কনফুসিয়াস (Confucius)

প্রথম পাতা » জীবনী » কনফুসিয়াস (Confucius)


কনফুসিয়াস

কনফুসিয়াস

(খ্রি: পূর্ব ৫৫১ খ্রি: পূর্ব ৪৭৯)
আড়াই হাজার বছর আগেকার কথা। চীনদেশের লু রাজ্যে বাস করতেন ল শিয়াং নামে এক অবসরপ্রাপ্ত সেনাপতি। মনে শান্তি ছিল না লু শিয়াং-এর। কারণ তিনি নয়টি কন্যার পিতা হলেও একটিও পুত্র সন্তান নেই তার। একদিন গ্রামের পথ দিয়ে যেতে যেতে তাঁর ভীষণ তেষ্টা পেয়েছিল। পথের পাশেই ছিল এক গরীব চাষীর কুটির। সেখানে গিয়ে পানি চাইতেই একটি কিশোর মেয়ে এসে পানি দিল। মেয়েটির নাম চেং সাই। তাকে দেখে লু শিয়াং-এর মনে হল মেয়েটি সর্ব সুলক্ষণা। এর গর্ভে নিশ্চয়ই তার পুত্র সন্তান জন্মাবে। চাষীকে তার মনের কথা জানায়।

লু শিয়াং-এর ইচ্ছায় চাষী এবং তার কন্যা সম্মতি দিল। সেই রাত্রিতেই মিলিত হলেন তাঁরা। কিন্তু তাঁদের এই মিলনের কথা সকলের কাছে গোপন রেখে দিলেন লু শিয়াং।

অবশেষে চেং সাই একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য লু শিয়াং-এর। পুত্র সন্তান জন্মের সংবাদ অন্য স্ত্রীদের কানে যেতেই তারা লু শিয়াংকে পাগল বলে ঘরে আটকে রাখল। কয়েক মাস পরেই তার মত্য হল।

ওদিকে চেং সাই-এর কাছেই বড় হয়ে উঠতে লাগল নবজাত শিশুসন্তান। এই শিশুসন্তানই ভবিষ্যতে কনফুসিয়াস নামে সমস্ত জগতে পরিচিত হন।

লু শিয়াং তাঁর প্রতিশ্রুতি মত কোন অর্থই দিয়ে যেতে পারেননি চেং সাইকে। কিন্তু তার জন্যে নিজের দায়িত্বকে অস্বীকার করলেন না চেং সাই।

চরম অভাব অনটনের মধ্যেও চেং সাই স্বামীর প্রতি ছিলেন খুবই শ্রদ্ধাশীল। মনে মনে স্বামীর বংশমর্যাদা তার খ্যাতি বীরত্বের জন্য গর্ববোধ করতেন।

স্কুলে যাবার বয়েস হতেই চেং কনফুসিয়াসকে স্থানীয় একটি স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। অল্প কিছু দিনের মধ্যে শিক্ষক ছাত্র সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন কনফুসিয়াস। একদিকে যেমন তাঁর ছিল জ্ঞান অর্জনের প্রবল ইচ্ছা, অন্যদিকে অসাধারণ মেধা। শুধুমাত্র স্কুলের পাঠ্যপুস্তক পড়ে তার মন ভরত না। ধর্মের প্রতি ছিল তাঁর গভীর আকর্ষণ।

মায়ের স্নেহে অভাব অনটনের মধ্যেই দিন কাটছিল কনফুসিয়াসের। কনফুসিয়াসের তখন ১৫ বছর বয়স। হঠাৎ তার মা মারা গেলেন। কনফুসিয়াসের জীবনে মাই ছিলেন সব। তার এই অকাল মৃত্যুতে কনফুসিয়াস বিরাট আঘাত পেলেন।

কিন্তু সেই কিশোর বয়েসেই নিজেকে এমনভাবে গড়ে তুলেছিলেন, এত বড় বিয়োগ বেদনাতেও ভেঙে পড়লেন না। আন্তরিক প্রচেষ্টায় নিজেকে সংযত রাখলেন।

তখনকার প্রচলিত নিয়ম ছিল স্ত্রীকে স্বামীর পাশেই কবর দেওয়া হবে। পিতার সমাধির পাশে মায়ের দেহ সমাহিত করলেন কনফুসিয়াস। নিজের গৃহে ফিরে এসে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হতেই পরিচিত জনেরা সকলে তাকে পরামর্শ দিল পিতার সম্পত্তির অধিকার দাবি করতে।

কিন্তু কনফুসিয়াসের আত্মমর্যাদাবোধ এতখানি প্রবল ছিল, তিনি বললেন, যে সম্পত্তি পিতা আমাকে দিয়ে যেতে পারেননি তাতে আমার কোন লোভ নেই।

পরবর্তীকালে কনফুসিয়াস বলতেন, আত্মমর্যাদা না থাকলে কোন মানুষই অন্যের কাছে মর্যাদা পেতে পারে না। যে মানুষের মধ্যে এই আত্মসম্মানবোধ আছে একমাত্র সেই হতে পারে প্রকৃত জ্ঞানী।

মায়ের মৃত্যুতে সাময়িক অসুবিধার মধ্যে পড়লেও নিজের বিদ্যাশিক্ষা অধ্যয়ন বন্ধ করলেন না কনফুসিয়াস। অল্প দিনের মধ্যেই তাঁর জ্ঞান, পাণ্ডিত্যের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।

কনফুসিয়াস থাকতেন লু প্রদেশে। এই প্রদেশের অন্যতম প্রধান শাসক ছিলেন চি চি-র কানেও গিয়ে পৌঁছেছিল কনফুসিয়াসের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি। প্রথম পরিচয়েই মুগ্ধ হলেন চি। কনফুসিয়াসের দারিদ্র্যের কথা শুনে তাঁকে হিসাব রাখবার কাজ দেওয়া হল অল্পদিনেই নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিলেন কনফুসিয়াস। চি খুশি হয়ে তাকে আরো উঁচু পদ দিলেন। কিন্তু পদের কোন মোহ ছিল না কনফুসিয়াসের। তার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা ছিল জ্ঞান অর্জন। যে কোন পুঁথি পেলেই গভীর মনোযোগ সহকারে তা পড়তেন। উপলব্ধি করতে চেষ্টা করতেন তার অন্তর্নিহিত সত্য। তাই যখনই সময় পেতেন পুঁথি সংগ্রহ করতেন। কিম্বা যেখানেই কোন পুঁথিসন্ধান পেতেন সেখানেই ছুটে যেতেন।

কনফুসিয়াসের চরিত্রের উদারতা মহত্ত্বতার কারণে সকলেই তাকে ভালবাসত। তখন কনফুসিয়াস সবেমাত্র যৌবনের পা দিয়েছেন। সকলের পরামর্শে বিবাহ করলেন। স্ত্রীর নাম পরিচয় সব কিছুই ছিল অজ্ঞাত। তার স্ত্রীর গর্ভে এক পুত্র, দুটি কন্যা (কারো মতে একটি কন্যা) জন্ম গ্রহণ করে। স্ত্রীর সঙ্গে কনফুসিয়াসের কি রকম সম্পর্ক ছিল তা জানা যায় না। সম্ভবত স্ত্রীর সাথে কনফুসিয়াসের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছিল। অনেকের মতে স্ত্রীর মৃত্যু হয়।

তাঁর কাজে খুশি হয়ে চি তাকে তার সমস্ত গবাদি পশুর দেখাশুনা করা, তাদের তত্ত্বাবধান করা, পালন করার সমস্ত দায়িত্বভার অর্পণ করলেন। আপাতদৃষ্টিতে সহজসাধ্য মনে হলেও কাজটি ছিল অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ।

কনফুসিয়াস তখন ত্রিশ বছরে পা দিয়েছেন। তিনি উপলব্ধি করছিলেন প্রকৃত জ্ঞান শুধু পুঁথির মধ্যে পাওয়া যাবে না। চারপাশের জগতে ছড়িয়ে রয়েছে জ্ঞানের উপকরণ। তিনি বেরিয়ে পড়তেন শহর থেকে শহরে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।

এই ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে তিনি প্রত্যক্ষ করলেন চীনদেশের প্রকৃত অবস্থা। দেখলেন সমস্ত দেশ জুড়ে শুধু অভাব অনটন। রাজা, রাজপুরুষদের নৈতিক অধঃপতন। প্রতিনিয়তই এক দেশের সাথে অন্য দেশের যুদ্ধবিগ্রহ চলেছে। কোথাও শান্তি-শৃঙ্খলা নেই। নেই ন্যায়নীতি, ধর্মবোধ।

গভীর চিন্তার মধ্যে দিয়ে তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন সমাজ জীবন, ব্যক্তি জীবন, রাষ্ট্রনৈতিক জীবন-সর্বক্ষেত্রেই প্রয়োজন শৃঙখলার। এই শৃঙ্খলা রয়েছে প্রকৃতির মধ্যে, ঈশ্বরের সমস্ত বিধানের মধ্যে। তাই দিন রাত্রি, সপ্তাহ, মাস, বৎসর বিভিন্ন ঋতু একই নির্দিষ্ট নিয়মে আবর্তিত হচ্ছে।

কনফুসিয়াস বিশ্বাস করতেন আইন বা দণ্ডের দ্বারা এই শৃঙ্খলাকে সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। আইন যতই কঠোর হবে ততই তাকে অমান্য করবার ইচ্ছা মানুষের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠবে। একমাত্র মানুষের অন্তরের বিবেকবোধ নীতিবোধই তাকে সঠিক শৃঙ্খলার পথে চালিত করতে পারে। আর এই বিবেকবোধ নীতিবোধই তাকে সঠিক শৃঙ্খলার পথে চালিত করতে পারে। আর এই বিবেকবোধ তখনই মানুষের মধ্যে জাগ্রত হবে যখন ধর্মীয় চেতনা জেগে উঠবে।

কনফুসিয়াসের মধ্যেকার এই উপলব্ধি, গভীর জ্ঞান, প্রজ্ঞা দেশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। দূর দূরান্ত থেকে ছাত্ররা আসতে আরম্ভ করল তার কাছে। তাদের শিক্ষাদনের জন্য তিনি একটি এ্যাকাডেমি স্থাপন করলেন।

কিন্তু কনফুসিয়াস শুধু জ্ঞানী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন একজন আদর্শ শাসক হতে।

তাই জ্ঞানী হিসাবে যেমন ছাত্রদের শিক্ষা দিতেন, অন্যদিকে সংস্কারক হিসাবে সমাজের ক্রটি-বিচ্যুতিগুলোকে কঠোর ভাষায় নিন্দা করতেন। নানান বিষয়ে সুপরামর্শ দিতেন।

তাঁর আকৃতি ছিল কুৎসিত। অস্বাভাবিক দীর্ঘদেহ, মাথাটি ছিল বিশাল আকৃতির, চওড়া মুখ। ছোট দুটি যথেষ্ট বড়। নাকটি ছিল স্বাভাবিক দ্বিগুণ। যখন তিনি হাঁটতেন, হাত দুটো পাখির ডানার মত দুপাশে ছড়িয়ে থাকত। পিঠটা ছিল কালো কচ্ছপের মত।

এই দৈহিক অপূর্ণতা সত্ত্বেও ভ্রমর যেমন মধুর আকর্ষণে ফুলের কাছে আসে, মানুষও তেমনি তার জ্ঞানের প্রদীপ্ত শিখায় নিজেকে আলোকিত করবার জন্য শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে থাকে।

শিক্ষক হিসাবে আচার্য হিসাবে তার খ্যাতি ক্রমশই দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। এতদিন শুধু সাধারণ ঘরের ছেলেরাই তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করত। ক্রমশই অভিজাত ঘরের ছেলেরাও তার কাছে জ্ঞান লাভের জন্য শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে আরম্ভ করল। কনফুসিয়াস কোন দরিদ্র ছাত্রের কাছ থেকে অর্থ না নিলেও ধনীদের কাছ থেকে অর্থ নিতেন। ক্রমশই কনফুসিয়াস আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল হয়ে উঠলেন।

এই সময় আরো একটি ঘটনার অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে কনফুসিয়াসের প্রভাব আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পেল।

কিন্তু আকস্মিকভাবে দেশে দেখা দিল সামরিক বিপর্যয়। প্রতিবেশী দেশের আক্রমণ দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন কনফুসিয়াস। অন্য এক দেশে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। সেই রাজ্যের শাসনকর্তার নাম ছিল চিং।

কনফুসিয়াসের প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই করে দিলেন। মাঝে মাঝেই তিনি কনফুসিয়াসের কাছে এসে নানান বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণ করতেন। একদিন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, একজন শাসনকর্তার প্রকৃত সাফল্য কিভাবে নিরূপণ করা যায়?

কনফুসিয়াস বললেন, একজন শাসক তখনই সফল যখন তিনি প্রকৃতই শাসক। ভৃত্য সকল সময়েই ভৃত্য, পিতা প্রকৃতই পিতা, পুত্র সত্যিকারের পুত্র।

ডিউক চিং উপলব্ধি করলেন কনফুসিয়াসের কথার প্রকৃত তাৎপর্য। যিনি প্রকৃতই শাসক তার মধ্যে একাধিক গুণের সন্নিবেশ ঘটবে। একটি গুণের অভাব ঘটলেও তিনি প্রকৃত শাসক বলে পরিগণিত হবেন না।

দীর্ঘ সাত বছর ডিউক চিং-এর রাজ্যে সুখেই দিন কাটিয়ে দিলেন কনফুসিয়াস।

সেই সময় ইয়াং হু নামে চি রাজবংশের এক ভৃত্য ছিল। নিজের বুদ্ধি চতুরতায় রাজাকে নির্বাসিত করে রাজ্যের ক্ষমতা দখল করে নিল। কনফুসিয়াসকে নিজের রাজ্যে

আমন্ত্রণ করে এনে তাঁকে উচ্চপদ দিতে চাইল।

তিনি জানতেন ইয়াং হু শুধু মাত্র প্রবুর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেনি, সে পররাজ্যলোভী হীন চরিত্রের মানুষ। এমন মানুষকে সাহায্য করবার সামান্যতম ইচ্ছা ছিল না কনফুসিয়াসের।

একদিন ইয়াং হু নিজে গিয়ে কনফুসিয়াসের সাথে সাক্ষাৎ করল। ইয়াং হুর আন্তরিক ইচ্ছা লক্ষ্য করে কনফুসিয়াস সাময়িকভাবে বিচলিত হয়ে পড়লেন। প্রথমে স্থির করলেন মন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। কিন্তু অল্প কয়েক দিনেই অনুভব করলেন, নাগরিক হিসাবে রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য পালনের দায়িত্ব অস্বীকার করা নৈতিক অপরাধ হলেও ইয়াং হুর মত শাসকের কাছে স্বাধীনভাবে রাজ্যের উন্নতি সাধন করা সম্ভব নয়।’

দৈবক্রমে সেই সময় পার্শ্ববতী লু রাজ্য থেকে কনফুসিয়াসের কাছে প্রধানমন্ত্রী হবার আমন্ত্রণ এল। এই রাজ্যের প্রধান ছিলেন ডিউক তিং। তিনি রাজ্যের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের প্রধান পরামর্শদাতা হিসাবে কনফুসিয়াসকে নিযুক্ত করলেন। ডিউক তিং নিজেও কোন দরকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবার সময় কনফুসিয়াসের পরামর্শ গ্রহণ করতেন।

অল্প দিনের মধ্যেই লু রাজ্যের অভূতপূর্ব উন্নতি দেখা দিল। সকল বিশৃঙ্খলা দূর হল। দেশের রাজস্ব বৃদ্ধি পেল। সাধারণ নাগরিকদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ বহুগুণ বৃদ্ধি পেল।

লু রাজ্যের এই সর্বাঙ্গীন উন্নতি দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ল প্রতিবেশী রাজ্যের রাজারা। তারা গোপনে ষড়যন্ত্র করতে আরম্ভ করল কিভাবে রাজা তিং ও প্রধানমন্ত্রী কনফুসিয়াকে হত্যা করা যায়।

কনফুসিয়াসের এতখানি দূরদৃষ্টি ছিল, তিনি জানতেন শুধু আভ্যন্তরিণ শান্তি বজায় রাখলে চলবে না,বিদেশী শত্রুর প্রতিও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে। গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন, শত্রুপক্ষের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল।

রাজ্যে মধ্যে কিছু কিছু সামন্ত ছিল যারা ডিউক তিং-এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেনি। একে একে তাদের সকলকে পরাজিত করে তিং-এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিদের সামন্ত পদে বসালেন।

কনফুসিয়াস জানতে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে মানুষের মধ্যে ক্ষমতার লোভ প্রবল হয়ে ওঠে। যাতে তারা বিদ্রোহ করে ডিউকের বিরুদ্ধে কোন বিপদের সৃষ্টি না করতে পারে, সেই কারণে সমস্ত সমস্ত রাজাদের অস্ত্র ও সৈন্যসংখ্যা সীমিত রাখবার হুকুম দিলেন।

কনফুসিয়াস বিশ্বাস করতেন মানুষের মধ্যে যদি নৈতিক চরিত্রের উন্নতি বিধান না করা যায়, শুধুমাত্র আইনের শাসনে মানুষকে সংযত রাখা সম্ভব হয় না-তাছাড়া সুদীর্ঘ কালও শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব নয়। তাই কনফুসিয়াস নিজেই তাদের মধ্যে ধর্মবোধ নীতিবোধ জাগ্রত করবার জন্য নানান উপদেশ দিতেন। অল্প দিনেই এর সুফল দেখা দিল।

সমগ্র চীনদেশে সেই সময় লু ছিল একমাত্র রাষ্ট্র যেখানে চুরি, ডাকাতি, খুন হত না। সকলেই নির্ভয়ে নিরাপদে নিজের দ্ৰব্য রাখতে পারত। গভীর রাতেও পর্যটকরা নির্ভয়ে পথ চলতে পারত।

একদিন রাজা ডিউক শিকারে যাচ্ছিলেন। পথে একদল সুন্দরী মেয়েকে তার রথের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। তাদের রূপে মুগ্ধ ডিউক ভুলে গেলেন শিকার। তাদের নিয়ে আনন্দে মত্ত হয়ে রইলেন কয়েক দিন। রাজকার্যে মন নেই! বন্ধ হয়ে গের পূজা আচার অনুষ্ঠান।

কনফুসিয়াস মনে মনে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। রাজার এই নৈতিক স্খলন গুরুত্বর অপরাধ বলে মনে হল তাঁর।

তৎক্ষণাৎ প্রধানমন্ত্রীর পদে ইস্তফা দিয়ে লু রাজ্য ত্যাগ করে পথে বেরিয়ে পড়লেন। তখন তার বয়স চুয়ান্ন। সঙ্গে কয়েকজন মাত্র অনুগত শিষ্য।

কনফুসিয়াস উপলব্ধি করতে পারেন তার আদর্শকে গ্রহণ করবার মত মানুষ কোথাও নেই। তবুও তিনি শিক্ষা দিতে থাকেন। তাঁর ছাত্র সংখ্যা বেড়েই চলে। তিনি যেখানে যখন যেতেন সেখানেই তার সঙ্গে ছাত্রেরা যেত।

কনফুসিয়াস যখন যে রাজ্যে যেতেন সেইখানে খোঁজ করতেন, কোথায় গ্রন্থাগার আছে। সেখানে কোন প্রাচীন পুঁথির সন্ধান পেলেই গভীর মনোযোগ সহকারে তা পড়তেন। সমস্ত জীবন তিনি নিজেকে মনে করতেন একজন শিক্ষার্থী। তাই যখন যেখানেই কোন জ্ঞানের সন্ধান পেতেন আগ্রহভরে তাকে গ্রহণ করতেন।

কনফুসিয়াসের জ্ঞানের কোন সীমা ছিল না। অতলান্ত সমুদ্রের মতই ছিল তার প্রজ্ঞা তাই দেশের যে প্রান্তেই যেতেন না কেন, সাধারণ প্রজা থেকে আরম্ভ করে ডিউজ রাজারও অবনত মস্তকে শ্রদ্ধায় তাঁর কাছে মাথা নত করত।

যখন কেউ কনফুসিয়াসকে প্রশ্ন করত মহত্ত্বতার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন কি? তিনি উত্তর দিতেন দয়া ও ত্যাগ। অন্যের প্রতি যখন মানুষের দয়া ও ভালবাসা জাগ্রত হবে তখন সে হবে প্রকৃত অর্থেই মহৎ মানুষ। তার উপরেই ঈশ্বরের আশীর্বাদ নিয়ত বর্ষীত হয়। অর্থলিন্দু মানুষ কখনো মহৎ হতে পারে না। সে নিয়তই ঈশ্বরের কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে।

একদিন কনফুসিয়াসের এক শিষ্য তাঁকে প্রশ্ন করলেন, আমাদের সমাজ জীবনে মাঝে মাঝে মহৎ মানুষের আবির্ভাব হয়-এই মহৎ মানুষের সাথে অন্য সাধারণ মানুষের তফাৎ কি?

কনফুসিয়াস উত্তর দিলেন, একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ তার পারিপার্শ্বিক সমস্ত কিছুকেই গভীরভাবে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ কোন কিছুই গভীরভাবে চিন্তা করে না। শ্রেষ্ঠ মানুষেরা মনে করেন ঈশ্বরের ইচ্ছায় সব কিছু চালিত হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ ভাগ্যের হাতেই নিজেকে সঁপে দেয়। শ্রেষ্ঠ মানুষ সর্বদাই নিজের ক্রটি বিচ্যুতিকে বড় করে দেখে। এই ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করে জীবনকে আরো ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়াই থাকে তার লক্ষ্য। কিন্তু সাধারণ মানুষ সর্বদাই অন্যের ত্রুটি-বিচ্যুতিকে বড় করে দেখে-নিজেকে মনে করে সর্বদোষ মুক্ত।

সেই সময় কনফুসিয়াস ছিলেন চেন রাজ্যে। তখন চীনের অধিকাংশ অঞ্চল জুড়ে চলছে বিশৃঙ্খলতা। চেন রাজ্যেও শুরু হয়েছে অরাজকতা। শত্রু সৈন্য সীমান্ত অঞ্চলে জড় হয়েছে।

কনফুসিয়াস তাঁর শিষ্যদের বললেন, এই দেশ ত্যাগ করে অন্য কোন দেশে যেতে হবে।

কনফুসিয়াস বুঝল, আমরা মানব সমাজে বাস করি। মানুষের সমস্যা দেখে যদি পালিয়ে যাই তবে কখনোই যথার্থ মানুষ হয়ে উঠতে পারব না। পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আমাদের সচেষ্ট হতে হবে।

আবার চেন রাজ্যে ফিরে এলেন কনফুসিয়াস। তিনি তিন বছর সেখানে রয়ে গেলেন। তারপর কনফুসিয়াস গেলেন সাই নামে এক রাজ্যে। এই সময় চু নামে এক রাজ্যের বাইরে শিবির করেছিলেন। তারা কনফুসিয়াসকে সাক্ষাতের জন্য আমন্ত্রণ জানাল।

চু রাজার ইচ্ছে ছিল কনফুসিয়াসকে তার রাজ্যে একটি জমিদারী দান করবেন যাতে কনফুসিয়াস তাঁর রাজ্যেই স্থায়ীভাবে বাস করতে পারেন। কিন্তু চু রাজার প্রধানমন্ত্রী কনফুসিয়াসকে পছন্দ করত না। তার ভয় ছিল কনফুসিয়াসের মত জ্ঞানী পণ্ডিত মানুষ যদি চু রাজ্যে থাকে তবে রাজা তার পরামর্শ মতই সকল কাজ করবে। তাই প্রধানমন্ত্রী রাজাকে জমি দান করতে নিষেধ করল।

কনফুসিয়াস আবার পথে বেরিয়ে পড়লেন। মাঝে মাঝেই তার মনে পড়ল রাজ্যের কথা। এই লু রাজ্যেই নিজের নীতি আদর্শকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন তিনি। এক এক বার মনে হত তিনি ফিরে যাবেন লু রাজ্যে। পরমুহূর্তেই মনে হত যদি তারা তাকে গ্রহণ না করে। মনে মনে ব্যথিত হতেন কনফুসিয়াস।

অবশেষে কনফুসিয়াসের মনের আকাক্সক্ষা পূর্ণ হল। একদিন কনফুসিয়াস তাঁর শিষ্যদের নিয়ে এক শিবিরে বিশ্রাম করছিলেন। এমন সময় তিনখানি রথ এসে দাঁড়াল সেখানে। রথ থেকে নামল লু রাজ্যের তিন উচ্চপদস্থ কর্মচারী। তারা কনফুসিয়াসকে অভিবাদন করে বলল, তারা মহামান্য ডিউকের আদেশে কনফুসিয়াসকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছেন।

কনফুসিয়াস শিষ্যদের নিয়ে ফিরে এলেন লু রাজ্যে। রাজ্যের ডিউক ব্যারন উচ্চপদস্থ কর্মচারী সকলেই তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানাল। কারণ তারা উপলব্ধি করতে পেরেছিল কনফুসিয়াসের মত মানুষ খুব বেশি জন্মগ্রহণ করেন না। তাঁকে পরামর্শদাতা হিসাবে পাওয়া সকল রাজ্যের ভাগ্যের ঘটে না।

কিছুদিনের মধ্যেই লু রাজ্যে ফিরে এল তার পূর্বের সমৃদ্ধি। তিনি রাজ্যের শাসনভার পরিচালনার জন্য যে সব উপদেশ দিতেন তা আধুনিককালেও সমান গুরুত্পূর্ণ। তিনি বলতেন সরকার শুধু গরীবদেরই দেখাশুনা করবে না, বৃদ্ধ ও অশক্তদেরও সাহায্য করবে। তিনি কাজের শ্রমবিভাগ করে দিলেন। যে যার যোগ্যতা সামর্থ্য অনুসারে কাজ করবে। তিনি বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য বেঁধে দিলেন। দেশের উন্নয়নের কাজ চালিয়ে যাবার জন্য ব্যবসায়ী ও ধনী ব্যক্তিদের উপর নির্দিষ্ট হারে কর ধার্য করা হল। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করা হল। পুরনো রাস্তা ব্রিজ যাতে নিয়মিত মেরামত করা হয় সেই দিকে নজর রাখবার জন্য কর্মচারী নিয়োগ করা হল। তিনি বলতেন দেশের সর্বত্রই যেন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশের ধনী-দরিদ্র কোন মানুষই যেন ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত না হয়।

কনফুসিয়াস একাত্তর বছরে পা দিয়েছেন। মাঝে মাঝেই তার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ছিল। বুঝতে পারছিলেন তার জীবন শেষ হয়ে আসছে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৯, সঠিক দিনটি জানা যায় নি। কনফুসিয়াস তার শিষ্যদের কাছে ডাকলেন, বললেন, তোমারই আমার শেষ কাজ করবে। কোন আড়ম্বর করো না। বিলাস আড়ম্বরের মধ্যে দিয়ে গেলে ঈশ্বরের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে পারব না।

কনফুসিয়াসের মৃত্যুর পর শিষ্যরা তাঁর সমাধিস্থলকে ঘিরে মন্দির গড়ে তুলল। সেখানেই কুঁড়েঘর করে বাস করতে থাকে। তিন বছর ধরে এইভাবে তারা শোক পালন করে।

কনফুসিয়াস নতুন কোন ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেননি। কোন মতবাদ বা দর্শনের জন্ম দেননি। বা কোন রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করেননি। তিনি ছিলেন বাস্তববাদী। যা কিছু ছিল তাকেই নতুনভাবে প্রয়োজন অনুসারে পরিবর্তন করেছেন। যখন কেউ তাকে স্বর্গ, ঈশ্বর সম্বন্ধে প্রশ্ন করত, তিনি নিজের বুকের উপর হাত রেখে বলতেন, এখানেই আছে স্বর্গ ঈশ্বর।

তিন বলতেন, দয়া, সততা, পবিত্রতা, ভালবাসা, জ্ঞান, মহত্ত্বতা মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ গুণ। এই সব গুণের মধ্যে দিয়েই মানুষ নিজেকে দেবত্বে উন্নীত করতে পারে, অন্যের শ্রদ্ধা-ভালবাসা অর্জন করতে পারে।

কনফুসিয়াসের মধ্যে এই সমস্ত গুণের সমাবেশ ঘটেছিল বলেই আজও লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে তার শ্রদ্ধার আসন পাতা রয়েছে।

তথ্যসূত্রঃ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী – মাইকেল এইচ. হার্ট / সম্পাদনায় – রামশংকর দেবনাথ