ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল (Florence Nightingale)
প্রথম পাতা » জীবনী » ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল (Florence Nightingale)ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল
(১৮২০-১৯১০)
১৮৫০ সাল। ক্রিমিয়ার প্রান্তরে ইংলন্ড ও রাশিয়ার যুদ্ধ চলেছে। দুই পক্ষেই শত শত সৈনিক নিহত হচ্ছে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেক দূরে কুটারিতে তৈরি হয়েছে আহত সৈনিকদের জন্য হাসপাতাল। মুমূর্ষ মানুষের আর্তনাদে চারদিকের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। তার মাঝে চলেছেন। কোন ক্লান্ত নেই, বিরক্তি নেই। দু চোখ জুড়ে রয়েছে ভালবাসা, স্নেহের পরশ। যখনই তিনি কারো পাশে গিয়ে দাঁড়ান, মুহূর্তে সে মুহূর্তে সে ভুলে যায় তার সব ব্যথা যন্ত্রণা। রাতের বেলায় যখন সকলে ঘুমিয়ে পড়ে, তিনি প্রদীপ নিয়ে রুগীদের মধ্যে বেড়ান। যারা জেগে থাকে তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেন। তারপর আবার এগিয়ে যান পরের মানুষটির দিকে। মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে থাকে সবাই। দেখতে দেখতে সমস্ত প্রান্তরে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে “দীপ হাতে রমণী।”।
যুদ্ধ শেষ হয়। সৈনিকরা ফিরে যায় নিজের গৃহে। কিন্তু সেই দীপ হাতে রমণীর কাজ শেষ হয় না। ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রান্তরে যে কাজের সূচনা করেন সেই সেবাব্রতকে ছড়িয়ে দেন দেশে দেশে, পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। মূলত তারই প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে আধুনিক নার্সিং ব্যবস্থা। সেই মহীয়সী মহিলার নাম ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল।
ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের জন্ম ১৮২০ সালের ২ই মে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে। তার পিতামাতার জন্মস্থানের নাম অনুসারে কন্যার নাম রাখেন। নাইটিংগেলের পিতা ছিলেন ধনী এবং ইংলন্ডের অভিজাত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। বিভিন্ন মন্ত্রী, বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি তাদের বাড়িতে নিয়মিত আসা-যাওয়া করত।
শিক্ষার ব্যাপারে ফ্লোরেন্সের পিতা ছিলেন উদার। মেয়েকে সঙ্গীত, ছবি আঁকা শেখানোর সাথে দেশ বিদেশের নানান ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করলেন। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ল্যাটিন, গ্রীক, ইতালিয়ান, ফরাসী, জার্মান আয়ত্ব করে ফেললেন ফ্লোরেন্স।
ফ্লোরেন্সের ছেলেবেলা কেটেছে ইংলন্ডের ডার্বিশায়ার অঞ্চলে তাদের পুরনো বাড়িতে। গ্রাম্য পরিবেশের এই বাড়ি ফ্লোরেন্সের খুব ভাল লাগত।
এখানকার মানুষজন পরিবেশ এমনকি ছোট ছোট জীবজন্তু অবধি ছিল তাঁর খুব প্রিয়। প্রত্যেকের উপরেই তিনি অনুভব করতেন এক গভীর মমত্ব বোধ। সেই শিশুবেলা
থেকেই বাড়ির কোন লোক সে পিতামাতা ভাইবোন আত্মীয় পরিজন হোক বা কাজের লোক হোক, অসুস্থ হওয়া মাতৃ িতিনি সেবা করতে এগিয়ে যেতেন।
এমনকি গ্রামের কোন মানুষ, হাঁস, মুরগি, গরু, ঘোড়া অসুস্থ হলেও তিনি সেবা করতে দ্বিধা করতেন না।
শৈশব অতিক্রম করে যৌবনে পা দিলে ফ্লোরেন্সের পিতা ঠিক করলেন মেয়েকে লন্ডন শহরে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠাবেন। ১৭ বছর বয়েসে ডার্বিশায়ার ত্যাগ করে লন্ডন শহরে এলেন ফ্লোরেন্সে। গতানুগতিক শিক্ষার প্রতি সামান্যতম আকর্ষণ অনুভব করতেন না ফ্লোরেন্স। তাঁর ইচ্ছা ছিল সেবাকে জীবনের ব্রত হিসাবে নেবেন। কন্যার এই ইচ্ছার কথা শুনে চমকে উঠলেন তার পিতামাতা। সেই যুগে সেবাকে (Nursing) কোন পেশা হিসাবেই গুরুত্ব দেওয়া হত না। সেই সময় হাসপাতালগুলোর অবস্থা ছিল যেমন ভয়াবহ তেমনি করুণ। সেবার কাজ প্রায় সম্পূর্ণ অবহেলিত। যারা এই পেশায় যোগ দিত তারা সকলেই ছিল না তাঁদের। ফ্লোরেন্সের মত এক অভিজাত পরিবারের সন্তান এই ধরনের পেশা গ্রহণ করবে এ কথা কিছুতেই তাঁর পিতামাতা মেনে নিতে পারছিলেন না। তাঁরা মেয়েকে দেশভ্রমণে পাঠিয়ে দিলেন। যদি মেয়ের ইচ্ছার পরিবর্তন হয়।
ফ্লোরেন্স প্রথমে Bracebridge দম্পতির সাথে রোমে গেলেন। সকলেই যখন রোমের প্রাচীন শিল্পকলা দেখায় ব্যস্ত, সেই সুযোগে ফ্লোরেন্স দশ দিনের জন্য গেলেন রোমান ক্যাথিলক কনভেন্টে। দেখলেন সেখানকার সন্ন্যাসিনীদের সেবামূলক কাজ। লক্ষ্য করলেন তাদের সাংগঠনিক কাজকর্ম। এই সময় জার্মানীর এক শহরে Nursing শিক্ষা দেবার জন্য একটি স্কুল ছিল। এটিরও পরিচালনার ভার ছিল সন্ন্যাসিনীদের উপর। তিন মাস এখানে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিলেন ফ্লোরেন্স। সেই সময়েই তার মনের মধ্যে জেগে ওঠে এক স্বপ্ন, ইংলন্ডে ফিরে গিয়ে তিনি এই ধরনের একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করবেন।
ইউরোপ ভ্রমণ কালেই ফ্লোরেন্সের পরিচয় হয় সিডনি হার্বার্টের সাথে। হার্বার্ট ইংলন্ডের এক আর্লের পুত্র। সম্ভ্রান্ত সুদর্শন সুঠাম চেহারায় এক ৩৮ বছরের যুবক। ফ্লোরেন্সের বয়স তখন ২৮। প্রথম পরিচয়েই মুগ্ধ হলেন ফ্লোরেন্স। এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব লুকিয়ে ছিল হার্বার্টের মধ্যে। ফ্লোরেন্সের প্রতিভা, তার অন্তস্থিত আকাক্ষাকে উপলব্ধি করতে সামান্যতম বিলম্ব হল না হার্বার্টের। তিনিই প্রথম সম্মান জানালেন, উৎসাহিত করলেন ফ্লোরেন্সের মনের আকাক্ষাকে। দুজনের মধ্যে গড়ে উঠল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। এই বন্ধুত্ব দুটি জীবনকেই মহৎ উদ্দেশ্য আর মানবতার কল্যাণে আত্মোৎসর্গ করতে সাহায্য করেছিল।
আবার দেশভ্রমণে বার হলেন ফ্লোরেন্স। ১৮৪৯ সাল, তখন তার বয়স মাত্র ১৯, প্যারিসে সেন্ট ভিনসেন্ট সোসাইটির একটি বড় হাসপাতাল ছিল আলেকজান্দ্রিয়ায়। সেখানে গিয়ে প্রত্যক্ষ করলেন হাসপাতাল পরিচালনার কাজ।
ইউরোপের যে দেশেই তিনি গেলেন, প্রত্যক্ষ করলেন সেখানকার হাসপাতালের সেবামূলক কাজকর্ম, তার ধারা পদ্ধতি। এইভাবে যেমন তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বাড়তে থাকে, তার সাথে সামান্য যা কিছু নার্সিং-এর বই ছিল সমস্ত পড়ে ফেললেন।
একদিকে যখন চলছিল তাঁর জ্ঞান অর্জন, অন্যদিকে মনের মধ্যে জেগে উঠছিল এক নতুন স্বপ্ন। ইংলন্ডে ফিরে গিয়ে এই সেবার আদর্শকেই জীবনে গ্রহণ করবেন।
দীর্ঘদিন পর স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন ফ্লোরেন্স। তাঁর বাবা-মার মনে হয়েছিল তাদের মেয়ে এইবার নিশ্চয়ই কোন অভিজাত ঘরের ছেলেকে বিবাহ করবে। কিন্তু ফ্লোরেন্স বললেন আমি সেবিকা হতে চাই।
মেয়ের কথা শুনে চমকে উঠলেন বাবা-মা। নানাভাবে ফ্লোরেন্সকে বাধা দেবার চেষ্টা করলেন তারা। কিন্তু নিজের সংকল্পে অটল ফ্লোরেন্স। অবশেষে তাঁর দৃঢ়তার কাছে হার মানতে হল। অশ্রুসিক্ত চোখে কন্যার ইচ্ছায় সম্মতি দিলেন।
লন্ডনের হার্লে স্ট্রীটে ডাক্তাররা একটি মেয়েদের জন্য হাসপাতাল তৈরি করেছিলেন। ফ্লোরেন্স সেই হাসপাতালের সুপারিনটেন্ডেন্ট পদে যোগ দিলেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ফ্লোরেন্সের উপর ব্যাপক দায়িত্বভার অর্পণ করল।
ফ্লোরেন্স লক্ষ্য করলেন হাসপাতালের পরিবেশ রুগীদের স্বাস্থ্যের পক্ষে সম্পূর্ণ প্রতিকূল। চারদিকে নোংরা আবর্জনা, শুধু মাত্র ঔষধ দেওয়া ছাড়া কোন স্বাস্থ্যবিধিই সেখানে মানা হয় না।
ফ্লোরেন্স সর্বপ্রথম হাসপাতাল পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর দিলেন। চারদিকের নোংরা আবর্জনা পরিষ্কার করা হর। প্রতিটি বন্ধ জানালা খুলে ফেলা হল। মুক্ত বাতাস বইবার। জন্য নতুন জানালা বসানো হল। রুগীদের সেবা-শুশ্রূষার দিকে সর্বাদিক গুরুত্ব দিলেন ফ্লোরেন্স। তিনি বিশ্বাস করতেন শুধু ঔষধ নয়, একমাত্র সেবাই পারে কোন রুগীর নতুন জীবন দান করতে। তাঁর প্রবর্তিত ব্যবস্থায় কয়েক মাসের মধ্যেই হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থায় সুফল দেখা দিল। রুগী মৃত্যুর হারও কমতে থাকে।
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল প্রবির্তত নতুন ধারার চিকিৎসা পদ্ধতির সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। লন্ডনের প্রতিটি বড় বড় হাসপাতাল ফ্লোরেন্সকে আমন্ত্রণ জানায় সেখানে যোগ দিতে। সেই সময় ইংলন্ডের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল ছিল কিংস কলেজ হাসপাতাল। ফ্লোরেন্সের মনে হল একমাত্র কিংস কলেজে গেলেই তিনি তাঁর শিক্ষা অভিজ্ঞতা হার্লে স্ট্রীটের হাসপাতালের লব্ধ প্রত্যক্ষ জ্ঞানকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারবেন। যখন তিনি নতুন কাজে যোগদানের জন্য সম্পূর্ণভাবে মনস্থির করে ফেলেছেন, ঠিক সেই সময় ইংলন্ডের ভাগ্যাকাশে নেমে এল এক বিপর্যয়।
১৮৫৪ সাল। তুরস্কের বিরুদ্ধে রাশিয়া যুদ্ধ ঘোষণা করল। বিপন্ন তুরস্ককে সাহায্য করবার জন্য সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ইংলন্ডের সেনাবাহিনী। শুরু হল তুমুল যুদ্ধ। ক্রিমিয়ার প্রান্তরে এই যুদ্ধ হয়েছিল বলে ইতিহাসে এই যুদ্ধের নাম ক্রিমিয়ার যুদ্ধ।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েকদিন পরেই দি টাইমস পত্রিকার এক সংবাদদাতা যুদ্ধের প্রান্তর ঘুরে এসে জানালেন যুদ্ধে আহত সৈনিকদের অবস্থা ভয়বহ। তাদের সেবার পরিচর্যার জন্য সামান্যতম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। প্রতিদিন অসংখ্য সৈনিক মারা পড়ছে। সংবাদপত্রের এই ভাষ্যে দেশজুড়ে প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। জনসাধারণ ক্ষোভে রাগে ফেটে পড়ল। বিচলিত হয়ে পড়লেন দেশের উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীরা। সেই সময় প্রতিরক্ষা দপ্তরের সেক্রেটারি ছিলেন সিডনি হার্বাট। তিনি ফ্লোরেন্সকে লিখলেন যুদ্ধের এই বিশৃঙ্খলা অবস্থায় আহত সৈনিকদের তত্ত্বাবধান করবার মত একজনও উপযুক্ত ব্যক্তি নেই। যদি আপনি এই কাজের ভার গ্রহণ করেন, দেশ আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। দেশের এই ডাক উপেক্ষা করতে পারলেন না ফ্লোরেন্স। আত্মীয় পরিজনের সব বাধা ভয়কে উপেক্ষা করে ফ্লোরেন্স হার্বার্টের অনুরোধে সাড়া দিলেন। কয়েকদিনের মধ্যেই তাকে তুরস্কের হাসপাতালের সুপারিনটেন্ডেন্ট পদে নিযুক্ত করা হল। সাথে সাথে চতুর্দিকে প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। একজন সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারের সুন্দরী শিক্ষিত মহিলা যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে আহত সৈনিকদের সেবা করবেন! বিস্ময়ে শ্রদ্ধায় সকলেই অভিভূত। চতুর্দিক থেকে মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন ফ্লোরেন্সের দিকে। দান আর উপহারে ভরে উঠল তাদের ভাণ্ডার। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল নার্সিং-এর জন্য প্রয়োজনীয় স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী তৈরি করা। ফ্লোরেন্স ৩৮ জন মহিলার এক দল তৈরি করলেন। তার মধ্যে দশজন রোমান ক্যাথলিক সিসটার, আটজন চার্চের সভ্য, ২০ জন বিভিন্ন হাসপাতালের নার্স।
ফ্লোরেন্সের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল তিনি দল নির্বাচন সাম্প্রদায়িক মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। এই ধরনের সমালোচনার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলেন না। অবশেষে এগিয়ে এলেন মহারাণী ভিক্টোরিয়া। তিনি পূর্ণ সমর্থন জানালেন ফ্লোরেন্সকে। স্বেচ্ছাসেবী দলের উদ্দেশ্যে পাঠালেন তাঁর আশীর্বাদ। সব সমালোচনা বন্ধ হয়ে গেল।
সমস্যা সৃষ্টি হল অন্য ক্ষেত্রে। সামরিক বাহিনীর কিছু অফিসার কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে মেয়েরা পুরুষদের সেবা করবে। এতদিন তো এই কাজ পুরুষরাই করে এসেছে। কোন সমালোচনাতেই বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করলেন না ফ্লোরেন্স। তিনি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে রওনা হলেন স্কুটারির দিকে। পনেরো দিন পর তারা এসে পৌঁছলেন স্কুটারির প্রান্তরে। সেখানেই গড়ে উঠেছে আহত সৈনিকদের জন্য হাসপাতাল।
দীর্ঘ পথশ্রমে সকলেই ক্লান্ত অবসন্ন তবুও মুহূর্তের জন্য বিলম্ব করলেন না ফ্লোরেন্স। প্রথমেই গেলেন হাসপাতাল পরিদর্শনে। সেখানকার ভারপ্রাপ্ত একজন অফিসার বললেন, এখানে কোন কিছুরই অভাব নেই। কিন্তু ফ্লোরেন্স সমস্ত হাসপাতাল ঘুরে দেখলেন সর্বত্রই শুধু অভাব আর অভাব। রুগীদের শোবার মত বিছানা নেই, পরিবার পোশাক নেই, সাবান নেই, খাবার নেই, পাত্র নেই, সবচেয়ে বড় কথা ঔষধ, খাবার যেটুকু আছে প্রয়োজনের তুলনায় নেই বললেই চলে।
সামরিক বিভাগের ভাণ্ডারে যদিও এই সমস্ত জিনিস ছিল কিন্তু নানান বিধিনিষেধের জন্য কিছুই পেলেন না ফ্লোরেন্স। সাথে করে যা কিছু নিয়ে এসেছিলেন তাই দিয়েই কাজ শুরু করলেন।
ইতিমধ্যে আহত সৈনিকদের ভিড়ে হাসপাতাল চত্বর পূর্ণ হয়ে ওঠে। চতুর্দিকে শুধু আর্তনাদ আর যন্ত্রণাকাতর ধ্বনি। সর্বশক্তি নিয়ে আহত মানুষদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন ফ্লোরেন্স। প্রয়োজনীয় সঙ্গতি নেই। একটি সরকারী তদন্তকারী দল ও টাইমস পত্রিকার প্রতিষ্ঠিত ফান্ডের কাছ থেকে কিছু সাহায্য পাওয়া গেল, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা অকিঞ্চিৎকর। ফ্লোরেন্স সাহায্যের জন্য দেশবাসীর কাছে আবেদন জানালেন। তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে সমস্ত ইংলন্ডের মানুষ দু’ হাতে অর্থ প্রেরণ করতে আরম্ভ করল।
সর্বপ্রথমে হাসপাতাল চতুর পরিষ্কার করবার জন্য ঝাড়ুন তোয়ালের প্রয়োজন দেখা দিল। সরকারী দপ্তরের যে কর্মচারীর কাছে এই সব ছিল, ফ্লোরেন্স বুঝতে পারলেন তা সগ্রহ করতে গেলে আইনের নানা বেড়াজাল পেরিয়ে আসতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। তিনি টাইমস্ তহবিলের কাছে আবেদন জানালেন। সেখানেও অনিয়ম। আহত সৈনিকদের জন্য পরিচ্ছন্ন পোশাক দরকার। নিরুপায় হয়ে ফ্লোরেন্স স্কুটারিতে নিজেই একটি বিশাল লন্ড্রী খুলে ফেললেন, ততদিনে পোশাক তোয়ালে আসতে আরম্ভ করেছে। ফ্লোরেন্স আদেশ দিলেন মালের পেটি আসা মাত্রই যেন তা খুলে ফেলা হয়। আইনকানুন আর নিয়মের বেড়াজালে যেন এক মুহূর্ত বিলম্ব না হয়।
ফ্লোরেন্সের আত্মত্যাগ কর্মনিষ্ঠা ভালবাসা মানুষকে উজ্জীবিত করতে থাকে। সকলেই কর্মতৎপর হয়ে ওঠে। হাসপাতাল পরিষ্কার করে আহত সৈনিকদের যত্নের দিকে মনোযোগ দিলেন ফ্লোরেন্স। এতদিন বাহিনীর হাসপাতাল যে পদ্ধতিতে পরিচালিত হত তিনি তার আমূল পরিবর্তন করলেন। সে সমস্ত কর্মচারীরা হাসপাতালের কাজের উপযুক্ত নয় বিবেচনা করলেন, তিনি তাদের অন্যত্র পাঠিয়ে দিলেন। একদিকে তিনি ছিলেন দয়ার প্রতিমূর্তি অন্যদিকে কঠিন কঠোর। কাজের সামান্যতম বিশৃঙ্খলা বিচ্যুতি সহ্য করতে পারতেন না।
ফ্লোরেন্স স্কুটারিতে পৌঁছবার কয়েকদিন পর এক বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছেন, “ সেই সমস্ত অফিসারদের প্রতি আমার কিছু সহানুভূতি আছে যারা আমার ক্রমাগত চাহিদা পূরণ করতে করতে দিশাহারা হয়ে পড়েছে। কিন্তু সেই সমস্ত লোক যারা মানুষের মৃত্যু মেনে নিতে পারবে কিন্তু সরকারী কেতা-কানুন ভেঙে একটি ঝটা দেবে না–তাদের প্রতি আমার সামান্যতম সহানুভূতি নেই।”
কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই প্রাথমিক কাজকর্ম শেষ করে সমস্ত হাসপাতালকে ঢেলে সাজাবার ব্যবস্থা করলেন। হাসপাতালের কর্মচারীদের স্বতন্ত্র দল তৈরি করে তাদের উপর জিনিসপত্র ভার অর্পণ করলেন। কারোর উপর জিনিসপত্র কেনার ভার পড়ল, কারোর উপর সমস্ত হাসপাতাল পরিচ্ছন্ন রাখা, কারো উপর রুগীদের পোশাক পরিচ্ছদের দায়িত্ব দেওয়া হল। শুধুমাত্র দায়িত্বভার আরোপ করেই নিশ্চিন্ত হলেন না ফ্লোরেন্স। যাতে প্রত্যেককে আপন আপন কর্ম দায়িত্বভার সুষ্ঠুভাবে পালন করে তার দিকে প্রতি মুহূর্তে সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। দিনের শেষে সকলের কাজের বিশ্লেষণ করতেন, ভুল-ত্রুটি দূর করে আরো কর্মদক্ষ হয়ে উঠবার পরামর্শ দিতেন।
অল্প কিছুদিনে মধ্যেই সমগ্র হাসপাতালের চেহারা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হল। শুধু তাই নয়, নতুন কয়েকটি ওয়ার্ড খোলা হল। চার মাইল অঞ্চল জুড়ে গড়ে উঠল এই হাসপাতাল।
ফ্লোরেন্স ছিলেন এই হাসপাতালের এক সেবার প্রতিমূর্তি। দিন-রাত্রির প্রায় সবটুকু অংশই তার কেটে যেত এই হাসপাতালের আঙিনায়। কখনো তিনি আহতদের ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছেন, কখনো তাদের পোশাক পরিয়ে দিচ্ছেন। আবার সহকর্মীদের হাতে হাত লাগিয়ে হাসপাতাল আঙিনা পরিষ্কার করছেন। রুগীদের জন্য খাবার তৈরি করছেন। আবার তিনিই রাতের গভীরে সকলে যখন ঘুমিয়ে আছে, প্রদীপ হাতে রুগীদের বিছানার পাশে ঘুরে বেড়াতেন। রুগীরা মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে দেখত। তাদের। মনে হত এক মূর্তিময়ী দেবী যেন তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। সব দুঃখ যন্ত্রণা মুহূর্তে ভুলে যেত তারা। একজন সৈনিক লিখেছেন যখন তিনি আমাদের পাশ দিয়ে হাঁটতেন, এক অনির্বচনীয় আনন্দে আমাদের সমস্ত মনপ্রাণ ভরে উঠত। তিনি প্রত্যেকটি বিছানার পাশে এসে দাঁড়াতেন। কোন কথা বলতেন না, শুধু মুখে ফুটে উঠত মৃদু হাসি। তারপর তিনি যখন আমাদের অতিক্রম করে যেতেন, তার ছায়া পড়ত আমাদের শয্যার উপর। সৈনিকরা পরম শ্রদ্ধার সেই ছায়াকেই চুম্বন করত। তারা বলত ‘দীপ হাতে রমণী। এই নামেই তিনি সমস্ত পৃথিবীর মাঝে অমর হয়ে রইলেন। যুদ্ধ যতই এগিয়ে চলল তার কর্মভার বেড়েই চলল। যুদ্ধের প্রয়োজনে যেখানে যত হাসপাতাল তৈরি হয়েছিল, সব হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালের দূরত্ব কিছু কম ছিল না। কিন্তু কোন দায়িত্বভার গ্রহণেই তিনি অসম্মতি প্রকাশ করতেন না। প্রবল তুষারপাত, বৃষ্টির মধ্যেই তিনি বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে বেড়াতেন। সেখানকার কাজের তত্ত্বাবধান করতেন। তাঁর আন্তরিক চেষ্টায় মৃত্যুর হার হাজারে ষাট থেকে তিনি এসে দাঁড়াল।
তবুও বিশ্রাম নেই ফ্লোরেন্সের। শুধু আহত মানুষের দেহের সুস্থতা নয়, মনের আনন্দের ব্যবস্থা করতেও তিনি সচেষ্ট হয়ে উঠলেন। আহত সৈনিকরা যাতে নিয়মিত বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারে, তিনি তার ব্যবস্থা করলেন। প্রতিটি হাসপাতালে গড়ে তুললেন লাইব্রেরি। সেখানে আমোদ-প্রমোদের জন্য শুধু বই ছাড়াও বিভিন্ন সংবাদপত্র আনার ব্যবস্থা করলেন। হাসপাতাল ব্যবস্থার সমস্ত চেহারাটাই পরিবর্তিত হয়ে গেল। এতদিনের প্রচলিত ব্যবস্থা ভেঙে জন্ম নিল নতুন সম্পূর্ণ বিজ্ঞান সম্মত আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার।
শুধু হাসপাতাল নয়, বহুবার তিনি গিয়েছেন যুদ্ধের প্রান্তরে। বুঝেছিলেন শুধু অস্ত্র বা সামরিক শিক্ষা একজন সৈনিককে তার দক্ষতার চরম শিখরে পৌঁছে দিতে পারে না। তাদের জন্যেও পাঠাতেন গরম খাবার, নানান বই।
এই অক্লান্ত পরিশ্রমে তার শরীর ক্রমশই ভেঙে পড়ছিল, মাঝে মাঝই অসুস্থ হয়ে পড়তেন তিনি। একবার এত অসুস্থ হয়ে পড়লেন, ডাক্তাররা প্রায় তার জীবনের আশা ত্যাগ করেছিল। কিন্তু তার অদম্য মনোবল, জীবনীশক্তির তাগিদে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন। কিন্তু নষ্ট হয়ে গেল তার সুন্দর চুল, দেহের সৌন্দর্য। আগেকার দেহের শক্তি আর ফিরে পাননি ফ্লোরেন্স।
অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি বিছানায় শুয়ে শুয়ে তার কাজ করতেন। ডাক্তাররা, উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা তাকে লন্ডনে ফিরে যাওয়ার জন্য বারংবার অনুরোধ করতে থাকেন। কিন্তু সকলের সমস্ত অনুরোধই তিনি প্রত্যাখ্যান করে বললেন, যতক্ষণ না শেষ আহত সৈনিকটি দেশে প্রত্যাবর্তন করছে ততক্ষণ তাঁর পক্ষে স্কুটারি ত্যাগ করা সম্ভব নয়।
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের এই অজেয় মনোভাবের জন্য সমস্ত ইংলন্ড তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় প্রশংসায় মুখরিত হয়ে ওঠে। মহারানী ভিক্টোরিয়া তাঁকে লিখলেন, “যেদিন আপনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করবেন সেই দিনটি আমর কাছে বিরাট আনন্দের দিন হবে কারণ সমস্ত নারী জাতিকে আপনি সুমহান গৌরবে মহিমান্বিত করেছেন। আপনার সুস্থতার জন্য ঈশ্বরের কাছে আন্তরিক প্রার্থনা করি।”
অবশেষে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটল। ১৮৫৬ সাল, দীর্ঘ দু বছর আহত সৈনিকদের সেবার করে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলে ফিরে চললেন তার স্বদেশভূমিতে। তার সম্মানে ব্রিটিশ সরকার একটি আলাদা জাহাজ পাঠাতে চাইলেন। কিন্তু সে অনুরোধ তিনি প্রত্যাখ্যান করলেন, সকলের সাথেই দেশে প্রত্যাবর্তন করলেন। সমস্ত দেশ তাঁকে বিপুল সম্মান জানাবার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু সবিনয়ে সব কিছুকে প্রত্যাখ্যান করলেন সামান্যতম আকাক্ষা ছিল না। শুধুমাত্র মহারানী ভিক্টোরিয়ার দেওয়া সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগদান করার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের মধ্যে তিনি শুধু নিজেকে একজন সেবিকা নিয়ম ভেঙে নারীকে দিলেন সম্মানের আসন। প্রচলিত কুসংস্কারে নিগড় ভেঙে সেবার কাজকে (Nursing) মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করলেন। কিন্তু তখনো তার কাজ শেষ হয়নি। তাঁর আদর্শ স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার কাজ বাকি রয়ে গিয়েছিল।
ফ্লোরেন্সের ইচ্ছা ছিল দেশে প্রথম নার্সিং স্কুল স্থাপন করবেন। সমগ্র ইংলন্ডের মানুষ তাকে সম্মান জানাতে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড অর্থ তুলে দিল। সেই অর্থে ১৮৫৯ সালে সেন্ট টমাস হাসপাতালে তৈরি হল প্রথম নার্সিং স্কুল, “নাইটিঙ্গেল হোম” যা আধুনিক নার্সিং শিক্ষার প্রথম পাঠগৃহ।
শারীরিক অক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এই স্কুলের পঠন-পাঠন পরিচালনা বিধি ব্যবস্থা নিজেই নিরূপন করতেন। নার্সিং শিক্ষার সাথে সাথে সামরিক চিকিৎসা সম্বন্ধেও তাঁর ছিল গভীর আগ্রহ। ১৮৫৮ সালে তিনি প্রকাশ করলেন আটশো পাতার একখানি fa59, Note on matters affecting the health, efficiency and Hospital Administration of the British Army, এছাড়া তিনি নার্সিং-এর উপর একাধিক বই লিখলেন।
শুধু নার্সিং নয়, হাসপাতাল পরিচালনা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও তার মূল্যবান পরামর্শ শুধু ইংলন্ড নয়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও গ্রহণ করতে থাকেন। সমগ্র হাসপাতাল পরিচালন ব্যবস্থার তিনি আমূল পরিবর্তন করেন।
ভারতবর্ষ সম্বন্ধেও ফ্লোরেন্সের আগ্রহ ছিল গভীর। সিপাই বিদ্রোহের সময় তিনি ভারতবর্ষে গিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
ফ্লোরেন্সের দেহের কর্মক্ষমতা প্রায় সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে আসছিল। একসময় শারীরিক দিক থেকে সম্পূর্ণভাবে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন তিনি। এর পরেও বহু বছর বেঁচেছিলেন তিনি। রোগ যন্ত্রণাকে অতিক্রম করে তার অন্তরে জেগে থাকত এক গভীর আনন্দ। তিনি তাঁর জীবিতকালেই প্রত্যক্ষ করেছেন তাঁর শিক্ষা, সাধনা ব্যর্থ হয়নি। দেশে দেশে গড়ে উঠছে নার্সিং স্কুল। যে পেশা একদিন ছিল ঘৃণিত তাই হয়ে উঠেছে। পরম সম্মানের। নতুন প্রজন্মের মেয়েরা নার্সিংকে জীবনের ব্রত হিসাবে গ্রহণ করছে।
জীবিতকালে বহু সম্মান পেয়েছেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। কিন্তু তার আদর্শের বাস্তব রূপ দেখে যে আনন্দ পেয়েছেন তার চেয়ে বড় পাওয়া তাঁর কাছে আর কিছুই ছিল না।
অবশেষে ১৯১০ সালের ১৩ আগস্ট এই মানব দরদী মহীয়সী নারীর মৃত্যু হয়।
তথ্যসূত্রঃ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী – মাইকেল এইচ. হার্ট / সম্পাদনায় – রামশংকর দেবনাথ