সহকারে পড়তেন, আলোলাচনা করতেন। তবে তাঁকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করত বিভিন্ন দেশের ইতিহাস, সেই সব দেশের সম্রাট রাজাদের বীরত্ব সাহস কীর্তি তাকে মুগ্ধ করত।

তার যৌবনে একটি মাত্র উদ্দেশ্য ছিল কর্সিয়ার স্বাধীনতা অর্জন। তিনি বিশ্বাস করতনে একমাত্র সামরিক শক্তিতেই এই স্বাধীনতা পাওয়া সম্ভব। মাত্র একুশ বছর বয়সে তিনি ফরাসী সামরিক বাহিনীতে ক্যাপ্টেন হিসাবে ভর্তি হলেন।

এই সময় ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুই-এর বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে বিপ্লব। রাজাকে পদচ্যুত করে দেশের ক্ষমতা দখল করল বিপ্লবী পরিষদ। তৈরি হল কনভেনশন। বা প্রজাতান্ত্রিক ফরাসী সরকার। সমস্ত দেশ জুড়ে আরম্ভ হল হানাহানি মারামারি আর সন্ত্রাসের রাজত্ব। নিহত হল রাজা ষোড়শ লুই। ফ্রান্সের এই রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার ফলে বিভিন্ন রাষ্ট্র ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। এ সব দেশের সৈন্যদের একত্রিত করে তৈরি হল শক্তি সঙ্ঘ।

ফরাসী বিপ্লব শুরু হওয়ার পর যখন নতুন শক্তি দেশের ক্ষমতা দখল করল, তারা ফরাসী অধিকারভুক্ত বিভিন্ন দেশকে স্বতন্ত্র প্রদেশ হিসাবে ঘোষণা করে অভ্যন্তরীণ শাসনের পূর্ণ স্বাধীনতা দান করল। এই ঘোষণার ফলে নেপোলিয়নের মনে ফ্রান্সের প্রতি। যে ঘৃণা ছিল তা সম্পূর্ণ দূর হয়ে গেল।

১৭৯৩ সালে ইউরোপের শক্তি সঙ্রে তরফে ইংরেজ নৌবাহিনী ফরাসী সামরিক বন্দর টুলো অবরোধ করল। সেখানকার স্থানীয় নাগরিকরাও রাজার সমর্থনে ইংরেজদের সাহায্য করতে এগিয়ে এল।

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট তখন ফরাসী বাহিনীর এক ক্যাপ্টেন, ইংরেজ বাহিনীর অবরোধ মুক্ত করবার ভার পড়ল তাঁর উপর। সসৈন্যে এগিয়ে গেলেন নেপোলিয়ন। দুপক্ষে শুরু হল তুমুল যুদ্ধ। ইংরেজ বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ফরাসীদের তুলনায় বেশি হওয়া সত্ত্বেও নেপোলিয়নের সুদক্ষ রণনীতির সামনে তারা সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়ে ফ্রান্স পরিত্যাগ করতে বাধ্য হল। এই জয়ে নেপোলিয়নের খ্যাতি সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল।

যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার জন্য তাঁকে ফরাসী সামরিক বাহিনীর ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল হিসাবে ঘোষণা করা হল। এর অল্প কিছুদিন পর মিথ্যা সন্দেহবশত নেপোলিয়নকে বন্দী করে কারারুদ্ধ করা হল। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল তিনি বিপ্লব বিরোধী কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অনুসন্ধানে এই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় তাকে মুক্তি দেওয়া হল।

এ সময় ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যে শক্তি সঙ্ গড়ে উঠেছিল, একে একে অনেক দেশ সেই সঙ্ থেকে নিজেদের সম্পর্ক ছিন্ন করে নতুন ফরাসী সরকারকে অস্বীকৃতি করে যুদ্ধ ঘোষণা করল।

একদিকে বিদেশী শত্রুর আক্রমণের আশঙ্কা, অন্যদিকে দেশের মধ্যে নানান বিশৃঙ্খলা গণ্ডগোল। এই অবস্থায় জনগণও বিপ্লবকে রক্ষা করবার জন্য ১৭৯৫ সালে কনভেনশন ডাইরেক্টরী নামে নতুন শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হল, এই কনভেনশন দেশের শাসনভার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করল।

এই নতুন কলভেনশনের বিরুদ্ধে বিপ্লবের সময় প্রতিষ্ঠিত জাতীয় রক্ষীবাহিনী ও প্যারিসের কিছু সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ল। কনভেনশনের সদস্যরা প্যারিসের প্রাসাদে এক অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন। জাতীয় রক্ষীবাহিনীও এক বিরাট জনতা সেই প্রাসাদ আক্রমণ করল। এই গুরুতর বিপদের মুহূর্তে কনভেনশনকে রক্ষা করার জন্যে এগিয়ে এলেন নেপোলিয়ন। তাঁর অধীনে তখন ছিল মাত্র পাঁচ হাজার সৈন্য, অপরদিকে বিরোধী দলে ত্রিশ হাজার রক্ষী। নেপোলিয়ন সৈন্যবাহিনীকে দুটি দলে ভাগ করে ঝটিকা বেগে আক্রমণ করলেন রক্ষীবাহিনীকে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিপর্যত হয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল রক্ষীবাহিনী। উচ্ছখল জনতা প্রাণ ভয়ে পালিয়ে গেল। রক্ষা পেল কনভেনশন। এই সাহসিকতার জন্য নেপোলিয়নকে জেনারেল পদে নিয়োগ করা হল।

খ্যাতি সম্মানের শীর্ষে উঠে নেপোলিয়ন বিয়ে করলেন সুন্দরী তরুণী জোসেফাইনকে। ইতিপূর্বে জোফেফাইন বিবাহ করেছিলেন। তার স্বামী বিপ্লবের সময় নিহত হন। বিবাহের অব্যবহিত পরেই শত্রু সৈন্যের বিরুদ্ধে লড়াই-এ যেতে হল নেপোলিয়নকে। যুদ্ধে যখন তাঁর সৈন্যবাহিনী বীরদর্পে এগিয়ে চলেছে তখন তিনি সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে চিঠি লিখছেন–

“তোমার কাছ থেকে দূরে এখানে আমার কোন আনন্দ নেই। তুমি আমার প্রাণের আত্মাকে কেড়ে নিয়েছ, এখন তুমিই শুধু আমার ধ্যান-জ্ঞান।”

পরবর্তীকে যখন নেপোলিয়ন সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসিত হয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন, জীবনে যদি কোন নারীকে সামান্যও ভালবেসে থাকি তবে সে জোসেফাইন।

কিন্তু রণক্ষেত্রে যুদ্ধের দামামা শুনতে শুনতে কয়েকদিনেই নেপোলিয়ন ভুলে গেলেন তার প্রেম ভালবাসা প্রিয়তমা নারী। যুদ্ধের উন্মত্ততায় মেতে উঠলেন তিনি।

ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যে শক্তি সঙ্ গড়ে উঠেছিল সেই শক্তি সঙ্ ভেঙে যাওয়ার পর তিনটি মাত্র দেশ ইংলন্ড, অস্ট্রিয়া এবং সার্ডিনিয়া ফ্রান্সের প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে দেখা দিল।

ইংলন্ডের নৌবাহিনী ফ্রান্সের জলপথ অবরোধ করল। উত্তরপূর্ব সীমান্তে তখন ইংলন্ড আর অস্ট্রিয়ার মিলিত বাহিনী। পূর্ব সীমান্ত অস্ট্রিয়ার বাহিনী, দক্ষিণপূর্ব সীমান্তে অস্ট্রিয়া আর সার্ডিনিয়ার যুগ্ম বাহিনী ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

দেশের এই বিপন্ন পরিস্থিতিতে সৈন্যবাহিনীর ভার নেওয়ার মত একটি মাত্র মানুষ ছিলেন, তিনি নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।

কনভেনশন নেপোলিয়নের উপর যুদ্ধ পরিচালনার সম্পূর্ণ ভার অর্পণ করল। নেপোলিয়ন তখন মাত্র ২৭ বছরের এক যুবক। কিন্তু গভীর দূরদর্শিতা ও সামরিক বোধের দ্বারা উপলব্ধি করতে পারলেন তাঁর সর্বপ্রধান কাজ হবে সার্ডিনিয়া ও অস্ট্রিয়ার সৈন্যদের গতি রোধ করা। সীমান্ত অতিক্রম করার আগেই যদি না তাদের প্রতিহত করা যায় তবে দেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন।

কিন্তু সমস্যা দেখা গেল। দুই দেশের যুগ্ম বাহিনীর বিশাল সৈন্যের মুখোমুখি হওয়ার মত সামরিক সামর্থ্য নেপোলিয়নের ছিল না। তাই স্থির করলেন দুই দেশের সাথে আলাদা আলাদাভাবে যুদ্ধ করবেন। প্রথমেই তিনি সৈন্যবাহিনী নিয়ে ঝড়ের গতিতে সার্ডিনিয়া আক্রমণ করলেন। সার্ডিনিয়া বাহিনী এই আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না, তাছাড়া বিপন্ন ফ্রান্স যে এইভাবে তাদের উপর আঘাত হানবে এও তাদের ধারণার মধ্যে ছিল না।

নেপোলিয়নের সৈন্যবাহিনী কয়েকদিনের মধ্যেই স্যাভয় ও নিস শহর দখল করে নিল। সার্ডিনিয়ার সৈন্যবাহিনী তখন বহুদূরে। বিপন্ন সার্ডিনিয়া আত্মরক্ষার জন্য ফ্রান্সের সঙ্গে সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করল, এতে তারা তিনটি দুর্গ নেপোলিয়নকে ছেড়ে দিল, এবং ফ্রান্সের বিরুদ্ধে শক্রতার নীতি পরিত্যাগ করল।

এইবার নেপোলিয়ন তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে এগিয়ে চললেন ম্যান্টুয়ার দুর্গ অভিমুখে। ম্যাটুয়া অস্ট্রিয়ার এক সর্বপ্রধান দুর্গ। এই দুর্গ দখল করবার জন্যে এগিয়ে চললেন নেপোলিয়ন। এই দুর্গ রক্ষার জন্য অস্ট্রিয়া তার বিশাল সেনাবাহিনীকে নিয়োজিত করল। কিন্তু নেপোলিয়ন সুকৌশলে অস্ট্রিয়ার সেনাবাহিনীকে বিচ্ছিন্ন করে প্রথমে আরকোলা তারপর রিভেলি, সবচেয়ে লাফভভারিটার যুদ্ধে অস্ট্রিয়ার বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করে ম্যাটুয়া দখল করে নিলেন।

দুই প্রধান শত্রুকে পরাজিত করে নেপোলিয়ন সৈন্যবাহিনী নিয়ে এগিয়ে চললেন ইতালির দিকে। তখন সমগ্র ইউরোপ পোপের প্রভাব-প্রতিপত্তির কথা নেপোলিয়নের অজানা ছিল না। পোপ ছিলেন রাজতন্ত্রের সমর্থক। ফ্রান্সের নবগঠিত শক্তিকে তিনি স্বাগত জানাতে পারেননি। নানাভাবে তার শত্রুতা করছিলেন।

নেপোলিয়ন পোপের অধিকারভুক্ত রাজ্যগুলো মাত্র দু সপ্তাহের মধ্যে দখল করে নিলেন। বিপন্ন পোপ নিরুপায় হয়ে নেপোলিয়নের সঙ্গে সন্ধি করলেন। এই সন্ধির শর্ত অনুসারে বহু অর্থ ও বহু নগর ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন।

নেপোলিয়ন ইতালি পরিত্যাগ করবার সময় রোম থেকে বহু প্রাচীন পুঁথিপত্র, শিল্পকলা, স্থাপত্য মূর্তি ফ্রান্সে নিয়ে গেলেন।

এই যুদ্ধ সাময়িকভাবে ফ্রান্সে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা পেলেও মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই অস্ট্রিয়া ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আবার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ম্যান্টুয়া পুনরায় উদ্ধার করা।

কিন্তু নেপোলিয়ন অস্ট্রিয়াকে সেই সুযোগ দিলেন না। নিজেই সৈন্যবাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন অস্ট্রিয়ার উপর। বিপন্ন অস্ট্রিয়া নিরুপায় হয়ে নেপোলিয়নের সাথে সন্ধি চুক্তি করতে বাধ্য হল (অক্টোম্বর ১৭, ১৭৯৭)। এই চুক্তির ফলে বিভিন্ন দ্বীপে অবস্থিত অস্ট্রিয়ার নৌবহর দখল করল ফ্রান্স। এছাড়াও বহু দেশ ছেড়ে দিতে বাধ্য হল।

দুই প্রধান শত্রুকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করে যখন প্যারিসে ফিরে এলেন নেপোলিয়ন তখন সমস্ত দেশ তাকে অভিনন্দন জানাল। তাঁকে জাতীয় বীরের মর্যাদা দেওয়া হল। প্রকৃতপক্ষে বিপ্লব উত্তরকালে নেপোলিয়নই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি সমগ্র দেশের মানুষের ভালবাসা শ্রদ্ধা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

নেপোলিয়নের এই বিজয়ের মূলে ছিল তাঁর সাহস, রণনীতি, প্রখর বাস্তব বোধ। এছাড়াও তাঁর আর একটি প্রধান গুণ ছিল, তিনি সমগ্র সৈন্যবাহিনীকে দেশপ্রেমের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

দুটি দেশের পরাজয়ের পর ফ্রান্সের একমাত্র শত্রু ছিল ইংলন্ড। নেপোলিয়ন চেয়েছিলেন প্রথমে মিশরের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করে সমস্ত ইংরেজ উপনিবেশগুলো দখল করে নেবেন। তারপর ইংরেজ নৌবাহিনীর উপর আক্রমণ হানবেন। প্রকৃতপক্ষে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা নেপোলিয়নের পক্ষে মারাত্মক একটি ভ্রান্তি ছিল। কারণ ইংরেজ নৌবাহিনীর শক্তি সম্বন্ধে তার কোন ধারণা ছিল না। তিনি ভেবেছিলেন যেমনভাবে অস্ট্রিয়া ও সার্ডিনিয়াকে পরাজিত করেছিলেন তেমনিভাবেই ইংলন্ডকে বিধ্বস্ত করতে সক্ষম হবেন।

নেপোলিয়ন তার নৌবহর নিয়ে এসে উপস্থিত হলেন নীলনদের মোহনায়। সেখানে সুসজ্জিত নৌবহরকে রেখে নেপোলিয়ন তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে মিশরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। এই সুযোগে ইংরেজ নৌ সেনাপতি নেলসন তার সুদক্ষ নৌবাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ফ্রান্সের নৌবহরের উপর। ফ্রান্সের নৌবাহিনী সম্পূর্ণভাবে পরাজিত বিধ্বস্ত হল।

নেপোলিয়ন মিশরের বিস্তৃত অঞ্চল দখল করলেও নৌবাহিনীর পরাজয়ে ফ্রান্সের সাথে তাঁর সমস্ত সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল এবং নেপোলিয়ন যাতে ফ্রান্সে ফিরে যেতে পারেন তার জন্যে সমস্ত জলপথ অবরোধ করে ফেললেন নেলসন।

নেপোলিয়নের কাছে সংবাদ এল, ফ্রান্সের রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোটেই সন্তোষজনক নয়। দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ আর বিদ্রোহ। যে সমস্ত দেশকে তিনি পরাজিত করে ফ্রান্সের অধিকার ভুক্ত করেছিলেন তারা নতুন শক্তি সংগ্রহ করে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। দেশের নেতৃত্বের ভার যাদের উপর আরোপ করা হয়েছে তারা সকলেই অযোগ্য। দেশ শাসনের সামান্যতম ক্ষমতা নেই।

ফ্রান্সের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে সেখানে ফিরে যাওয়া একান্ত প্রয়োজন বিবেচনা করে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মাত্র দুখানা রণতরী নিয়ে নেলসনের নৌবাহিনীর সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে ফ্রান্সে এসে পৌঁছলেন।

ফ্রান্সের শাসনভার পরিচালনার দায়িত্ব ছিল কিছু অযোগ্য লোকের দ্বারা পরিচালিত ডাইরেক্টরীর উপর। এই ডাইরেক্টরী দেশ শাসনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তারা সম্পূর্ণভাবে নেপোলিয়নের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল।

দেশের মানুষের ক্ষোভ অসন্তোষ ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছিল। নেপোলিয়ন আর মুহূর্ত মাত্র বিলম্ব করলেন না। তিনি তাঁর সামরিক শক্তির প্রভাবে ডাইরেক্টরী ভেঙে দিয়ে কনসলেট ছিল সম্পূর্ণভাবে নেপোলিয়নের আজ্ঞাধীন। প্রকৃতপক্ষে নেপোলিয়ন হয়ে উঠলেন ফ্রান্সের সর্বময় কর্তা।

বহুদিন ধরেই নেপোলিয়ন রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করবার জন্য মানসিক দিক থেকে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। তিনি জানতেন তাঁকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা কারো নেই। তবুও তিনি সামরিক ক্ষমতা বলে এই অধিকার অর্জন করতে চাননি। তিনি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। অবশেষে তাঁর সৌভাগ্যের সূর্য উদিত হল।

তিনি ইতালি জয়ের পরেই তাঁর প্রিয় সঙ্গীদের কাছে বলেছিলেন, “তোমরা মনে করো না যে আমি ডাইরেক্টরীর জন্য এই যুদ্ধ জয় করেছি, এই জয় আমার উন্নতির সূচনা মাত্র।”

নেপোলিয়ন নতুন যে শাসন ব্যবস্থা স্থাপন করলেন তার নাম দেওয়া হল কনসলেট। এই কনসলেট অল্প কয়েকজন সত্যের দ্বারা গঠিত হল। নেপোলিয়ন হলেন প্রথম কনসাল। তাঁর হাতেই সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল। অন্য সদস্যরা ছিল প্রকৃত অর্থে পুতুল মাত্র।

নতুন এই ব্যবস্থা সম্বন্ধে জনগণের মত নেওয়ার জন্য সমস্ত ফ্রান্সে ভোট নেওয়া হল। সেই সময় নেপোলিয়ন বোনাপার্ট-এই একটি নাম সমগ্র দেশবাসীর কাছে এমন এক মোহজাল বিস্তার করেছিল, বিপুল ভোটে তারা নেপোলিয়নকে জয়যুক্ত করল।

ফ্রান্সের সর্বময় কর্তা হিসাবে আইনসংগতভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নেপোলিয়ন ঘোষণা করলেন, (১৭৯৯ সালের ১৫ই ডিসেম্বর) “বিপ্লবের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে, এইবার বিপ্লবের সমাপ্তি ঘটল।”

ফ্রান্সের সাময়িক বিপর্যয়ের সুযোগ ইউরোপে গড়ে উঠল দ্বিতীয় শক্তি সঙ্। এই সঙ্গে যোগ দিয়েছিল ইংলন্ড, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া। তাদের একটি মাত্র উদ্দেশ্য ছিল ফ্রান্সে নব গঠিত শাসন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে পুনরায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। ইউরোপের প্রতিটি দেশে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল। ফরাসী বিপ্লবের দ্বারা যেভাবে সে দেশের মানুষ ক্ষমতা অর্জন করেছে, তার প্রতিক্রিয়া তাদের দেশেও পড়তে পারে। একদিকে যেমন এই আশঙ্কা ছিল অন্যদিকে নেপোলিয়নের রণকুশলতায় সকলেই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তাই তাকে ধ্বংস করবার জন্য সম্মিলিতভাবে যৌথ উদ্যোগ পড়ে তুলল।

নেপোলিয়ন অনুভব করতে পেরেছিলেন এই সম্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা এই মুহূর্তে অসুবিধাজনক। তাই তিনি ইংলন্ডের প্রধানমন্ত্রী পিট ও অস্ট্রিয়ার রাজার কাছে সন্ধির প্রস্তাব করলেন। এর পেছনে তার দুটি উদ্দেশ্য ছিল। তিনি সাময়িকভাবে যুদ্ধ ও রক্তপাত থেকে নিবৃত হতে চাইছিলেন। দ্বিতীয়ত যদি সন্ধির প্রস্তাব অগ্রাহ্য হয়, সেক্ষেত্রেও তিনি নিজের শক্তি বৃদ্ধি করবার সময় পাবেন।

নেপোলিয়নের সন্ধির প্রস্তাব দুই তরফেই অগ্রাহ্য করা হল। মাত্র এক বছরের মধ্যে নেপোলিয়ন নিজের সৈন্যবাহিনীকে নতুন করে সুসংহত করে ইতালি আক্রমণ করলেন। অন্যদিকে তার সেনাপতি অস্ট্রিয়া আক্রমণ করল। এই যুদ্ধের ফলে বিশাল অঞ্চল ফ্রান্সের অধিকারভুক্ত হল। তারা ফ্রান্সের সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হল। এইভাবে দ্বিতীয় শক্তি সজ্ঞের অবসান ঘটল।

নেপোলিয়ন নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করে প্রকৃতপক্ষে একনায়কতন্ত্রের শাসন প্রতিষ্ঠা করলেন। যে প্রজাতন্ত্রের জন্য ফরাসী বিপ্লব ঘটেছিল তার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যর্থ হল। এই ক্ষমতা দখল প্রসঙ্গে নেপোলিয়ন বলেছিলেন, “ফ্রান্সের রাজমুকুট মাটিতে পড়েছিল, আমি সেই মুকুট তরবারি দিয়ে মাথায় তুলে নিয়েছি।”

নেপোলিয়নের বাস্তব বুদ্ধিবোধ এত প্রখর ছিল, তিনি গণভোটের আয়োজন করলেন, যাতে সর্বসমক্ষে প্রমাণিত হয়ে যায় তিনি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়েই সম্রাট পদে অভিষিক্ত হয়েছেন। তখন ফ্রান্সের জনগণের কাছে নেপোলিয়ন এক অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন সকলের ধারণা ছিল তিনিই ফ্রান্সের রক্ষাকতা। তাই নির্বাচনে সমগ্র জনগণের জনসমর্থন লাভ করে হয়ে উঠলেন ফ্রান্সের একচ্ছত্র অধিপতি।

এইবার দেশের উন্নয়নের কাজে হাত দিলেন। দীর্ঘদিন বিপ্লবের উন্মাদনায়, যুদ্ধবিগ্রহের তাণ্ডবে প্রকৃতপক্ষে দেশের সমস্ত উন্নয়নের কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও ভেঙে পড়েছিল।

নেপোলিয়ন দেশকে ৮৩টি প্রদেশে ভাগ করে প্রতিটি প্রদেশ দেখাশুনার জন্যে একজন করে শাসক নির্বাচিত করলেন। সেই শাসকের উপর তার প্রদেশের সম্পূর্ণ দায়িত্ব আরোপ করা হল। বিচার বিভাগের সংস্কার করলেন, নতুন বিচারক নিয়োগ করলেন। যাতে কোন দুর্নীতিগ্রস্ত লোক বিচারক হিসাবে নিযুক্ত হতে না পারেন সেই জন্যে বিচারক নির্বাচনের ভার নিজের হাতে নিলেন।

দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির জন্য তৈরি করা হল ব্যাঙ্ক অব ফ্রান্স’ নামে জাতীয় ব্যাঙ্ক। এই ব্যাঙ্কের উদ্দেশ্য ছিল যাতে জনগণ, ব্যবসায়ীরা তাদের সঞ্চিত অর্থ এখানে জমা রাখতে পারে, এবং শিল্প ব্যবসা বাণিজ্যের প্রয়োজনে অর্থ ঋণ হিসাবে পেতে পারে।

তিনি কর ব্যবস্থাকে সুবিন্যস্ত করলেন। এতদিন সরকারের তরফে কর আরোপ করা হত। লোকেরা সেই কর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জমা দিত না। কর আদায়ের ক্ষেত্রেও কোন সুষ্ঠু নীতি ছিল না। নেপোলিয়ন শুধু পুরনো নীতিকে নতুনভাবে বলবৎ করলেন না, জনগণ যাতে প্রবর্তিত কর ব্যবস্থাকে গ্রহণ করে স্বেচ্ছায় কর দেয় তার জন্যে তাদের উৎসাহিত করতে লাগলেন। কর আদায়ের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হল। এর ফলে অল্পদিনের মধ্যেই ভেঙে পড়া অর্থনীতি সজীব হয়ে উঠল।

আইন বিচার অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে নগর উন্নয়নের দিকে নজর দিলেন নেপোলিয়ন। তৈরি হল নতুন রাস্তাঘাট শিক্ষাকেন্দ্র।

তবে নেপোলিয়নের গুরুত্বপূর্ণ এবং বিখ্যাত কাজ হল নতুন আইন বিধি যা নেপোলিয়ন কোড (Code Nepoleon) নামে পরিচিত, তাকে প্রচলন করা। নেপোলিয়ন অনুভব করেছিলেন দেশের প্রচলিত আইন সাধারণ মানুষের প্রয়োজন মেটাতে অক্ষম। সেই কারণেই দেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞদের পরামর্শে নতুন আইন বিধি গড়ে উঠল।

এই সময় কাজের জন্য দেশের মানুষের গভীর আস্থা অর্জন করলেন নেপোলিয়ন।

নেপোলিয়ন যতই তার ক্ষমতা প্রভুত্ব বিস্তার করছিলেন, ততই বিপ্লবের মূল আদর্শ থেকে ফ্রান্স দূরে সরে আসছিল। নেপোলিয়ন নিজেও বিপ্লবের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না। তাই তিনি বলেছিলেন, আমিই বিপ্লবকে ধ্বংস করেছি।

সেই মুহূর্ত ফ্রান্সে শান্তি-শৃঙখলা প্রতিষ্ঠিত হল, সেই সময় ইংরেজদের সাথে আবার নেপোলিয়নের বিবাদ শুরু হল। ১৮০৫ সালে ইংরেজ নৌবাহিনী ফরাসী নৌবহরকে পরাজিত করল। নৌযুদ্ধ ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়ে নেপোলিয়ন তাদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ শুরু করলেন। তিনি ইংরেজদের বলতেন ‘দোকানদারের জাত’। ইউরোপের কোন বন্দরে যাতে ইংলন্ডের কোন পণ্য প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। এর ফলে শুধু ইংলন্ড নয়, অন্য দেশের উপর অর্থনৈতিক প্রভাব পড়ল। ফলে ইউরোপের প্রতিটি দেশই নেপোলিয়নের উপর ক্রদ্ধ হয়ে উঠল।

রাশিয়ার সঙ্গে ফ্রান্সের মৈত্রী সম্পর্ক ছিল। কিন্তু নেপোলিয়নের আচার-আচরণ মেনে নিতে পারছিলেন না রাশিয়ার জার। তিনি নিজের দেশের সমস্ত বন্দর ইংলন্ডের জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন এবং তাদের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করলেন।

রাশিয়ার এই আচরণে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন নেপোলিয়ন। তিনি স্থির করলেন রাশিয়া আক্রমণ করবেন। ছয় লক্ষ সৈন্য সংগ্রহ করা হল। এই বিশাল বাহিনী নিয়ে এগিয়ে চললেন নেপোলিন। এই রাশিয়া আক্রমণ নেপোলিয়নের জীবনের সবচেয়ে বড় ভ্রান্তি।

রাশিয়ার জার জানতেন নেপোলিয়নের সৈন্যবাহিনীর মোকাবিলা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, তাই রুশ বাহিনী ফরাসী সৈন্যদের আক্রমণ না করে পিছু হটতে আরম্ভ করল। শহর নগর গ্রাম যা কিছু ছিল সব নিজেরাই ধ্বংস করে দিল। যুদ্ধক্ষেত্রে এই কাজকে বলে পোড়ামাটির নীতি। ফরাসী সৈন্যবাহিনী বিনা বাধায় মস্কোয় প্রবেশ করে শহর দখল করে নিল। জার তখন মস্কো ত্যাগ করে পিটসবার্গ দুর্গে অবস্থান করেছিলেন। নেপোলিয়ন মস্কো জয় করার অল্পদিনের মধ্যেই শীত এসে গেল। রাশিয়ার ভয়াবহ ঠাণ্ডা সহ্য করবার ক্ষমতা ছিল না ফরাসী সৈন্যদের। তারা ফিরে চলল ফ্রান্সের দিকে। তখন বরফ পড়তে আরম্ভ করেছে। নিজেদের সঞ্চিত খাবার ফুরিয়ে গিয়েছে। পথের কষ্টে শত শত সৈনিক মারা পড়তে আরম্ভ করল। তাদের দুর্বলতার সুযোগে রুশ সৈন্যবাহিনী ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ফরাসীদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ শুরু করল। তার সাথে রুশ গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণে ফরাসী সৈন্যবাহিনীর প্রায় সমস্ত সৈন্যই মারা পড়ল। ছল লক্ষ সৈন্যের মধ্যে মাত্র বিশ হাজার সৈন্য নিয়ে ফ্রান্সে এসে পৌঁছেলেন নেপোলিয়ন।

তাঁর এই পরাজয়ে ইউরোপের সমস্ত দেশ একত্রিত হয়ে সম্মিলিতভাবে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। এই বিশাল শক্তির সাথে লড়াই করবার ক্ষমতা ছিল না নেপোলিনের। রাশিয়া আক্রমণের ফলে তার সৈন্য সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গিয়েছিল। বিরোধী পক্ষের আক্রমণের মুখে পিছু হটতে আরম্ভ করলেন। বিরোধী পক্ষ চারদিক থেকে প্যারিস অবরুদ্ধ করে ফেলল। নেপোলিয়নের সৈন্যরাও তাঁকে ত্যাগ করল। নিরুপায় নেপোলিয়ন ১৮১৪ সালের ১১ই এপ্রিল সিংহাসন ত্যাগ করলেন। তাঁকে এলবা দ্বীপে নির্বাসন দেওয়া হল।

নেপোলিয়নের অবর্তমানে সিংহাসনে বসলেন ফ্রান্সের বুরবো পরিবারের অষ্টাদশ লুই। সাথে সাথে অভিজাত সম্প্রদায় দেশে ফিরে এল। দেশে নতুন করে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হল। ফরাসী জনগণ কিছুতেই এই নতুন শাসনব্যবস্থাকে মেনে নিতে পারছিল না। ফরাসী সৈন্যবাহিনীও নেপোলিয়নকে আদর্শ বীর হিসাবে মনে করত। দেশের মধ্যে গোলযোগ শুরু হল।

এলবা দ্বীপে অবস্থানকালে ফ্রান্সের এই অবস্থার কথা শুনে গোপনে দেড় হাজার সৈন্য নিয়ে নেপোলিয়ন প্যারিসে এসে উপস্থিত হলেন।

এই সংবাদ পেয়ে রাজা লুই তার সৈন্যবাহিনীকে পাঠালেন নেপোলিয়নকে বন্দী। করবার জন্য। সৈন্যবাহিনী এসে যখন চতুর্দিকে তাদের সামনে এসে বললেন, তোমরা যদি আমাকে হত্যা করতে চাও, তবে স্বচ্ছন্দ মনে তা করতে পার। আমি তোমাদের সম্রাট, তাই তোমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি।

তাঁর এই ব্যক্তিত্ব, সাহস, আকর্ষণীয় শক্তিতে মুগ্ধ হয়ে সৈনিকরা লুই এর পক্ষ ত্যাগ করে তাকে সমর্থন করল। ফরাসী সেনাপতি বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে নেপোলিয়নের পক্ষে যোগ দিলেন।

রাজা লুই বুঝতে পারলেন আর তাঁর পক্ষে প্যারিসে সমর্থন পাওয়ার জন্য উদার শাসনব্যবস্থা চালু করলেন। সাধারণ প্রজাদরে মধ্যে থেকে যোগ্য লোকদের বিভিন্ন পদে বসালেন। যারা রাজা লুই-এর সময় ক্ষমতা দখল করেছিল, তিনি তাদের বিতাড়ন করলেন।

নেপোলিয়নের এই প্রত্যাবর্তনে ইউরোপের সমস্ত দেশ আবার একত্রিত হয়ে তাঁকে বিতাড়ন করবার জন্য বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে আক্রমণ করল। নেপোলিয়ন বুঝতে পারলেন এই বিশাল সৈন্যের সাথে লড়াই করা সম্ভব হবে না। আলাদা আলাদাভাবে লড়াই করতে হবে। প্রথম আক্রমণ করলেন বেলজিয়াম। তার প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পরাজিত হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হল বেলজিয়ামের বাহিনী। প্রাশিয়ান বাহিনীও যুদ্ধে পিছু হটতে বাধ্য হল। ইংরেজ বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন ওয়েলিংটন। তিনি স্থির করলেন প্রাশিয়ান বাহিনীর সঙ্গে একসাথে মিলিত হয়ে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। এই দুটি সেনাদল যখন একত্রিত হবার জন্যে এগিয়ে চলেছে তখন তাদের বাধা দেওয়ার কোন চেষ্টাই করলেন না নেপোলিয়ন। এবং এটাই ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।

জেনারেল ওয়েলিংটন ওয়াটারলু নামে এক জায়গায় সৈন্যবাহিনী নিয়ে জমায়েত হলেন। নেপোলিয়নের সেখানে পৌঁছতে একদিন বিলম্ব হয়ে গেল। (১৮ই জুন ১৮১৫} দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হল। ওয়েলিংটনের বাহিনী যখন পরাজয়ের মুখোমুখি এসে পড়েছে, জয় যখন প্রায় নিশ্চিত, প্রাশিয়ান বাহিনী এসে যোগ দিল ইংরেজদের সাথে। সম্মিলিত বাহিনী নতুন উদ্যমে যুদ্ধ শুরু করল। একটানা কয়েকদিনের যুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ফরাসী বাহিনী। আর তারা সম্মিলিত বাহিনীর প্রতিরোধ করতে পারল না। প্রবল যুদ্ধ করে পরাজিত হলেন নেপোলিয়ন।

এই পরাজয়ের সংবাদ এসে পৌঁছাল প্যারিসে। যখন নেপোলিয়ন প্যারিসে এসে পৌঁছলেন তখন তিনি যুদ্ধের পরিশ্রমে, ক্লান্তিতে মৃতপ্রায়। তবুও তিনি তাঁর মন্ত্রীদের সাথে আলোচনায় বসলেন। তিনি বললেন, অবশিষ্ট আট হাজার সৈন্য সম্মিলিত বাহিনীকে বাধা দিক। কিন্তু মন্ত্রিসভা রাজি হল না। তারা নেপোলিয়নকে পদত্যাগের জন্য চাপ দিতে আরম্ভ করল।

অবশেষে ২২শে জুন নেপোলিয়ন পদত্যাগ করে প্যারিস ত্যাগ করলেন। কারণ সম্মিলিত বাহিনী প্যারিসের দ্বারপ্রান্তে এসে পড়েছে। তিনি জানতেন ধরা পড়লে সাথে সাথে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।

তিনি তাঁর প্রথম রানী জোসেফাইনের প্রাসাদে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। সেখানে ছিল তার পালিত কন্যা। দুজনে আমেরিকায় পালিয়ে যাওয়া স্থির করলেন। কিন্তু তাঁকে নিয়ে যাবার জন্য কোন জাহাজই এল না। সম্মিলিত বাহিনীর নেতারা তাকে সুদূর আফ্রিকার এক দ্বীপ সেন্ট হেলেনায় নির্বাসন দিল। সেখানে ব্রিটিশ গভর্নরের অধীনে জীবনের অবশিষ্ট ছটি বছর কাটাতে হল।

১৮২১ সালের ৫ই মে মাত্র বায়ান্ন বছর বয়সে ক্যানসার রোগে তাঁর মৃত্যু হল।

ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর খাঁচার পোষা পাখির মত বন্দী জীবনে প্রাণত্যাগ করলেও তিনি ইউরোপের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পুরুষ।

তথ্যসূত্রঃ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী – মাইকেল এইচ. হার্ট / সম্পাদনায় – রামশংকর দেবনাথ