জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল (James Clerk Maxwell)

প্রথম পাতা » জীবনী » জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল (James Clerk Maxwell)


জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল

জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল

(১৮৩১-১৮৭৯)
তড়িৎবিজ্ঞানে বিশেষ করে তড়িৎ ও তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ তত্ত্বের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর আবিষ্কৃত সূত্রটি তড়িৎ বিজ্ঞানে ম্যাক্সওয়েলের কর্কশ্রু-সূত্র নামে প্রসিদ্ধ। তড়িৎপ্রবাহের ফলে চুম্বক-শলাকার দিক নির্ণয় করা হয় এই সূত্রের সাহায্যে।

ম্যাক্সওয়েল পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করেন পরিবাহী তারের মধ্য দিয়ে যে দিকে তড়িপ্রবাহ চালনা করা হয় চুম্বক শলাকার উত্তর মেরু সেইদিকে বিক্ষিপ্ত হয়।

তড়িৎচুম্বক তরঙ্গতত্ত্ব বিষয়ে ম্যাক্সওয়েলের আবিষ্কারটিকে যুগান্তকারী বলা হয়। তরঙ্গ-তত্ত্ব সম্বন্ধে প্রথম সঠিক ধারণা তিনিই দিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম বলেছিলেন, বিদ্যুৎক্ষেত্রে অথবা চুম্বক ক্ষেত্রে সামান্যতম বিশৃঙ্খলা ঘটলেই আলোর গতির সমান একটি তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ বেরিয়ে আসে। এই তড়িৎচুম্বকের তরঙ্গের ধর্ম সাধারণ আলোর ধর্মের অনুরূপ। আলোকের মত এই তরঙ্গেরও হয় প্রতিফলন, প্রতিসরণ, পোলারাইজেশন প্রভৃতি।

আধুনিক বিজ্ঞানের বিকাশের মূলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যার তা হল বেতার তরঙ্গ। আর এই বেতার তরঙ্গ ল্যাবরেটরিতে উৎপাদন করেছিলেন বিজ্ঞানী হেনরিক হাস।

ম্যাক্সওয়েলের মতবাদের পরীক্ষা করতে গিয়েই তিনি বেতার তরঙ্গের সন্ধান পেয়েছিলেন।

আধুনিক বিজ্ঞানের মূল ধারক বলা হয় তিনটি নিয়মকে। তার প্রথমটি হল নিউটনের গতিবিজ্ঞান। দ্বিতীয়টি ম্যাক্সওয়েলের বিদ্যুৎ চুম্বক তরঙ্গ তত্ত্ব এবং তৃতীয় নিয়মটি হল অপগতি বিদ্যা।

এই নিয়মগুলোর মাধ্যমেই প্রাকৃতিক নিয়মশৃঙখলা ব্যাখ্যা করা বিজ্ঞানীদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে।

বলা বাহুল্য বহু মূল্যবান আবিষ্কারেরও প্রসূতি এই তিনটি নিয়ম। এ থেকেই ম্যাক্সওয়েলের অবদানের মূল্যায়ন করা সম্ভব।

ম্যাক্সওয়েলের জন্ম হয়েছিল ১৮৩১ খ্রি: ১৩ই নভেম্বর এডিনবরায়। তাঁর পিতা ছিলেন একজন আইনজীবী। কিন্তু মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন বিজ্ঞানের অনুরাগী। তাই স্বভাবতঃই পুত্রের বিজ্ঞান শিক্ষার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করতে তিনি চেষ্টার ত্রুটি করেননি। নিজেও অবসর সময়ে বসতেন ছেলেকে পড়াতে।

ম্যাক্সওয়েল ছিলেন পিতার একমাত্র পুত্র। তাই যথেষ্ট আদরে যত্নেই মানুষ হয়েছিলেন তিনি। তাকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়েছিল এডিনবরা আকাঁদেমিতে।

বাল্যকাল থেকেই একটা অদ্ভুত আড়ষ্টতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল ম্যাক্সওয়েলের মধ্যে। কারো সঙ্গে তিনি ভালভাবে কথা বলতে পারতেন না। অকারণ লজ্জা সঙ্কোচে কেমন আড়ষ্ট হয়ে যেতেন।

স্বভাবের এই দুর্বলতা তাঁর পিতাকে খুবই বিব্রত করে তুলেছিল। সে কারণেই তিনি পুত্রের এই লজ্জা কাটাবার জন্য একটু আগে আগেই ম্যাক্সওয়েলকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন।

কিন্তু ভাল স্কুলে গিয়েও এই লজ্জাভাব দূর হল না তার। পিতা এবারে চিন্তিত হয়ে পড়লেন।

অনেক চিন্তাভাবনার পর তিনি ঠিক করলেন পুত্রকে সর্বদা নিজের সঙ্গে রেখে তার সলজ্জভাব কাটাবার চেষ্টা করবেন। তিনি পুত্রকে সঙ্গে করেই আদালতে যেতে লাগলেন।

বেড়াতে যাবার সময়, সভাসমিতিতে যোগদানের সময়, বন্ধুদের বাড়িতে যাবার সময়, পুত্রকেও সঙ্গে রাখতে লাগলেন।

এভাবে বেশ কিছুদিন কাটল। বারো-তেরো বছর বয়সে ম্যাক্সওয়েলের লাজুক স্বভাবের কিছুটা পরিবর্তন হল।

এইভাবে স্কুলের পাঠ শেষ হল। কলেজে ভর্তি হলেন ম্যাক্সওয়েল বিজ্ঞানুরাগী পিতা তাঁর জন্য একটি সুন্দর গবেষণাগার তৈরি করিয়ে দিলেন। পিতার উৎসাহে উৎসাহিত হলেন ম্যাক্সওয়েল।

অল্পদিনের মধ্যেই তিনি পড়াশোনা ও গবেষণায় মেতে উঠলেন। ধীরে ধীরে এবারে প্রতিভার স্ফুরণ ঘটতে লাগল।

সহজাত উদ্ভাবনী ক্ষমতাবলে নিজেই কয়েকটি ছোটখাট যন্ত্র নির্মাণ করলেন তখন তার বয়স মাত্র ষোল। ম্যাক্সওয়েলের পিতা এই যন্ত্রগুলো একদিন তকালীন খ্যাতিমান বিজ্ঞানী ফোরবীজকে দেখতে দিলেন। ফোরবীজ ষোলবছরের কিশোরের উদ্ভাবনী প্রতিভা দেখে বিস্মিত হলেন, প্রশংসা করলেন উচ্ছ্বসিতভাবে।

পরে সেগুলো পাঠিয়ে দিলেন লন্ডনের রয়েল সোসাইটিতে। সোসাইটি ম্যাক্সওয়েলের প্রশংসা করে সার্টিফিকেট পাঠিয়ে দিলেন।

সতেরো বছর বয়সে ম্যাক্সওয়েল ভর্তি হলেন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষায়তনের গবেষণাগারে তিনি কিছুদিন চুম্বক ও তড়িৎ সম্বন্ধে গবেষণা করলন।

পরে উন্নততর গবেষণার জন্য যোগদান করেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানেই তিনি ১৮৫১ খ্রি: আবিষ্কার করেন কর্ক স্কু সূত্রটি।

ম্যাক্সওয়েলের প্রতিভা ছিল বহুমুখী। তিনি পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করলেও জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিতবিজ্ঞানেও তাঁর সমান দক্ষতা ছিল।

১৮৬০ খ্রি: কিংস কলেজের আমন্ত্রণে তিনি এখানকার পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যার প্রধান অধ্যাপকের পদ গ্রহণ করেন।

এই কলেজে অধ্যাপনাকালেই ১৮৬৪ খ্রি: ম্যাক্সওয়েল আবিষ্কার করেন তড়িৎ চৌম্বক তরঙ্গতত্ত্ব।

গণিতে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি থাকার কারণেই তাঁর পক্ষে চৌম্বক তরঙ্গতত্ত্বের ধারণা করা সম্ভব হয়েছিল।

পরবর্তীকালে আলোক তরঙ্গের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সহজ গণিতের পরিবর্তে উচ্চগণিতের ফেক্টর ও ক্যালকুলাস–এই দুই শাখা প্রয়োগ করেছিলেন।

সফল বিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি লাভের পর ডাক আসে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কিংস কলেজের কাজ ছেড়ে দিয়ে ম্যাক্সওয়েল যোগদান করে কেমব্রিজে।

কিছুকাল জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়েও গবেষণা করেছিলেন তিনি। শনিগ্রহের বলয় সম্পর্কে তাঁর একটি মূল্যবান প্রবন্ধ একসময়ে বিজ্ঞানীমহলে যথেষ্ট আগ্রহের সৃষ্টি করেছিল।

এই প্রবন্ধের জন্য তিনি এডামস পুরস্কার লাভ করেছিলেন।

ম্যাক্সওয়েল একাধিক মূল্যবান গ্রন্থও রচনা করেছিলেন, তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের নাম ট্রিটিজ অন ইলেকট্রিসিটি অ্যান্ড ম্যাগনেটিজম। তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি বিখ্যাত গবেষণাগার ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটারি প্রতিষ্ঠা। তার উদ্যোগ ও তত্ত্বাবধানেই এই গবেষণাগার গড়ে উঠেছিল।

দীর্ঘ পরিশ্রমের ফলে অল্প বয়সেই ম্যাক্সওয়েল রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৮৭৯ খ্রি: তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন।

তথ্যসূত্রঃ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী – মাইকেল এইচ. হার্ট / সম্পাদনায় – রামশংকর দেবনাথ