জুলিয়াস সিজার (Julius Caesar )

প্রথম পাতা » জীবনী » জুলিয়াস সিজার (Julius Caesar )


জুলিয়াস সিজার

জুলিয়াস সিজার

(খ্রি: পূ: ১০০খ্রি: পূ: ৪৪)
কপালের লিখনই ছিল তাই। প্রথম, সিজার প্রথমই হবে। রোমে যদি দ্বিতীয় হতে হয় তবে সিজার বরং গ্রামে যাবে– যেখানে সে প্রথম হয়ে থাকবে। তবুও প্রথমই হতে হবে তাকে। সেটাই তার ভাগ্যলিপি! সিজারের ভাগ্যই ঠিক করে রেখেছিল, গ্রাম নয়, রোমেই প্রথম হবে সিজার। সে নেবে ‘পিতৃভূমির পিতা’ এই গর্বিত উপাধি। এসবই যেন ছিল পূর্বনিদিষ্ট। সিজার যদি আরও একটু কম উচ্চাকাঙ্ক্ষী হতো, তাহলে ইউরোপের ইতিহাস, তার সভ্যতার ধারা হয়তো বইতো অন্য খাতে।

সিজার এমন এক ব্যক্তি, যার দাবি ঈশ্বরের সঙ্গে আত্মীয়তার সূত্রে বদ্ধ তিনি। আর সিজার যখন ক্ষমতার মধ্যগগনে, তখন তার ঘোষণা, আত্মীয় নয়, তিনিই স্বয়ং ঈশ্বর। সিজার হল সেই ব্যক্তি যিনি রোমান সাম্রাজ্যের সীমানাকে উত্তর ও পশ্চিমে বিস্তৃত করেছেন, মানব ইতিহাসে এমন এক চিহ্ন রেখে গেছেন যা মুছবে না কোন সময়ই।

একদিন যে পথে সিজারের বাহিনী রোম থেকে বেরিয়েছিল বিশ্বজয়ে, একদিন পৌত্তলিক প্রতিভা সাম্রাজ্যের যে ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল–তারই ওপর গড়ে উঠেছিল খ্রিষ্ট্রীয় ইউরোপের বিরাট পরিকাঠামো। সিজারের সেই পথ ধরেই কয়েক শতাব্দী পরে খ্রিষ্ট্রীয় মিশনারিরা বেরিয়েছিল খ্রিস্ট ধর্মের অনুশাসনে পৃথিবী জয়ে।

১০২ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে সেই মাসে–যে মাসটার নাম তারই প্রতি সম্মান জানাতে চিহ্নিত হয়েছিল জুলাই নামে, সেই ১০২ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের জুলাইয়ে তাঁর জন্মের কয়েক প্রজন্ম আগেও একটা সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। কিন্তু তার গতি ছিল এলোমেলো। কখনও এদিকে। কখনও ওদিকে। ভূমধ্য সাগরের তীরে সভ্যতার কেন্দ্র হবার জন্য ছিল সে সংগ্রাম। গ্রীকরা তাদের যুদ্ধ জয়ের মধ্য দিয়ে দর্শন, সাহিত্য এবং শিল্পে বিস্ময়কর অগ্রগতির মধ্য দিয়ে মানব ইতিহাসে রেখে গেছে তাদের সদম্ভ উপস্থিতির চিহ্ন। কার্থে জিয়রা উন্নীত হয়েছিল বণিক জাতি হিসেবে শাসিত হয়েছিল বণিক ও ধনীদের দ্বারা আর সব সময় অন্তরে পুষে রেখেছিল ক্ষমতা দখলের বাসনা। আর সেই সময়ই গর্ভলক্ষ্মণহীন ইতালির মাটিতে নয়া উপনিবেশ গড়ছিল যারা তারা গ্রীক পর্যটক এবং বণিকদের কাছে থেকে দ্রুত শিখে নিচ্ছিল অনেক কিছু এবং ক্রমেই ধনী প্রতিবেশীদের ভয়ের কারণ হয়ে উঠছিল।

সে সময় রোমকে কেন্দ্র করে বলিয়ান হয়ে উঠলি যে রোমিওরা, তাদের সঙ্গে কাথেজিওদের শুরু হয়ে গিয়েছিল ক্ষমতা দখল ও শ্রেষ্ঠত্বের এক তীব্র লড়াই। সে লড়াই ছিল অস্তিত্ব রক্ষারও লড়াই। কার্থেজওদের শাসন বিস্তৃত ছিল স্পেন এবং গলের দক্ষিণ উপকূল ভাগ ধরে। রোমানরা তাদের দেখতে রীতিমত ভয়ের চোখে। কার্থেজিও নেতা হানিবলের সঙ্গে লড়াইয়ে তরা বিপর্যস্তও হয়। তাদের পরাজিত করেই হানিবলের বাহিনী অতিক্রম করে আল্পস পর্বতমালাও, বিধ্বস্ত করে ইতালিকে। এই ব্যর্থতা, এই বিপর্যয় সত্ত্বেও রোমানরা কিন্তু জাতি হিসেবে নিশ্চিহ্ন হয়ে হয়ে যায়নি। সে সময় রোম যে আশ্চর্য অনুষ্ঠানের কৌশল নিয়েছিল তারই কাছে হেরে যেটুকু জয় করেছিল সেটুকুই খুইয়ে বসে হানিবল। পরিণতিতে পূর্ণ প্রতিশোধই নেয় রোম। শুধু অধিকার নয়, কার্থেজকে ধ্বংস করে দেয় তারা। এবং শেষ পর্যন্ত তারাই হয় ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ।

রোমানদের শক্তিই নিহিত ছিল এর মধ্যে। সব কিছু গ্রহণ ও আত্মস্থ করার অসামান্য দক্ষতা ছিল তাদের। সেই সঙ্গে তারা জানত জয়ের ফলাফলকে নিজেদের কাজে লাগাতে। কার্থেজের সাধারণ মানুষের নৈতিক বল ছিল খুবই কম। তারা ছিল মুনাফা তৈরির যন্ত্রের একটি অংশ মাত্র। গ্রীসের শাসকরা অধীনস্থ রাজ্যগুলোকে হেয় করে রেখে করেছিল বিরাট ভুল। কিন্তু রোম যেমন অন্যর কাছ থেকে চিন্তাধারা গ্রহণের ব্যাপারে অকৃপণ ছিল তেমনি গ্রীক দেবতাদের মেনে নিয়েও তারা সেই দেবতাদের দেয় নতুন নতুন নাম। সেই সঙ্গে এই ভূমির অভিবাসনকারী অথবা তার অধিকৃত অঞ্চলের লোকজনের সঙ্গে ও সে এমন ব্যবহার করত যাতে তারা স্বেচ্ছায় এর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেত।

রোম বরাবরই শিক্ষা নিত ইতিহাস থেকে। সে জানত, একটি বিজয়ী শক্তি যখন জোর করে বিজিতের ওপর সবকিছু চাপিয়ে দেয়, তখন সঙ্কটের সময় একটা বড় ফাটল দেখা দিতে বাধ্য। অন্যের নীতি অনুসরণের মধ্য দিয়ে রোম খুঁজে পেত তার শক্তি। ঔপনিবেশিকদের চাতুর্যে, নাগরিকত্ব দানের মধ্য দিয়ে, সরকারের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি রূপায়ণের মধ্য দিয়ে রোম তার প্রতিপক্ষের সামনে খাড়া করে শক্ত প্রতিরোধের প্রাচীর।

জুলিয়াস সিজারের জীবন ও কর্মধারা আলোচনার সময় ইতিহাসের ঐ প্রেক্ষাপটটি মনে রাখা দরকার। এই প্রেক্ষাপট জানা না থাকলে, জুলিয়াস সিজার কিভাবে তার সমকালের বহু গুণাবলী এবং দোষ ত্রুটি ও অন্যায়ের বিরল নজির হয়ে উঠেছিলেন তা ঠিক বোঝা যাবে না।

রোমের যে সম্ভ্রান্ত পরিবারে সিজারের জন্ম, সেই পরিবারটি নিজেদের মনে করত স্বর্গের দেবতা ভেনাস এবং ইলিয়াসের উত্তরপুরুষ হিসেবে। এই দেবতার সঙ্গে সংযোগের এই ধারণাটাই স্ফীত করেছিল সিজারের গর্বকে এবং হয়তো এই গর্বই পরবর্তীকালে তাকে ভাবতে শিখেছিল, তার সমস্ত শক্তি সত্যই অতিমানবিক।

যুবক জুলিয়াসে যুক্ত হয়েছিলেন তার মহান জেনারেল ম্যারিয়াসের দলে। এই দল যখন ক্ষমতা দখল করে তখন পুরস্কার হিসেবেই রোমানদের প্রধান দেবতা জুপিটারের অর্চক পদে নিযুক্ত হন জুলিয়াস। কিন্তু এই সাফল্য ছিল ক্ষণস্থায়ী। এর কিছুদিন পরেই সপ্তমবারের জন্য কনশান পদে নির্বাচিত ম্যারিয়াসের জীবনাবসান হয়। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পদ এবং সম্পত্তি দুই হারিয়ে রোম ছাড়তে হয় ম্যারিয়াসের অনুগামীদের।

বিরোধী দল নেতা সুল্লা বিজয়ীর বেশে ফিরে আসেন রোমে। সুল্লা সিজারকে ক্ষমা করতে রাজি ছিলেন একটি মাত্র শর্তে। সে শর্ত, ঘৃণিত গণতান্ত্রিক দলের সঙ্গে যুক্ত তার যুবতী স্ত্রীকে পরিত্যাগ করতে হবে। সিজার রাজি হলেন না। এই রাজি না হওয়ার জন্য সিজারকে বরণ করতে হয় ভয়ানক বিপদকে। রোম আর তার পক্ষে তখন নিরাপদ জায়গা নয়। সিজার তাই তার সৈন্য বাহিনী নিয়ে ঘুরতে থাকেন পূর্বদিকে। এই সময়েই যুদ্ধ সম্পর্কে প্রথম শিক্ষাটি নেন তিনি, সেই শিক্ষাই পরবর্তীকালে তাকে বিরাট ভূমিকা নিতে সাহায্য করেছিল। রাজনীতির দাক্ষিণ্য আবার যখন তার ওপর বর্ধিত হল, তখন তিনি রোম ফিরে এলেন আইন শিক্ষার জন্য। সেটাই হল তাঁর রাষ্ট্র নায়ক হবার সোপান।

রোডসে বিখ্যাত অ্যাপেলেনিয়াস মোলোনের কাছে বাগীতা শিখতে গিয়ে সিজার কিছু অসৎ আমোদ প্রমোদের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। সেনাজীবনের নানা অসুবিধা আর শিক্ষণজীবনের নিষ্ঠার বাইরে এই জীবন বেশি করে টানতে থাকল সিজারকে। নাগরিক জীবনের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম জুয়ায় কেটে যেত তার দিনের অনেকটা সময়। ধারের পর ধারে তিনি যেন আকণ্ঠ ডুবে যেতে থাকলেন। শোনা যায় এক সময় তার ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় দুলক্ষ পাউন্ড। এই সময়ই স্পেনের গভর্নর পদে নিয়োগ করা হয় সিজারকে। কিন্তু তার মহাজনেরা তার স্পেনে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাদের এক কথা, আগে ঋণের অর্থ মেটাও তারপর যেখানে খুশি যাও।

এই সময় সিজারের ত্রাতা হিসেবে দেখা দিলেন রোমের বিখ্যাত ধনী ক্রাসাস। সিজারের হয়ে তিনি সব ঋণ মিটিয়ে দিলেন। কথা রইল, সিজার যখন আবার আর্থিক দিকে সচ্ছল হবে এবং সামরিক অভিযানের মাধ্যমে নিজের সুনামকে বাড়াবেন সেই সময় মিটিয়ে দেবেন ক্রাসাসের সব টাকা।

অসাধারণ দক্ষতায় সিজার এবার ধনী ক্র্যাসাসের সঙ্গে বরি পম্পের বিরোধ মিটিয়ে আবার তাদের বন্ধু করে তুললেন। এই পম্পের সামরিক দক্ষতা তাঁকে রোমের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি করে তুলেছিল। ৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, এই তিনজন মিলে যে শাসক চক্র গড়ে তুললেন তাই হল রোমের প্রথম ত্রয়ীশাসক চক্র। সিজার কন্সাশ হলেও সামরিক বিভাগের পরিবর্তে পেলেন সড়ক ও বনাঞ্চল রক্ষার দায়িত্ব।

ইউরোপের উত্তরাঞ্চলের ঘটনাপ্রবাহ তখন নজরে পড়ার মত। রাইন নদীর উত্তর তীরে জার্মান উপজাতিরা নিজেদের ততদিন প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। সেই প্রতিষ্ঠার ফলেই তারা গলে রোমকে চ্যালেঞ্জ করার সাহসও অর্জন করেছে। এসব ক্ষেত্রে অতীতে রোম তার শত্রুকে পূর্বদিকে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দিকে ঠেলে নিয়ে যেত। কিন্তু এবার সিজার তাদের উত্তর পশ্চিমে ঠেলে দিলেন। ইউরোপ যখন উপজাতি বা জাতির মহাসজ্ঞা হিসেবে গড়ে উঠছে সে সময়ও সিজারের এই দক্ষতার প্রকাশ ঘটল। আল্পসের অপর পারে যে অঞ্চল সেখানকার দায়িত্বভার চাইলেন সিজার। যখন সে ভার তাকে দেওয়া হল তিনি উৎফুল্ল হলেন বেশ ভাল পরিমাণেই। কিন্তু এই সময়ই তাকে মোকাবিলা করতে হয় বেশ কিছু কঠিন পরিস্থিতিও। শুধু যে জার্মানরাই শক্তিশালি হয়ে উঠে রোমকে চ্যালেঞ্জ করেছে তা নয়, বর্তমানের সুইজারল্যান্ড অঞ্চল থেকে এক সময় জার্মানরা বিতাড়িত করে ছিল হেলভেশিদের। সেই হেলভেশিরাও এবার রোমানদের আটলান্টিকে পৌঁছাবার যে অঞ্চলটি ১২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে থেকে রোমের দখলে ছিল সেই অঞ্চল দিয়ে যাতায়াতের অধিকার দাবি করল। এই দ্বিতীয় দাবির মোকাবিলায় সিজার অসাধারণ বুদ্ধির পরিচয় দেয়। তিনি তার সেনাবাহিনীকে দ্রুত ফিরিয়ে এনে নতুন করে সংগঠিত করে হিন্দুমাত্র দেরি না করে আক্রমণ চালান এবং শেষ পর্যন্ত হেলভেশিদের পরাজিত করেন।

এই জয়ের পরেই সিজারকে জার্মানদের হাত থেকে গল গোষ্ঠীগুলোকে রক্ষা করতে বলা হয়। জার্মান রাজ অ্যারিভিসটাসের সঙ্গে সিজারের বৈঠকও হল। রাইনের এপার থেকে গলদের নতুন করে অভিযান চালানোটাই তখন সমাধানের একমাত্র রাস্তা। তাই সিজার আক্রমণই চালালেন। আক্রমণকারীদের হঠিয়ে দিলেন রাইনের ওপারে।

পরবর্তীকালে ৫৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে উত্তর গলে নার্ভি এবং বেলজিদের উত্থানকে দমন করার সময় সিজারকে বেশি বেগ পেতে হয়েছিল। সে সময় বেলজিয়াম যুদ্ধের যে বিবরণ সিজার লিখে রেখেছিলেন ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ও গর্বের সঙ্গেই স্মরণ করা হত। পরের বছরই সিজার ব্রিটেনের ভেনেশি এবং অন্যান্য উপজাতির পরাজিত করে আরও একবার আগ্রাসী জার্মানদের রাইনের ওপারে হঠিয়ে দেন।

সিজারের এই পর্বের বিজয় অভিযান শুধু রোমেরই গৌরব বাড়ায়নি, সেই সঙ্গে বাড়িয়েছে তারও গৌরব। কিন্তু সিজার তো শুধু বিজয়ী হয়ে থেমে থাকতে শেখেননি। তিনি চেয়েছিলেন শাসক হতেও। এবং তিনি শাসন করেও গেছেন দূরদৃষ্টি দিয়েই। বিজিতদের নাগরিকত্ব দিয়ে, একই ধরনের সরকার দিয়ে তিনি রোমের ঐতিহ্যকে প্রসারিত করেছিলেন বৃহত্তর ইউরোপে। ছোট ছোট জন গোষ্ঠীকে তিনি শক্তিশালী করেছিলেন। বড় বড় সড়ক নির্মাণে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন তিনিই এবং ইউরোপের কৃষক গোষ্ঠীকেও শক্তিশালী করে তুলেছিলেন তিনিই। এইসব সংস্কারের মধ্যে দিয়ে তিনি ইউরোপের নাগরিকদের মধ্যে গড়ে তুলেছিলেন সংহতি।

রাইনের দুপার থেকে আসা অন্যান্য সংঘাত সত্ত্বেও এই উপজাতিগুলোর ওপর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করেন সিজারই। ৫৫ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে রাইন নদীর ওপর সেতু বেঁধে তিনি জার্মানদের আক্রমণ করেন। জার্মান অভিযান থেকে ফিরেই তিনি সেতুটি ধ্বংস করে দিয়ে দৃষ্টি ফেরান ব্রিটেনের দিকে। অবশ্য বলা যেতে পারে, প্রকৃত দেশজয়ের চেয়ে যুদ্ধের মহড়া দেওয়া বা শক্তি প্রদর্শনই ছিল এসব অভিযানের লক্ষ্য। কেননা, এদের মধ্যেই কয়েকটি উপজাতি ফেলজিদের সাহায্য করেছিল এবং সিজারের সেনাদলকে মাত্র দুটি বাহিনীতে সীমাবদ্ধ করে কোনদিন। এক একটি বাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা ছিল তিন থেকে ছয় হাজার মাত্র। পরের বছর অবশ্য সিজার আবার আক্রমণ চালান। এবার তিনি আসেন পাঁচটি বাহিনী এবং শক্তিশালী অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে। এবার তিনি টেমস নদীর উপড়ে পর্যন্ত চলে যান এবং গলে ফিরে যাবার আগে পরাজিতদের কাছে করও দাবি করেন। তবে এই কর অবশ্য কখনই আদায় করা হয়নি। সিজারের সামরিক জীবনে ব্রিটেন অভিযানের প্রভাব ক্ষণস্থায়ী। কেননা পরবর্তী বছর দুই তিন সিজার ব্যস্ত ছিলেন গলদের অধীনে আনার কাছে। উপজাতিগুলো বিদ্রোহ করেছে, পরাজিতও হয়েছে।

দেশের বিভিন্ন অংশে কঠিন কঠিন অভিযান চালাতে হয়েছে। কিন্তু সে সময় সিজারের বৃহস্পতি ছিল তুঙ্গে। ভাগ্যের সহায়তায় সে সময় সিজার যাতে হাত দিয়েছেন তাতেই সফল হয়েছেন। ৫২ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে জারগোভিয়ায় গলনেতা ভার্সিন গেটোরিক্সের হাতে পরাজিত হয়ে তিনি অ্যালেসিয়া (মল্ট-অক্সিস) দখল করে সম্মিলিত গণ বাহিনীকে বিধ্বস্ত করেন। তিনি গলকে তার সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত করে বার্ষিক কর ধার্য করেন। কর আদায় বিজিতরা যাতে শান্ত থাকে সে ব্যবস্থাও তিনি করেন। রোমান ঐহিত্য অনুযায়ীই তিনি যতটা সম্ভব পরাজিত শত্রুকে বন্ধুতে পরিণত করার চেষ্টা চালান।

বিজয়ী সিজার কিন্তু এবার রোমে শত্রুতার মুখোমুখি হন। শত্রুরা এবার তার বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে। সিজার জানতেন তার কর্তৃত্ব ভালভাবে প্রতিষ্ঠা করা সত্ত্বেও, ব্যর্থতার বিপদ যে কোন সময়েই আসতে পারে।

৫৬ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে যে শাসক ত্রয়ী চক্র গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যেও ফাটল দেখা দেয়। তিন বছর পরে ক্রাসাস সিরিয়ায় নিহত হন। ক্ষমতার গগনে তখন দুই সূর্য সিজার এবং পম্পে। অথচ আকাশে তো থাকে একটিই সূর্য। তাই সংঘর্ষ অনিবার্য।

পম্পে সেনেটের পক্ষে চলে গেলেন। সিজারের অধিনায়কত্বে সময় কাল পার হয়ে যাবার পরই সেনেট দাবি করেন, সিজার এবার তার বাহিনী ভেঙে দিক। উত্তরে ইতালির সীমা নির্দেশক ছোট্ট নদী রুবিকন পার হয়ে চলে এলেন সিজার তার বাহিনী নিয়ে। তিনি বলেন, মৃত্যুই ভবিষ্যৎ। এবং সেই অসাংবিধানিক কাজের জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হলেন তিনি।

পম্পে পালিয়ে গেলেন। সিজার পূর্ব উপকূলে ব্রিলেশি পর্যন্ত অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন। কিন্তু তখন স্পেনে রয়েছে পম্পের একটি বাহিনী। তাকে তখন প্রথমে সেনাপতিহীন একটি বাহিনীর সঙ্গে লড়তে হবে এবং তারপর তাড়া করতে হবে পম্পেকে এবং লড়তে হবে বাহিনীহীন এক সেনানায়কের সঙ্গে। পশ্চিমে সংক্ষিপ্ত এবং সফল অভিযান চালিয়েই তিনি রোমে ফিরে এলেন। ফিরে আসার পরেই তিনি কন্সল নির্বাচিত হলেন এবং পূর্বাঞ্চলে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। ৪৮ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে থেশানির ফ্যারশালস যুদ্ধে সিজার বিপুল ভাবে জয়লাভ করলেন। পম্পে এবার পালালেন মিশরে কিন্তু সেখানে তাকে খুন করা হয়।

শক্রর সন্ধানে সিজার মিশরে আসেন। বলা হয় এখানে তিনি বন্দি হন। বন্দি হন যুদ্ধে নয়, বন্দি হন রানি ক্লিওপেট্রার রূপের আগুনে। এখানে সিজারের একটি ছেলেও হয়। সিজার যখন মিশরে ক্লিওপেট্রার রূপমুগ্ধ সেই সময় তার শত্রুরা শক্তি সংগ্রহের সময় পেয়ে যান। সিজার শত্রুর সামনেই ফিরতে বাধ্য হন।

সিজার এবার এশিয়া মাইনরের দিকে যান। সেখানে তিনি পম্পের এক পুরনো সহযোগীকে পরাজিত করেন। এই সহযোগী হলেন পন্টাসের রাজা ফারনাসেস। তাঁরা জিলার কাছে এক তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হন। এই যুদ্ধে জয়ের ফলে সিজার নিজের অবস্থা

আরও জোরদার করেন। এই যুদ্ধে জয়ের ফলে সিজার নিজের অবস্থা আরও জোরদার করেন। এই অভিযানের সময় সিজার উচ্চারণ করেন সেই বিখ্যাত উক্তিভিনি, ভিডি, ভিসি–এলাম, দেখলাম, জয় করলাম।

ইতালিতে ফেরার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার সিজারকে বেরতে হল বিদ্রোহ দমনে। এবার তিনি ভূমধ্যসাগর পার হয়ে আফ্রিকা অভিযানে গেলেন।

শেষ পর্যন্ত তিনি ইতালিতে ফিরে এলেন। এলেন গ্রামে প্রথম হতে নয়। রোমে প্রথম হতে। তিনি প্রথমে দশ বছরের জন্য, পরে আমৃত্যু নিজেকে একনায়ক হিসাবে ঘোষণা করেলেন। স্বল্পকাল ক্ষমতায় থাকার সূত্রেই সিজার সুবিচারক হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেলেন এবং তার এই আত্মশ্লাঘাই ডেকে আনল তার মৃত্যুকে। তবুও ওই সময়েই আল্পসের ওপারেও বিস্তৃত করলেন তিনি ভোটাধিকার ও অন্যান্য রাজনৈতিক সুবিধা, উপজাতির গুলি পেল বন্ধুত্ব, ক্যালেন্ডার সংস্কার হল, স্বাধীন মানুষ পেল আরও স্বাধীনতার সুনিশ্চিত আশ্বাস, এবং জনস্বার্থে হাত দেওয়া হল বড় বড় কাজে।

এত করার পরও উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাকে যেন নেশাগ্রস্ত করে তুলল। তাঁর বংশের সঙ্গে দৈবী যোগাযোগ আছে এই বিশ্বাসের বসেই তিনি নিজেকে দেবতা বলে ভাবতে থাকলেন। চাইলেন দেবতাকে দেয় সুযোগ সম্মান। রোমকে যারা মহান গৌরবে ভূষিত করলেন, তাঁদের মধ্যেই তাঁর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি, যে মূর্তির তলায় লেখা হল ‘অজেয় দেবতার প্রতি। আধুনিক চিত্রতারকাদের মতই বিনয় দেখিয়ে আগেভাগেই তাঁর প্রতি আরোপিত গুণাবলী ও মর্যাদার কথা ঘোষণা করা হত। ‘ইশায়েটর’-লাতিনে যে শব্দটি ম্রাটের উৎস, সেই ‘ইম্পায়েটর’ দিল তার সবচেয়ে পছন্দসই উপাধি। সোনার সিংহাসন থেকে তিনি রোমকে শাসন করেছেন, অথচ রোম ছিল প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র!

সেনেট হাউসে পম্পের মূর্তির পাদদেশে ঘন ঘন অশনি সম্পাতে আলোকিত ঝড়ো হওয়ার মধ্যে ঘাতকের ছুরিকাঘাতে নিভে যায় তার জীবনদীপ। বলা হয় যারা তাঁকে খুন করে তার মধ্যে শত্রুর চেয়ে তার মিত্রই ছিল বেশি। আমরা জানি তার শেষ কথাটি ছিল, হায় ব্রুটাস, তুমিও!

সিজার সেই মৃত্যুর মুখে দেখেছিলেন তার ঘনিষ্ঠজনরাই তাঁকে নিঃসঙ্গ করেন। বুঝলেন তার সাফল্যই পরাজিত করল তাকে।

সিজারই রোমের দৃষ্টিকে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চয় থেকে উত্তর ইউরোপের দিকে প্রসারিত করেন। বিচ্ছিন্ন জাতিগুলোকে তিনিই আনেন রোমের পতাকাতলে। শুধু অসি চালনাতেই নয় মসি অর্থাৎ লেখনীতেও তিনি পারদর্শিতার চিহ্ন রেখে গেছেন তার যুদ্ধ বিবরণীতে আর গড়ে দিয়ে গেছেন তার ভাগ্নে অগস্টাসের জন্য সাম্রাজ্য গড়ার রাস্তা। সিজার চরিত্রকে অল্প কয়েকটি কথার মধ্যে তুলে ধরেছেন লর্ড টুহউসমুরি এইভাবে

“এই পৃথিবীর গুরুভার কাঁধে নিয়েও তিনি লঘুপদে চলার ক্ষমতা হারাননি। যুদ্ধ কিংবা প্রশাসন কখনই তাকে করে তোলেনি এক সঙ্কীর্ণ বিশেষজ্ঞ। তার সংস্কৃতি তাঁর সমকালের যে কোন মানুষের চেয়ে ছিল বিস্তৃত। তিনি ভালবাসতেন শিল্প এবং কবিতা, সঙ্গীত এবং দর্শনকে। জীবনের কঠিনতম মুহূর্তেও তিনি এরই মধ্যে নিমগ্ন হতেন। তাঁর মধ্যে ছিল এক সক্রিয় মানুষের বাস্তবতাবোধ, শিল্পের অনুভূতি, সৃজনশীল স্বপ্নাল ব্যক্তির কল্পনাপ্রবণতা। এতগুলো গুণের সমাহার, আমি মনে করি, আর কোথাও ঘটেনি।”
তথ্যসূত্রঃ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী – মাইকেল এইচ. হার্ট / সম্পাদনায় – রামশংকর দেবনাথ