হো চি মিন (Ho Chi Minh)
প্রথম পাতা » জীবনী » হো চি মিন (Ho Chi Minh)হো চি মিন
(১৮৯০–১৯৬৯)
সকলে তাঁকে ডাকে আঙ্কেল বলে। রোগা পাতলা চেহারা, মুখে সামান্য দাড়ি। পরনে সাদাসিদে পোশাক। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই কি অফুরন্ত প্রাণশক্তি আর তেজ লুকিয়ে আছে মানুষটির মধ্যে।
সমস্ত বিশ্বের কাছে তিনি বিপ্লবের প্রতীক, আলোকের দূত, ভিয়েত্নামের প্রাণপুরুষ হো চি মিন।
কোন কোন মানুষ জীবনে সংগ্রাম করেন। আবার কারোর গোটা জীবনটাই সগ্রাম। হো চি মিন ছিলেন চিরসংগ্রামী সৈনিক। ১৮ বছর বয়সে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য শুরু হয় তাঁর সংগ্রাম। ৭৯ বছর বয়সে যখন তাঁর জীবন শেষ হল তার প্রাক মুহূর্ত পর্যন্ত সংগ্রাম করে গিয়েছেন আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। যেদিন সেই সংগ্রাম শেষ হল জয়ী হল তার স্বদেশভূমি, সে দিন তিনি তা প্রত্যক্ষ করবার জন্য পৃথিবীতে না থাকলেও, পৃথিবীর মানুষের অন্তরে ধ্রুবতারার মত চিরজীবী হয়ে রইলেন।
১৮৯০ সালের ১৯ মে উত্তর ভিয়েত্নামের নখেআন প্রদেশের এক গ্রামে হো চি মিনের জন্ম। তাঁর পিতৃদত্ত নাম নগুয়েন থান থাট। বাবার নাম নগুয়েন মিন হুয়ে। তাঁরা ছিলেন তিন ভাইবোন। হো ছিলেন সকলের চেয়ে বড়। বাবা ছিলেন এক দরিদ্র চাষী। যখন চাষের কাজ থাকত না, অন্যের জমিতে খেতমজুরের কাজ করতেন। ছেলেবেলা থেকেই দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হয়ে উঠেছিলেন তিনি। শিশু বয়েস থেকেই হো ছিলেন গ্রামের সমবয়সীদের চেয়ে আলাদা। শান্ত ধীর। অন্যেরা যখন খেলা করত, তিনি বাবাকে কাজে সাহায্য করতেন। সারা দিন নানান কাজকর্মে কেটে যেত। রাতের বেলায় মায়ের কাছে শুয়ে গল্প শুনতেন। ছেলেবেলা থেকেই হো-কে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করত বীর মানুষদের গল্পগাথা। হোয়ের শৈশবে মায়ের সান্নিধ্য ছিল সবচেয়ে প্রিয়। সেই সান্নিধ্য বেশিদিন ভোগ করতে পারলেন না হো হো তখন এগারো বছরের বালক।
ছেলের বিমর্ষতা দেখে গ্রামের পাঠশালায় তাঁকে ভর্তি করে দিলেন নগুয়েন। অল্পদিনেই পড়াশুনায় আগ্রহ জন্মে গেল হোয়ের। পাঠশালার প্রাথমিক পাঠ শেষ করলেন।
হো ছিলেন পাঠশালার সেরা ছাত্র। ছেলের এই আগ্রহ দেখে নগুয়েন স্থির করলেন, তাঁকে বড় স্কুলে ভর্তি করে দেবেন।
গ্রামে বড় স্কুল ছিল না। হো ভর্তি হলেন হুয়ে শহরের হাই স্কুলে। এই প্রথম গ্রামের বাইরে এলেন হো। এ তাঁর চেনাজানা পরিবেশ নয়, অন্য জগৎ। এতদিন ছিলেন স্বাধীন। শহরে এসে হো প্রথম উপলব্ধি করলেন তাঁরা পরাধীন। তাদের দেশ শাসন : করছে বিদেশী ফরাসীরা। নিজেদের মাতৃভূমিতেও নিজেদের কোন অধিকার নেই।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফরাসী। অন্য শিক্ষকরা ভিয়েন্নামী হলেও প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কিছু বলার অধিকার নেই। স্বেচ্ছাচারীর মত স্কুল চালান প্রধান শিক্ষক। একদিন উঁচু ক্লাসের ছেলেরা স্থির করে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে হবে।
স্কুলে নিয়ম ছিল ক্লাসে প্রধান শিক্ষক ঢুকলেই সকলে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাবে। কিন্তু সেদিন ক্লাসে ঢুকলেন প্রধান শিক্ষক। শুধু ফরাসী ছাত্ররা উঠে দাঁড়াল, একটি ভিয়েনামী ছাত্র ও উঠে দাঁড়াল না। রাগে ফেটে পড়লেন প্রধান শিক্ষক। ভিয়েৎনামীদের এত সাহস তাকে অপমান করে! ক’টাকে স্কুল থেকে বের করে দেবেন। তার আগে জানতে হবে ছাত্ররা কেন তাকে অপমান করল।
একেবারে পেছনে বসেছিলেন হো চি মিন। গাঁয়ের শান্ত শিষ্ট মুখচোরা লাজুক ছেলে। পড়াশুনায় ক্লাসের সেরা। প্রধান শিক্ষকের মনে হল হোর কাছ থেকে আদায় করতে পারবেন আসল সত্য। নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন কাদের প্ররোচনায় ছাত্ররা তাঁকে অপমান করল।
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রাইলেন হো। প্রাণ গেলেও নিজের সহপাঠীদের নাম বলবেন না।
তার নীরবতা দেখে রেগে উঠলেন প্রধান শিক্ষক। আবার জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু আগের মতই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন হো। চিৎকার করে উঠলেন প্রধান শিক্ষক, কেন তোমরা আমাকে অপমান করলে?
এইবার মুখ তুলে তাকালেন হো। অকম্পিতভাবে দৃপ্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, আমরা প্রতিবাদ করেছি কারণ আপনি প্রধান শিক্ষক হয়েও ছাত্রদের মধ্যে বিভেদ করেন। ভিয়েনামী ছাত্রদের সাথে অন্যায় ব্যবহার করেন…।।
হো চি মিন জানতেন এর পরিণাম কি। কিন্তু প্রতিবাদে মুখর হতে তার বুক এতটুকু কাঁপেনি। বেতের ঘায়ে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত হয়ে প্রথম অনুভব করলেন পরাধীনতার যন্ত্রণা। সেই কিশোর বয়েসেই মনস্থির করলেন পরাধীনতার গ্লানি থেকে দেশকে মুক্ত করার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। কিন্তু তার আগে জানতে হবে দেশের ইতিহাস, বিশ্বের ইতিহাস, মানুষ কেমন করে সংগ্রামের পথে গর্জন করেছে স্বাধীনতা।
ভিয়েনামের ইতিহাস সুপ্রাচীন কালের নয়। ইন্দোচীনের টংকিন, আনাম কোচিন চায়না–এই নিয়ে আজকের উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েত্রাম। গত শতাব্দীর প্রথম দিকে ফরাসী খ্রিস্টান মিশনারীরা ভিয়েত্রামে আসে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশে। তখন ম্রাট ছিলেন মিং মাং। সম্রাট ধর্মযাজকদের ভালভাবে গ্রহণ করতে পারেন নি। প্রথমে তিনি তাদের ভিয়েনামে বসবাসের অনুমতি দেননি। কিন্তু যাজকদের আন্তরিক অনুরোধে শেষ পর্যন্ত বসবাসের অনুমতি দেননি। কিন্তু যাজকদের আন্তরিক অনুরোধে শেষ পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসবাসের অনুমতি দিলেন।
কয়েক বছর নিজেদের মধ্যেই ধর্মচর্চা করে কাটিয়ে দিলেন ফরাসী মিশনারীরা। তারপর ধীরে ধীরে নিজেদের স্বরূপ প্রকাশ পেতে লাগল। শুরু হল সাধারণ ভিয়েত্নামীদের মধ্যে ধর্মপ্রচার। দারিদ্র অনাহারক্লিষ্ট শোষিত বঞ্চিত কিছু পাওয়ার আশায় দলে দলে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করতে আরম্ভ করল। ক্রুদ্ধ হলেন সম্রাট মিংমাং। তাঁর আদেশে সাময়িক ধর্মপ্রচার বন্ধ রাখলেও অল্পদিনের মধ্যেই স্বমূর্তি ধারণ করল তারা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিষ্ঠিত হল উপাসনালয়। নতুন নতুন ধর্মপ্রচারকের দল এসে ভিড় করতে লাগল ভিয়েনামে।
এইবার শুধু সম্রাট নন, স্থানীয় মানুষরাও খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের বিরুদ্ধে রাগে ফেটে পড়ল। উন্মত্ত মানুষের আক্রমণে মারা পড়ল অনেক ধর্মযাজক। অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেল ফ্রান্সে।
নিজের দেশের ধর্মযাজকদের বিরুদ্ধে এই অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ জানাতে ক্রুদ্ধ ফরাসী সম্রাট বিরাট এক সৈন্যবাহিনী পাঠালেন ভিয়েত্রামে। ১৮৬০ সাল নাগদ তারা অধিকার করল সায়গন। ভিয়েম সরকার বাধা দিয়েও পরাজিত হল। সায়গনেই ফরাসী সৈন্যরা স্থায়ী আস্তানা গাড়ল। সেখানে তৈরি হল দূর্গ। দীর্ঘ কুড়ি বছর তারা নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে ১৮৮৩ সালে দখল করল হ্যাঁনয় আর হাইফা। এরই সাথে সমগ্র ভিয়েনামের উপর নিজেদের প্রভুত্ব কাযেম করল ফরাসীরা।
স্বাধীনতা হারিয়ে যারাই প্রতিবাদ করল তাদের উপর শুরু হল নির্মম অত্যাচার। দেশের সমস্ত উচ্চ পদে বসানো হল ফরাসীদের। আর কিছু মানুষ হয়ে পড়ল ফরাসীদের অনুগত তাঁবেদার। নির্বিবাদে ফরাসীরা তাদের শাসন শোসণ চালিয়ে যেতে সক্ষম হল।
বিংশ শতকের প্রথম থেকে ভিয়েত্নামের সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ সঞ্চারিত হতে থাকে। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু আন্দোলন হলেও সুসংহত কোন আন্দোলন গড়ে ওঠেনি।
এ সময়ে হুয়ে শহরে গড়ে উঠেছিল এক গোপন বিপ্লবী সংগঠন। হো চি মিন এই সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়লেন। তখন তার বয়স মাত্র ১৮। এই সংগঠন গোপনে জনগণের মধ্যে প্রচার চালাত।
হো ঘুরে ঘুরে প্রচারপত্র বিলি করতেন। জনগণকে বোঝাতেন অত্যাচারী ফরাসীদের দেশ থেকে বিতাড়িত করতে না পারলে মানুষের মুক্তি নেই।
একদিন ধরা পড়ে গেলেন হো। পুলিশের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে আধমরা অবস্থায় বাড়ি ফিরলেন। সুস্থ হয়ে উঠতে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। সকলে ভেবেছিল হোর বিপ্লবী আন্দোলনের মোহ এইবার চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু হো ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ। এই অত্যাচার তার বুকের মধ্যে জাড়িয়ে তুলল তীব্র ঘৃণা আর বিদ্বেষ।
পুরোপুরিভাবে তিনি বিপ্লবী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অল্পদিনেই হয়ে উঠলেন বিপ্লবী আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা। ফরাসী শাসকরা নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকে না। তাদের গুপ্তচর বাহিনীর সজাগ দৃষ্টি থাকে সকলের উপর। একটা ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। শুরু হয়ে যায় ধরপাকড়। বেশির ভাগ নেতাই ধরা পড়ে যায়। আত্মগোপন করেন হো চি মিন। কিন্তু তার গোপন আস্তানার কথা অজানা থাকে না। গভীর রাতে বেরিয়ে পড়েন এক আস্তানা থেকে আরেক আস্তানায়। ক্রমশই বুঝতে পারছিলেন এইভাবে বেশি দিন আত্মগোপন করে থাকা সম্ভব নয়।
এই সময় সংবাদ পেলেন একটি বিদেশগামী জাহাজ বন্দরে ভিড়েছে। জাহাজে কিছু নাবিকের প্রয়োজন। হো স্থির করলেন তিনি ঐ জাহাজে করে পশ্চিমের দেশে পাড়ি দেবেন। এর পেছনে দুটি উদ্দেশ্য ছিল, প্রথমত ফরাসী কর্তৃপক্ষের চোখে ধূলো দেওয়া, দ্বিতীয়ত বিদেশে গিয়ে নিজেকে উন্নত করা। সেই সমস্ত দেশের শিক্ষা সংস্কৃতি শাসন ব্যবস্থা সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করা।
কয়েকজন বন্ধুর চেষ্টায় নাবিকের চাকরি পেয়ে গেলেন হো। যথাসময়ে জাহাজ ভিয়েনামের বন্দর ছেড়ে রওনা হল ইউরোপের পথে। জীবনে এই প্রথম সংকীর্ণ গণ্ডির সীমানা ছাড়িয়ে বৃহত্তর জগতের মুখোমুখি হলেন হো।
নাবিকের কঠোর পরিশ্রমসাধ্য জীবনে নিজেকে অভ্যস্ত করে নিলেন। কাজের অবসরে তিনি জাহাজের বিভিন্ন দেশের মানুষের সাথে আরাপ করতেন। তাদের কাছ থেকে শুনতেন তাদের দেশের কথা, সংস্কৃতির কথা, জানতেন তাদের আচার ব্যবহার। জানবার শেখবার একটা তীব্র কৌতূহল ছিল তাঁর।
জাহাজ যখন যে বন্দরে ভিড়ত তিনি সেখানে গিয়ে সব কিছু দেখতেন। অনুভব করতেন স্বাধীন দেশে বেঁচে থাকবার আনন্দ। নিজের দেশের মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখকষ্টের কথা ভাবতে ভাবতে তার সমস্ত মন বেদনায় ভরে উঠত। ভুলে যেতেন নিজের দুঃখ-কষ্টের কথা।
এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরতে হো এসে পৌঁছলেন ফ্রান্সে। যে ফরাসীদের প্রতি ছিল তার অন্তরের তীব্র ঘৃণা আর বিদ্বেষ, ভাগ্যের ফেরে তাঁকে ফ্রান্সে এসেই আশ্রয় নিতে হল।
প্যারিসে এসে প্রত্যক্ষ করলেন এ যেন এক অন্য জাতির দেশে এসেছেন। ভিয়েনামের বুক উপনিবেশ গড়ে তোলা ফরাসীদের সাথে সামান্যতম মিলনেই। সভ্য ভদ্র মার্জিত রুচি সুস্থ সাংস্কৃতির চেতনায় উদ্বুদ্ধ। রুশো, ভলতেয়ারের দেশের মানুষদের দেখে মুগ্ধ হলেন হো।
স্থির করলেন বিপ্লবের জন্মভূমি ফ্রান্সে থেকেই অর্জন করবেন বিপ্লবের মন্ত্র। অজানা অপরিচিত শহর। দুবেলা দুমুঠো খাবার মত সামান্য সংস্থান নেই। মাথা গোঁজবার মত আশ্রয় নেই। ছোট একটা দোকানে কাজ জুটিয়ে নিলেন। কোন দিন খাবার জোটে কোনদিন জোটে না। পাশে ফরাসী পুলিশের নজরে পড়েন তাই কোথাও বেশি দিন থাকেন না। যখন যেখানেই থাকেন সর্বক্ষণ মনে হয় নিপীড়ত স্বদেশবাসীর কথা। কেমন করে পরাধীনতার পাগপাশ ছিন্ন করে জেগে উঠবে স্বাধীন ভিয়েত্নাম, তারই ভাবনায় ব্যাকুল হয়ে থাকে সমস্ত মন।
সেই সময় পরিচয় হল কয়েকজন ফরাসী সমাজতান্ত্রিক নেতার সাথে। ফ্রান্সে তাঁরা সদ্য গড়ে তুলেছিলেন সমাজতান্ত্রিক দল। ইতিমধ্যেই মাকর্সবাদের সাথে পরিচয় ঘটেছিল হো চি মিনের। মার্কসবাদের মহান আদর্শ তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। ফরাসী সমাজতান্ত্রিক নেতাদের সাথে পরিচিত হয়ে আরো গভীরভাবে পড়াশুনা করতে আরম্ভ করলেন। তাঁদের সকলেরই লক্ষ্য ছিল পৃথিবীর প্রতিটি দেশ থেকে উপনিবেশবাদ শোষণ বঞ্চনা দূর করা। মানুষে মানুষে সাম্য মৈত্রী গড়ে তোলা।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে তখন আরো কয়েকজন বিপ্লবী নতা এসে আশ্রয় নিয়েছিল প্যারিসে। তাদের সাথে যোগযোগ গড়ে তুললেন হো। ১৯২০ সাল প্যারিসে ফরাসী সোসালিস্ট পার্টির অধিবেশন বসল। এই অধিবেশনে যোগ দিতে এলেন দেশ-বিদেশ থেকে অনেক প্রতিনিধি। হো যোগ দিলেন ভিয়েনামের প্রতিনিধি হিসাবে। তখন তিনি ত্রিশ বছরের এক যুবক।
এই টাওয়ার্স কংগ্রেসে তিনি দিলেন তার ঐতিহাসিক বক্তৃতা। এই প্রথম কেউ বিশ্বের প্রতিনিধিদের সামনে তুলে ধরলেন ভিয়েত্নামের উপর শোষণ আর অত্যাচার করে চলেছে। যারা সামান্যতম প্রতিবাদ করছে তাদের উপর চালানো হচ্ছে অকথ্য নির্যাতন। ফরাসী সৈনিক রাজপুরুষদের লালসার বলি হচ্ছে সাধারণ ভিয়েনামী নারীরা। হাজার হাজার তরুণ যুবক কারাগারের অন্ধ কুঠুরির মধ্যে শেষ করছে তাদের জীবন। দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের শ্রমে গড়ে তোলা সম্পদে ধনী হচ্ছে সামান্য কিছু মানুষ আর দেশের মানুষ অনাহারে অশিক্ষায় চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পশুর মত জীবন যাপন করছে।
হোর উদাত্ত কণ্ঠের জ্বালাময়ী বক্তৃতায় স্তম্ভিত হয়ে গেল দেশে-বিদেশের প্রতিনিধিরা। হো শুধু তাদের কাছে দেশের সমস্যার কথা বললেন না। সকলের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেন যাতে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে পারে ভিয়েত্নাম।
তখন রাশিয়া সবেমাত্র সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠালাভ করছে। অন্য দেশে আন্তর্জার্তিক কমিউনিস্ট সংগঠনের শক্তি সীমাবদ্ধ। প্রত্যক্ষ সাহায্য না পেলেও নানা বিষয়ে পরামর্শ পেলেন। তিনি উপলব্ধি করলেন বাইরের কোন শক্তির সাহায্যে নয়, নিজের দেশের মানুষের সম্মিলিত ঐক্য আর সংগঠনের মাধ্যমেই গড়ে তুলতে হবে বিপ্লব। আর জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন একটি রাজনৈতিক দলের। যে সমস্ত ভিয়েত্রমী রাজনৈতিক কর্মী গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে এসেছিল প্যারিসে, তাদের সাথে প্রতিষ্ঠা করলেন ভিয়েত্নাম কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯২০ সালে প্রবাসে সামান্য কয়েকজনের মিলিত চেষ্টায় যে পার্টির জন্ম হয়েছিল, উত্তরকালে তাই মহীরুহ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র ভিয়েম।
প্যারিসে থাকার সময় প্রথম পরিচিত হলেন লেনিনের রচনাবলীর সাথে। তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ, চিন্তাধারা বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার ক্রিয়াকৌশল থেকে অনুভব করলেন লেনিনের পথই প্রকৃত বিপ্লবের পথ-এই পথেই তাঁকে অগ্রসর হতে হবে। গভীর অধ্যয়নের সাথে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। এতে একদিকে যেমন কিছু অর্থ উপার্জন হয় অন্যদিকে তেমনি ভিয়েনামের প্রকৃত চিত্রকে তুলে ধরতেন ফরাসী জনগণের কাছে।
দীর্ঘ পাঁচ বছর প্যারিসে কাটাবার পর তিনি রওনা হলেন মস্কোতে। বিপ্লব-উত্তর মস্কোর জনজাগরণ দেখে মুগ্ধ হলেন। এক বছর মস্কোতে ছিলেন তিনি। এই এক বছর তিনি শুধু রুশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন না, তাঁদের কাছ থেকে সংগ্রহ করলেন রুশ বিপ্লবের পুঙ্খানুপুঙ্খ ইতিহাস। এখানে থাকাকালীন সময়ে প্রভা পত্রিকায় বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ রচনা করেন।
ভিয়েত্নামে প্রত্যাবর্তন করা বিপজ্জনক বিবেচনা করে ১৯২৫ সালে এসে পৌঁছলেন চীনের ক্যান্টন শহরে। এই সময় চীন সরকার কমিউনিস্টদের প্রতি যথেষ্ট উদার আর সহৃদয় মনোভাবাপন্ন ছিলেন।
ভিয়েনামে তখন গড়ে উঠেছিল একাধিক বিপ্লবী সংগঠন। প্রায় প্রতিটি সংগঠনই ছিল নিষিদ্ধ। এদের বেশিরভাগ সদস্যকেই বন্দী করা হয়েছিল। যারা পুলিশের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল তাদের অধিকাংশই ক্যান্টনে পালিয়ে গিয়ে আত্মগোপন করল। এদের মধ্যে ফাঁই বই চাও সবচেয়ে বড় দল গঠন করেছিলেন। হাজার হাজার তরুণ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেবার জন্য এই দলে নাম লিখিয়েছিলেন। এই উদ্যমী তরুণ সম্প্রদায়কে নেতৃত্ব দেবার মত সাংগঠনিক দক্ষতা বা ব্যক্তিত্ব ছিল না ফাই বই চাও-এর। তাছাড়া দলের সুনির্দিষ্ট কোন কর্মসূচি ছিল না…অল্পদিনের মধ্যেই দলের অধিকাংশ সদস্যই নেতৃত্বের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল।
হো ক্যান্টন এসে প্রথমেই সব রাজনৈতিক দল, তাদের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। লক্ষ্য করলেন, তাদের মতাদর্শগত বিভেদ। তিনি সকলকে বিভেদ ভুলে এক ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ হবার আহ্বান জানালেন। ফাঁই বই চাও-এর দলের সদস্যরা দলে দলে এসে যোগ দিল তার সাথে। এই সমস্ত তরুণ বিপ্লবীদের নিয়ে হো চি মিন গড়ে তুললেন ‘ভিয়েম বিপ্লবী তরুণ সংঘ’। এই দলই পরবর্তীকালে হয়ে ওঠে ভিয়েনামের প্রধান রাজনৈতিক দল ‘থান নিয়েন’। হে হলেন দলের সভাপতি। ক্যান্টনে খোলা হল দলের প্রধান কার্যালয়। স্থির হল এখান থেকেই পরিচালিত হবে বিপ্লবী কার্যকলাপ।
সেই সময়ে চীনের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন চিয়াং কাইশেক। তিনি ছিলেন আজন্ম কমিউনিস্ট বিদ্বেষী। শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তাদের সাথে সম্পর্ক রেখেছিলেন। রাষ্ট্রক্ষমতা পুরোপুরিভাবে অধিকার করতেই চিয়াং কাইশেক অনুভব করলেন কমিউনিস্টদের নির্মূল করা প্রয়োজন না হলে উত্তরকালে তারাই তাঁর পক্ষে সবচেয়ে বিপদের কারণ হয়ে উঠবে। তাছাড়া রুশ বিপ্লবের পর পৃথিবীর সব দেশের শাসক সম্প্রদায় কমিউনিস্টদের সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে আরম্ভ করেছিল। চীন দেশেও কমিউনিস্টদের আন্দোলন ক্রমশই বেড়ে চলছিল। ১৯২৭ সালে চিয়াং কাইশেক কমিউনিস্ট দলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। শুরু হল তাদের উপর অত্যাচার আর নিপীড়ন। হাজার হাজার কমিউনিস্ট সমর্থককে বন্দী করা হল।
প্রথমে কিছুদিন আত্মগোপন করে রইলেন হো। শেষে বুঝতে পারলেন এভাবে বেশিদিন থাকা সম্ভব নয়। পালিয়ে গেলেন মস্কোতে। উদ্দেশ্য ছিল ভিয়েনামের বিপ্লবী আন্দোলনে রাশিয়ার সাহায্য, সমর্থন লাভ করা। অল্প কিছুদিন মস্কোতে থাকার পর নানান দেশ ঘুরে এলেন শ্যাম দেশে। সর্বত্রই কমিউনিস্ট বিরোধী মনোভাব। হো স্থির করলেন এখান থেকেই দলের কার্যকলাপ পরিচালনা করবেন। তিনি এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশ ধারণ করলেন। শ্যাম দেশে তখন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের সংখ্যা ছিল প্রচুর। তাদের ভিড়ে সহজেই মিশে গেলেন হো। সেখান থেকেই দলের কর্মীদের উদ্দেশ্যে নিয়মিত নির্দেশ পাঠাতেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে তুললেন ছোট ছোট সংগঠন।
১৯২৮ সালে ফরাসী শাসকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হল। এই ধর্মঘটে যোগ দিল দেশের প্রায় প্রতিটি কলকারখানা শ্রমিক, রিক্সাচালক, রেলকর্মচারীরা। বন্ধ হল উৎপাদন, বিচ্ছিন্ন হল যোগাযোগ ব্যবস্থা। ভিয়েনামের ইতিহাসে সেই প্রথম সর্বাত্মক ধর্মঘট। সরকারী কর্তৃপক্ষের অমানবিক অত্যাচারে ধর্মঘট ভেঙে গেলেও দেশের মানুষ উপলব্ধি করতে পারল দেশের মানুষে সম্মিলিত শক্তি।
ভিয়েনামের বুকে ক্রমশই কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রসার ঘটছিল। তাদের সমূলে উপাটিত করবার জন্য বহু নেতৃস্থানীয় বিপ্লবীকে হত্যা করল ফরাসী শাসকরা। হো চি মিন তখন ছিলেন হংকং-এ। তার অবর্তমানেই তাঁর বিচার হল বিচারে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল। হংকং কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানান হল তাঁকে বন্দী করে ফরাসী কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিতে।
এই সংবাদ পেলে গোপনে হংকং ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। কিন্তু দেশত্যাগের আগেই পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন। তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হল কারাগারে। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন হো। তাকে পাঠানো হল হাসপাতালে। এই সময় চারদিকে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল জেলের মধ্যেই অসুস্থ অবস্থায় হো মারা গিয়েছেন। প্রিয় নেতার এই অকাল মৃত্যুর সংবাদে সমস্ত দেশ শোকে বিহ্বল হয়ে পড়ল।
হো অসুস্থ অবস্থাতেই জেল হাসপাতাল থেকে পালিয়ে সম্পূর্ণ গোপনে গিয়ে পৌঁছলেন মস্কোতে। এখান থেকেই দলের নেতাদের কাছে সংবাদ পাঠালেন। ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৮ এই চার বছর তিনি মস্কোতে ছিলেন। এখানে তিনি গভীরভাবে পড়াশুনা করেছেন মার্কসবাদ, সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি, বিজ্ঞান। তারই সাথে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন কমিউনিস্ট সংগঠনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন, দেশের বিপ্লবীদের সাথে নিয়মিতভাবে সংবাদ আদায়-প্রদান করেছেন।
ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে ভিয়েত্রাম কমিউনিস্ট পার্টি। দেশে ফিরে আসবার জন্য সমস্ত মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল হোর। হঠাৎ সে সুযোগ এসে গেল। জাপান চীন আক্রমণ করল। চীনে তখন কমিউনিস্ট পার্টি এক বিরাট শক্তিতে পরিণত হয়েছে। চিয়াং কাইশেক অনুভব করলেন তাঁর একার শক্তিতে জাপানী আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব নয়। তাই কমিউনিস্টদের সাথে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন। তাদের উপর থেকে তুলে নেওয়া হল সব বিধিনিষেধ। নতুন গেরিলা বাহিনী তৈরি করার জন্য কুয়োমিংটং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কাছে কয়েকজন শিক্ষক চাওয়া হল।
হো এই সংবাদ পেয়ে মস্কো থেকে ফিরে এলেন চীনে। যোগ দিলেন গেরিলা বাহিনীতে। এখানেই দেখা হল ফান ভান ডং এবং নুয়েন গিয়াপের সাথে। ফান সুদীর্ঘ কাল বিপ্লবী কার্যকলাপের সাথে যুক্ত ছিলেন। ছিলেন ইতিহাসের শিক্ষক। হোর অবর্তমানে তাঁরাই দলকে সংগঠিত করেছিলেন, পরিচালনা করেছিলেন। বিপ্লবী কাজকর্ম ছড়িয়ে দিয়েছিলেন দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।
ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। জার্মানি বাহিনী একের পর একদেশ অধিকার করতে থাকে। ফরাসীরা ছিল মিত্রপক্ষে। যুদ্ধে পরাজিত হল ফ্রান্স। ফ্রান্সের এই পরাজয়ে উল্লসিত হয়ে উঠলেন হো…তিনি উপলব্ধি করলেন আঘাত হানার এই উপযুক্ত সময়। তাছাড়া দেশের মানুষও বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত। সঙ্গীদের সালে পরামর্শ করে ১৯৪১ সালে দেশের ফিরে এলেন হো। তার মাথার উপর ঝুলছে মৃত্যুদণ্ডের পরোয়ানা, তাই ছদ্মনামে ছদ্মবেশে এক চাষীর বাড়িতে এসে আশ্রয় নিলেন। তার কয়েক মাস পরেই ১৯৪১ সালের মে মাসে ইন্দোচীন কমিউনিস্ট পার্টির অষ্টম প্লেনাম ডাকা হল।
শহর থেকে বহুদূরে এক নির্জন নদীর ছোট একটা কুটিরে বসল পার্টির অধিবেশন। পাছে ফরাসী কর্তৃপক্ষ কিছু জানতে পারে তাই প্রতিনিধিরা প্রায় সকলেই ছদ্মবেশে সেখানে এসে পৌঁছলেন। এই কুঁড়েঘরেই সর্বসম্মতভাবে স্থির হল নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা করা হবে। রাষ্ট্রের নাম দেওয়া হল ভিয়েত্ৰাম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। ১৯৪১ সালের ৬ই জুন চীনের এক বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হল নতুন রাষ্ট্রের জন্মের কথা। ডাক দেওয়া হল সর্বাত্মক বিপ্লবের।
এতদিন হো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ছদ্মনামে নিজের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর প্রকৃত নাম ঢাকা পড়ে গিয়েছিল ছদ্মনামের আড়ালে। এইবার তিনি নতুন নাম নিলেন হো চি মিন যার অর্থ যিনি আলোকিত করেন। তিনি যথার্থই ভিয়েত্নামের আলোর দিশারী। তাই এই নামেই জগত্বরেণ্য হয়ে আছেন।
কিন্তু আকস্মিকভাবে হোর জীবনে নেমে এল বিপর্যয়। চিয়াং কাইশকের হাতে বন্দী হলেন তিনি। এইবারও ঘোষণা করা হল তাঁর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তিনি জেলে ছিলেন, জেলে তার উপর অকথ্য অত্যাচার করা হয়। কিন্তু অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে ভরপুর হো সব অত্যাচার নিপীড়ন সহ্য করেও প্রাণে বেঁচে গেলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁকে মুক্তি দেওয়া হল।
ইতিমধ্যে গিয়াপ পার্টির সংগঠনকে মজবুত করেছেন, তৈরি করেছেন ভিয়েত্রম গেরিলা বাহিনী। দলে দলে যুবকরা যোগ দেয় এই বাহিনীতে। নির্জন পার্বত্য প্রদেশে তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। শিক্ষা সমাপ্ত হতেই গেরিলা বাহিনী ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ফরাসী বাহিনীর উপর।
অন্যদিকে জাপানের সৈন্যবাহিনী ভিয়েত্রাম আক্রমণ করে। জাপানী সৈন্যের হাতেও মারা পড়ল বহু ফরাসী সৈন্য। গিয়াপ ও চু মান তার বিপ্লবী সেনাবাহিনীর সাহায্যে অধিকার করলেন সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল।
ফরাসীরা উপলব্ধি করল তাদের শাসনের দিন শেষ হয়েছে। ভিয়েত্রামী জনগণের হাতে ক্ষমতা তুলে দেবার পরিবর্তে তারা ম্রাট বাওদাই-এর হাতে তুলে দিল দেশের শাসন। সম্রাট বাওদাই ছিলেন এক অপদার্থ শাসক যিনি ফসারীদের অনুগ্রহে এতদিন। ভোগবিলাসে মত্ত ছিলেন।
এর বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ল সমস্ত ভিয়েত্রামী জনগণ। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার দায়িত্ব ভার ভিয়েনাম মুক্তি কমিটির হাতে। এই কমিটির প্রধান ছিলেন হো। তিনি ডাক দিলেন গণ অভ্যুত্থানের। দিনটি ছিল ২০শে আগস্ট ১৯৪৫।
যে ভিয়েত্নামীরা যুগ যুগ ধরে লাঞ্ছিত হয়েছে, অত্যাচারিত হয়েছে, নির্যাতন সহ্য করেছে ফরাসীদের হাতে, তাদের বুকে জ্বলে উঠল প্রতিশোধের আগুন। হাজার হাজার ফরাসী মারা পড়ল ভিয়েত্রমীদের হাতে।
স্বদেশবাসীর উপর এই অত্যাচার দেখে সসৈন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল ফরাসী বাহিনী। তাদের সাহায্যে সেই সাথে কমিউনিস্টদের নিশ্চিহ্ন করতে এগিয়ে এল ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। শুরু হল ভিয়োমী মুক্তি বাহিনীর সাথে সম্মিলিত বাহিনীর মরণপণ সংগ্রাম।
হো ছিলেন সমস্ত বিপ্লবীদের কাছে এক জীবন্ত প্রেরণা। তিনি নিজে গেরিলা যোদ্ধাদের মধ্যে ঘুরে বেড়াতেন। দিনের পর দিন রাতের পর রাত তাদের সাথে কাটিয়েছেন পাহাড়ে জঙ্গলে, খোলা আকাশের নিচে। একই খাবার ভাগাভাগি করে খেয়েছেন যখন বিপ্লবী বাহিনী জয়ী হয়েছে, তিনি তাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। যখন তারা পরাজিত হয়েছে, হতদ্যম হয়ে পড়েছে, তাদের উৎসাহ দিয়েছেন, অনুপ্রাণিত করেছেন।
ফরাসী আর ইংরেজ সেনাদের প্রবল অত্যাচারের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও ভেঙে পড়েনি ভিয়েনামবাসীরা। কখনো আড়াল থেকে দেশবাসীকে শক্তি, প্রেরণা দিয়েছেন হো। দীর্ঘ চার বছর রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চলবার পর ভিয়েত্সামের সাহায্যে এগিয়ে এল চীন, রাশিয়া, ফরাসীরা বুঝতে পেরেছিল তাদের একার শক্তিতে আর ভিয়েনামীদের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এল আমেরিকা। তবুও তাদের পরাজয় বরণ করতে হল। দিয়েন বিয়েন ফুতে রচিত হল ফরাসীদের শেষশয্যা। শেষ হল ভিয়েত্রামে ৮০ বছরের ফরাসী শাসন। এবার এগিয়ে এল আমেরিকা।
১৯৫৬ সালের ৮ই মে জেনেভায় বসল আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলন। পশ্চিমি দেশগুলো শান্তির শর্ত হিসাবে ভিয়েৎনামকে বিভক্ত করতে চাইল। যুদ্ধক্লান্ত ক্ষতবিক্ষত ভিয়েজ্ঞামের মানুষের কথা চিন্তা করে এই প্রস্তাব মেনে নিলেন হো। যদিও তিনি অন্তর থেকে চেয়েছিলেন ভিয়েত্সাম এক ও অবিভক্ত থাকুক।
উত্তরের রাষ্ট্রপ্রধান হলেন হো চি মিন। আর দক্ষিণের রাষ্ট্রপ্রধান হলেন নো দিন জিয়েস। মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডি তাঁকে এই আসনে বসিয়েছিলেন পুতুল সরকার হিসাবে দেশ শাসন করবার জন্য।
স্থির হয়েছিল সেই বছরই দেশের দুই অংশে নির্বাচন হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পেরেছিল এই নির্বাচন হলে হো হবেন সমগ্র ভিয়েনামের রাষ্ট্রপ্রধান। তাই আমেরিকার প্ররোচনায় নির্বাচন করা সম্ভব হল না।
হো ছিল ছিলেন অত্যাচারী শাসক। অল্পদিনেই তাঁর শোষণ অত্যাচারে সমস্ত দক্ষিণের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ল। দাবি উঠল অখণ্ড ভিয়েনামের। তাদের সাহায্যে এবার এগিয়ে এল উত্তরের মানুষ। হো সমর্থন জানালেন দক্ষিণের মানুষের গণ আন্দোলনকে।
হো সে দিন সরকার বিপদ আসন্ন বুঝতে পেরে এবার সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমেরিকা। শুরু হল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এক নারকীয় অত্যাচার। একদিকে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দেশ আমেরিকা, অন্যদিকে এক ক্ষুদ্র সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশ ভিয়েৎনাম।
সেই অজেয় শক্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়েও সামান্যতম বিচলিত হয়নি ভিয়েত্রামের সাধারণ মানুষ কারণ তাহাদের সাথে ছিলেন তাদের প্রিয় নেতা হো চি মিন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েত্নামের বুকে যে পরিমাণ নাপাম বোমা ফেলেছিল পৃথিবীর ইতিহাসে তা বিরল। ভিয়েত্রামের মানুষ, হোর নেতৃত্ব সেদিন প্রমাণ করেছিল কোন অস্ত্র দিয়েই মানুষের অদম্য মনোবলকে ধ্বংস করা যায় না। হো দেশের মানুষকে ডাক দিয়ে বলেছিলেন, তোমরা ইস্পাতের মত কঠিন, বজ্রের মত মহাতেজী হও।
১৯৬৯ সালের ১০ই মে অসুস্থ হয়ে পড়লেন হো। বুঝতে পারলেন তাঁর মৃত্যু আসন্ন। তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে তার শেষ বার্তা রচনা করলেন। যখন আমার জীবনের শেষ ক্ষণ আসবে তখন আমার সমস্ত মন ভারাক্রান্ত হবে আরো দীর্ঘদিন তোমাদের সেবা করতে পারলাম না বলে। আমার মৃত্যুর পর কোন শোক অনুষ্ঠান করে যেন জনগনের অর্থ আর সময়ের অর্থ আর সময়ের অপচয় না করা হয় সবশেষে আমি রেখে গেলাম পার্টির সকল সদস্য, সেনাবহিনী আর প্রতিটি স্বদেশবাসীর জন্য আমার গভীর ভালবাসা।” এর পরেই তাঁর মৃত্যু হয়।
তাঁর মৃত্যুতে ভিয়েত্রামের মানুষের সংগ্রাম শেষ হয়নি। তাঁর স্বদেশপ্রেম আর আত্মিক শক্তির অনুপ্রেরণাতেই উজ্জীবিত হয়ে একদিন তারা আমেরিকাকে বিতাড়ন করে নতুন স্বাধীনতা পতাকাকে উড্ডীন করেছিল।
হো চিন মিন আর নেই। কিন্তু তার অস্তিত্ব শুধু ভিয়েত্রাম নয়, পৃথিবীর সমস্ত সগ্রামী মানুষের মধ্যে আজও চির বিরাজমান।
তথ্যসূত্রঃ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী – মাইকেল এইচ. হার্ট / সম্পাদনায় – রামশংকর দেবনাথ