জন মিলটন (John Milton)
প্রথম পাতা » জীবনী » জন মিলটন (John Milton)জন মিলটন
(১৬০৮–১৬৭৪)
“একজন মহৎ কবি হবার জন্যে অবশ্যই তোমাকে একজন মহৎ মানুষ হতে হবে।” সমালোচক টেনির এই উক্তি সম্ভবত একটি মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তিনি ইংল্যান্ডের কবি জন মিলটন। মিলটনের জন্ম ৯ই ডিসেম্বর ১৬০৮ সাল, লন্ডনের ব্রড স্ট্রীটের একটি বাড়িতে। বাড়ির পাশেই ছিল সেন্ট পল ক্যাথিড্রাল গীর্জা। গীর্জার ঘণ্টাধ্বনির ছন্দ শুনতে শুনতে জন্মমুহূর্ত থেকেই মিলটনের মনে জেগে উঠেছিল কবিতার ছন্দ। মিলটনের যখন জন্ম হয়, সমগ্র লন্ডন তখন শেক্সপীয়রের সৃষ্টির বর্ণচ্ছটায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। শোনা যায় মিলটনের সাথে একবার শেক্সপীয়রের সাক্ষাৎ হয় তখন মিলটন সাত বছরের বালক, শেক্সপীয়র পঞ্চাশ বছরের প্রৌঢ়।
পিতা-মাতার ছয় সন্তানের মধ্যে মিলটন ছিলেন তৃতীয়। বাড়ির পরিবেশ ছিল মুক্ত স্বাধীন। শিক্ষা ও সঙ্গীতের একটা পরিমণ্ডল গড়ে উঠছিল বাড়িতে। তিনি লিখেছিলেন– ছেলেবেলা থেকেই আমার বাবা আমাকে সাহিত্যের প্রতি অনুসন্ধিৎসু করে তোলেন।
শৈশবে তাকে লন্ডনের বিখ্যাত সেন্ট পলস্ স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হল। স্কুলের চেয়ে বাড়ির পরিবেশ ছিল শিক্ষার অনুকূল।
ষোল বছর বয়েসে ক্রেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হলেন। সেখানকার পরিবেশ তার মনোমত ছিল না। একবার তার কোন এক শিক্ষকের সাথে অকারণ বির্তকে জড়িয়ে পড়ে হাতাহাতি করবার অভিযোগ সাময়িকভাবে কলেজ থেকে বিতাড়িত হলেন।
কিছুদিন পর আবার কলেজে ভর্তি হলেন। তার সৌন্দর্য, আচার ব্যবহার, মধুর কথাবার্তার জন্যে সকলেই ভালবাসত। সমস্ত কলেজে মিলটনের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল কেমব্রিজের নারী “The Cambridge Lady”। শিক্ষক ছাত্ররা তাঁর অভিমতকে সমর্থন না করলেও তার চরিত্রের সততার জন্য শ্রদ্ধা করত।
চব্বিশ বছর বয়েসে কেমব্রিজ থেকে পাশ করে বার হলেন। তিনি শুধু সাহিত্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি পেলেন না, আটটি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করলেন।
তাঁর পিতার ইচ্ছা ছিল মিলটন সাহিত্য সৃষ্টির সাথেই যাজকের জীবন বেছে নেবেন। কিন্তু আজন্ম বিদ্রোহী মিলটন কোনদিনই চার্চকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেননি।
তিনি লন্ডনের সতেরো মাইল দূরে হর্টন গ্রামে গেলেন। সেখানে তাঁর বাবার একটি বাড়ি ছিল। সেই বাড়িতেই তাঁর মা থাকতেনই এখানে পাঁচ বছর ধরে চলল সাহিত্য, দর্শন, ভাষাতত্ত্ব, সঙ্গীত প্রতিটি বিষয়েই গভীর অধ্যয়ন।
মিলটন লিখেছেন এই পাঁচ বছর আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের সময়। বাবার কারবার আমাকে সমস্ত আর্থিক দুঃচিন্তা থেকে মুক্ত রেখেছিল।
পাঁচ বছরের অজ্ঞাতবাস শেষ করে তিনি স্থির করলেন, মানুষের সমাজে ফিরে যাবেন। নাইটঙ্গেলের গান, মুক্ত প্রকৃতি ছাড়াও নিজেকে প্রস্তুত করে তুলতে গেলে মানুষের সান্নিধ্য প্রয়োজন। তিনি লন্ডনে ফিরে এলেন। পরিচয় হল কিছু জ্ঞানী মানুষের সাথে। কয়েকজনের সাথে গড়ে উঠল অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব।
১৬৩৭ সালে মিলটনের মা মারা গেলেন। মায়ের মৃত্যুতে মানসিক দিক থেকে বিপর্যন্ত হয়ে পড়লেন মিলটন।
মিলটনের বাবা ছেলের মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে তাকে ইতালি যাওয়ার অনুমতি দিলেন। এখানে এসে পেলেন এক নতুন জীবন। একের পর এক ইতালির বিভিন্ন শহর ঘরতে থাকেন। পরিচয় হল সে দেশের বহু জ্ঞানী-গুণী মানুষের সাথে। দেখা হল গ্যালিলিওর সাথে। গ্যালিলিও তখন বৃদ্ধ, দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। এখানে কয়েকজন বিখ্যাত সঙ্গীতকারের সান্নিধ্য পেলেন। ইতালির তৎকালীন সাহিত্য, শিল্পকলার চেয়ে সঙ্গীত তাঁকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল।
ইতালির কিছু কবি সমালোচক তার ল্যাটিন ভাষায় লেখা কবিতা পড়ে মুগ্ধ হলেন। তাদের আন্তরিকতায় মনে হল ঘরের ছেলে যেন ঘরে ফিরে এসেছে।
ইংল্যান্ড থেকে সংবাদ এল দেশে যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তাঁর দেশভ্রমণের ইচ্চা স্থগিত রাখলেন। তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে এলেন।
ইতালি থেকে প্রত্যাবর্তন করবার আগে মিলটন ভেবেছিলেন তিনি এক অসামান্য কাব্য রচনা করবেন, কিন্তু ইংল্যান্ডে ফিরে আসবার পরেই তার মধ্যে জেগে উঠল বিদ্রোহী সত্তা–”এবার আর কাব্য নয়, এখন প্রয়োজন গদ্যের।”
লন্ডনে এসে পাকাপাকিভাবে ঘর বাধলেন মিলটন। নিজেকে ঘোষণা করলেন এই যুদ্ধের সৈনিক হিসাবে। তবে তার অস্ত্র বন্দুক নয়, কলম।
মিলটন ধর্মীয় বিবাদ-বিসংবাদকে অপছন্দ করতেন কিন্তু মানুষের এই বিবাদকে অস্বীকার করলেন না। “অন্য মানুষের ঘামঝরানো পরিশ্রমে আমি আরাম আনন্দ ভোগ করতে চাই না। যারা তা ভোগ করে আমি তাদের ঘৃণা করি।”
মিলটনের অন্তরের ক্ষোভ ফেটে পড়ল তাঁর লেখায়। প্রথম আঘাত হানলেন খ্রিস্টান যাজক ধর্মপ্রচারকদের বিরুদ্ধে। যারা ধর্মের নামে চার্চের পবিত্র পরিমণ্ডলকে দূষিত করে তুলেছে। যারা হিংস্র নেকড়ের মত অন্যকে সেবা করবার পরিবর্তে নিজেরাই অন্যের সেবায় পরিপুষ্ট হচ্ছে।
শুধু ধর্ম নয় আরো অনেকের বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষুরধার কলম গর্জে উঠল। সমাজের শাসক শ্রেণীর দুর্নীতি, তাদের ব্যভিচার, শাসনের নামে শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র কষাঘাত করলেন। মিলটন জানতেন তার এই লেখার পরিণতি কি ভয়ঙ্কর হতে পারে। শুধু কারাদণ্ড নয়, মৃত্যু অবধি হতে পারে তাঁর। তবুও সামান্যতম ভীত হলেন না।
১৬৪৪ সালে ২৪ শে আগস্ট রাজার নির্দেশে নতুন আইন প্রস্তুত করে বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক সমস্ত বিষয়ে লেখার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হল।
এই আদেশের বিরুদ্ধে মিলটনের সমস্ত ক্ষোভ যেন বিস্ফোরণের মত ফেটে পড়ল। প্রকাশিত হর মুদ্রণ ও স্বাধীনতার সপক্ষে লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ Areopagitica।
মিলটনের Areopagitica শুধু ইংল্যান্ডের নয়, সমগ্র বিশ্বের মানুষের বাক স্বাধীনতা, মুদ্রণ স্বাধীনতা, সংগ্রামের এক জীবন্ত দলিল।
পঁয়ত্রিশ বছর বয়েসে মিলটন বিয়ে করলেন মেরি পাওয়েলকে। মেরির বয়স তখন সতেরো। এই বিবাহ সুখের হয়নি। কারণ দুজনে ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন মানসিকতার মানুষ। বিবাহের পর এক মাস মেরি নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল তারপরই স্বামীর বিরুদ্ধে তার সব ক্ষোভ ফেটে পড়ল। স্বামীর ঘর ছেড়ে বাবার ঘরে গিয়ে উঠল।
এই সময়ে লিখলেন তার বিখ্যাত ইস্তাহার The Doctrine and Discipline of Divorce to the good of both sex. বিবাহ বিচ্ছেদের সপক্ষে এতে তিনি জোরালো যুক্তি দেখালেন। সংসারের সুখের জন্য বিবাহ বিচ্ছেদের প্রয়োজন আছে।
মুহূর্তে নিজের ভুলে বুঝতে পারে মেরি।
মেরি ফিরে এল মিলটনের কাছে। সঙ্গে নিয়ে এল তার দশ ভাইবোন আর বাবা মাকে। সেই দিন থেকে মিলটনের জীবনের সব সুখ নষ্ট হয়ে গেল।
দেশে গৃহযুদ্ধ চলছে। একদিকে ক্রমওয়েলের নেতৃত্বে পার্লামেন্টের বাহিনী, অন্যদিক চার্লসের সেনাদল। দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। মিলটনের বাবার কাজকর্মে মন্দা দেখা দিয়েছে। তিনিও ছেলের কাছে চলে এলেন। বাধ্য হয়ে সংসার খরচ মেটাবার জন্য বাড়িতে স্কুল খুললেন। কিছু ছাত্রও জুটে গেল। সেই অর্থে অথি কষ্টে সংসার চালান মিলটন।
অবশেষে ১৬৪৬ সালে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটল। রাজার বাহিনী সম্পূর্ণ পরাজিত হল। রাজা প্রথম চার্লসকে হত্যা করা হল। ইংল্যান্ডের শাসনভার গ্রহণ করলেন অলিভার ক্রমওয়েল।
এই বছরই মিলটনের কবিতার প্রথম বই প্রকাশিত হল।
মিলটনের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমশই খারাপ হতে থাকে। এক সন্তানের পিতা হয়েছেন তিনি। স্থান সংকুলানের জন্য পুরনো বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়িতে এসেছেন।
এই দূরবস্থার সময় কয়েকজন বন্ধুর সহায়তায় তিনি বৈদেশিক দপ্তরে ল্যাটিন সেক্রেটারির পদ পেলেন (১৬৪৯)। তার পদটি ছিল সাধারণ করণিকের।
ক্রমশই তাঁর কাজের চাপ বাড়ছিল। অত্যধিক কাজের চাপে মাঝে মাঝেই চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছিল। ডাক্তাররা তাকে সাবধান করে দিত। এই ভাবে কাজ চালিয়ে গেলে তিনি অন্ধ হয়ে যাবেন।
এই সময় মিলটনের জীবনে ঘটল এক বিপর্যয়। স্ত্রী মেরি সন্তান জন্মের সময় মারা গেল। তখন তার বয়েসে মাত্র ছাব্বিশ।
চোখের অন্ধকারের সাথে সংসারেও নেমে এল অন্ধকার। এই বিপর্যয়ের মধ্যেও মানসিক শক্তি হারানানি মিলটন। তিনি লিখেছেন, “যদি আমার এই ব্যাধি দূরারোগ্য হয় তবে আমি তার সাথে মানিয়ে নেব। তাছাড়া এর জন্যে আমার কোন দুঃখ নেই। দেশের সেবার জন্যই আমি চোখের আলো হারিয়েছি।”
১৬৬০ সালে ক্রমওয়েল মারা গেলেন। প্রথম চার্লসের পুত্র ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে ক্ষমতা দখল করলেন। দেশে নতুন করে দেখা গেল স্বৈরতন্ত্র।
মিলটন বুঝতে পারলেন তাকেও যে কোন মুহূর্তে বন্দী করা হবে। বাচবার জন্যে এক বন্ধুর বাড়িতে গোপনে আশ্রয় নিলেন।
নতুন রাজার অনুগত লোকেরা মিলটনের সমস্ত লেখ প্রকাশ্য রাজপথে পোড়াতে আরম্ভ করল। তার বাড়িঘর লুটপাট করল। তার গোপন আস্তানাও খুঁজে বার করল তারা। বন্দী হলেন মিলটন।
বন্ধুরা সরাসরি আবেদন করল রাজার কাছে। একজন অন্ধ মানুষের প্রতি করুণাবশতই তিনি তাকে মুক্তি দিলেন।
গৃহে ফিরে এলেন মিলটন। কিন্তু ক্রমশই তাঁর মনে হতে থাকে তার এই ঘর যেন আরেক বন্দীশালা। এখানে কেউ তাঁকে চায় না। কোন সঙ্গী নেই তার। মেরি মারা যাবার পর তিনি বিয়ে করেছিলেন কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দ্বিতীয় স্ত্রী মারা গেলেন। নিঃসঙ্গতা ভুলতে স্থির করলেন আবার বিয়ে করবেন, এবার ঘর থেকেই প্রতিবাদ উঠল। এক মেয়ে বলল, বাবার বিয়ের খবরে আমার কিছু এসে যাবে না কিন্তু তার মরার খবর শুনলে খুশি হব।
মর্মাহত হলেন মিলটন। ঘরের মানুষেরা তাঁর পর হয়ে গিয়েছে। লন্ডন ছেড়ে বাসা বাঁধলেন এক নির্জন গ্রামে। সাথী তার বড়ো মেয়ে।
বাইরের জগৎ থেকে একটু একটু করে নিজেকে গুটিয়ে আনলেন মিলটন। তার অন্তরের অনুভুতির আলোয় লিখলেন এক অবিস্মরণীয় কবিতা “On his blindness”।
আত্মমগ্নতার গভীরে যতই ডুব দিচ্ছিলেন মিলটন ততই অন্তরে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছিল এক নতুন জগৎ, যেখানে চারপাশের জগতের কেউ নেই, আছেন ঈশ্বর, শয়তান, পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদম আর ইভ।
শুরু হল তার অমর কাব্য প্যারাডাইস লস্ট (Paradise Lost)। তিনি মুখে মুখে বলে যেতেন, তার মেয়ে শুনে শুনে তাই লিখত। এই সময় তিনি যেন হারিয়ে যেতেন তার কাব্যের জগতে।
প্যারাডাইস লস্ট কাব্যের মধ্যে কবি তার সীমাহীন কল্পনায় পাখা মেলে দিয়েছেন স্বর্গ মর্ত্য পাতালে। এই কাব্যের লুসিফার (শয়তান) ও মানুষের পতনের কাব্য, শয়তান ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। দাসত্বের জীবনকে সে মেনে নিতে চায় না। চিরবিদ্রোহী মিলটনের প্রচ্ছন্ন সহানুভূতি ফুটে উঠেছে শয়তানের প্রতি। স্বর্গে দাসত্ব করবার চেয়ে নরকে রাজত্ব করা অনেক শ্রেয় শয়তানের এই আর্তনাদ যেন মিলটনেরই আত্মার প্রতিধ্বনি।
বিদ্রোহী শয়তান পরাজিত হয়ে নির্বাসিত হয়েছে নরকে। তবুও সে ভেঙে পড়েনি। তারই মত যারা নির্বাসিত তাদের নিয়ে প্রতিহিংসার সুযোগ খুঁজতে থাকে।
তখন স্বর্গে ছিল পৃথিবীর আদি মানব আদম, আর প্রথম মানবী ইভ। শয়তান এসে হাজির হল স্বর্গে। আদম আর ইভ তখন ঘুরে বেড়াচ্ছিল স্বর্গের উদ্যানে। তাদের প্রলুব্ধ করল জ্ঞান বৃক্ষের ফল খেতে। যে ফল খেতে ঈশ্বর তাদের নিষেধ করেছিলেন। ক্রুদ্ধ হলেন ঈশ্বর। তাঁর আদেশ অমান্য করার জন্য আদেশ ইভকে স্বর্গ থেকে বঞ্চিত হতে হল। তাদের স্থান হল পৃথিবীতে।
এই কাহিনী মিলটন নিয়েছিলেন বাইবেল থেকে। কিন্তু প্যারাডাইস লস্টের শ্রেষ্ঠত্ব তার কাহিনীর মধ্যে নয়। সুদূরপ্রসারী অন্তদৃষ্টি, বর্ণনার অসাধারণ ও তেজস্বী ছন্দ, গুরুগম্ভীর ভাষা, বিস্তৃত পটভূমিকা প্যারাডাইস লস্টকে এক মহাকাব্যিক রূপ দিয়েছে।
প্যারাডাইস লস্টের পরবর্তী অংশ মিলটন লিখলেন প্যারাডাইস রিগেণ্ড (Paradise Regained)। মানুষের শক্তির প্রতি মিলটনের ছিল গভীর আস্থা। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষ কখনো চিরদিনের জন্য পরাজিত হতে পারে না। মানব পুত্র যেদিন মানুষের জন্য আত্মহুতি দেবেন, মানুষ তখনই খুঁজে পাবে তার স্বর্গের অধিকার। এই কাব্যের মধ্যে মিলটনের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটেনি। প্যারাডাইস লস্টের অসাধারণত্ব এখানে খুঁজে পাওয়া যায় না।
এরপর মিলটন লিখলেন বাইবেলের চরিত্র অবলম্বন করে স্যামসন অ্যাগনিস্টিস (Samson Agonistes)। মল্লযোদ্ধা স্যামসন। একদিন তার শৌর্য বীর্য ছিল, এখন অন্ধ। ফিলিস্টাইনদের হাতে বন্দী। তার বিশ্বাসঘাতিনী স্ত্রীর জন্যই তাকে বন্দী হতে হয়েছে। শক্তিমান স্যামসন কারো অনুগ্রহে মুক্তি চায় না। তার চেয়ে বন্দী জীবন অনেক শ্রেয়। কিন্তু যেদিন পথের মল্লযোদ্ধা হ্যারাফার কাছে অপমানিত হয় সেই দিন সে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। নিজের বাহুবলে হত্যা করে হ্যারাফাঁকে। কিন্তু পরিণতিতে তাকে মৃত্যু বরণ করতে হয়।
স্যামসনের চরিত্রের মধ্যে দিয়ে মিলটন যেন নিজেকেই প্রতিবিম্বিত করেননি, এতে ফুটে উঠেছে সমগ্র ইংরেজ জাতির অবক্ষয়। ক্রমওয়েলের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় চার্লসের আমলে সমগ্র জাতি যেন নতজানু হয়ে রাজশক্তির করুণা ভিক্ষা করছে।
তিনি স্বপ্ন দেখতেন স্যামসনের মত তাদের অন্তরেও চিরবিদ্রোহী আত্মা জেগে উঠুক। জন্ম নিক নতুন স্বাধীন মুক্ত ইংল্যান্ড।
এই বুকভরা স্বপ্ন নিয়েই ১৬৭৪ সালের ৮ই নভেম্বর পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন ইংরাজি তথা বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জন মিলটন।
তথ্যসূত্রঃ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী – মাইকেল এইচ. হার্ট / সম্পাদনায় – রামশংকর দেবনাথ