আব্দুর রাজ্জাক ( Abdur Rajjak)

প্রথম পাতা » জীবনী » আব্দুর রাজ্জাক ( Abdur Rajjak)


আব্দুর রাজ্জাক

আব্দুর রাজ্জাক

(২৩শে জানুয়ারি ১৯৪২ - ২১শে আগস্ট ২০১৭) ছিলেন একজন জনপ্রিয় বাংলাদেশী চলচ্চিত্র অভিনেতা যিনি নায়করাজ রাজ্জাক নামে সুপরিচিত। বাংলা চলচ্চিত্র পত্রিকা চিত্রালীর সম্পাদক আহমদ জামান চৌধুরী তাকে নায়করাজ উপাধি দিয়েছিলেন। নিজের জন্মস্থান কলকাতায় সপ্তম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় মঞ্চ নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে তার অভিনয় জীবন শুরু করেন এবং ১৯৬৬ সালে ১৩ নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন চলচ্চিত্রে একটি ছোট চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশী চলচ্চিত্রে তার অভিষেক ঘটে। তিনি জহির রায়হানের বেহুলা চলচ্চিত্রে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করেন। ষাটের দশকের শেষের দিকে এবং সত্তরের দশকেও তাকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের প্রধান অভিনেতা হিসেবে বিবেচনা করা হত। অভিনয় জীবনে তিনি বেহুলা, আগুন নিয়ে খেলা, এতটুকু আশা, নীল আকাশের নিচে, জীবন থেকে নেয়া, ওরা ১১ জন, অবুঝ মন, রংবাজ, আলোর মিছিল, অশিক্ষিত, ছুটির ঘণ্টা এবং বড় ভালো লোক ছিলসহ মোট ৩০০টি বাংলা ও উর্দু ভাষার চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি সব মিলিয়ে ১৬টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। তার মালিকানার রাজলক্ষী প্রোডাকশন থেকে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।তার পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলো হলো মৌচোর, বদনাম, পাগলা রাজা, ঢাকা ৮৬, চাঁপা ডাঙ্গার বউ, জিনের বাদশা , রাজামিস্ত্রি, প্রফেসর, বাবা কেন চাকর, সন্তান যখন শত্রু, আমি বাঁচতে চাই, মন দিতে চাই ইত্যাদি।

২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার সংস্কৃতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য তাকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে। ১৯৭৬, ১৯৭৮, ১৯৮২, ১৯৮৪ ও ১৯৮৮ সালে তিনি মোট পাঁচবার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৩ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তাকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করা হয়। এছাড়াও তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য বাচসাস পুরস্কার, মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি প্রথম সভাপতি ছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক। ২০১৭ সালের ২১শে আগস্ট ৭৫ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

প্রারম্ভিক জীবন ও বিবাহ
রাজ্জাক ১৯৪২ সালের ২৩শে জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আকবর হোসেন ও মাতার নাম নিসারুননেছা। রাজ্জাকরা ছিলেন নাকতলা এলাকার জমিদার। তিনি কলকাতার বাঁশদ্রোণীর নিকটে খানপুর হাইস্কুলে পড়াশুনা করেন। স্কুলে তিনি অঙ্কে কাঁচা ছিলেন। এ প্রসঙ্গে রাজ্জাকের বাল্যবন্ধু টি দাস বলেন, স্কুলের শিক্ষকেরা তাকে বলতেন, “অঙ্কটা অন্তত ভালো করে শেখ। যোগ বিয়োগ ঠিকঠাক করে না শিখলে পরিবারের এত সম্পত্তি সামলে রাখবি কি করে।” সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় সরস্বতী পূজা চলাকালে মঞ্চ নাটকে অভিনয়ের জন্য তার শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাকে কেন্দ্রীয় চরিত্রের জন্য বেছে নেন। শিশু-কিশোরদের নিয়ে লেখা নাটক বিদ্রোহীতে গ্রামীণ কিশোর চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই নায়ক রাজের অভিনয়ে সম্পৃক্ততা। অভিনয়ের জন্য ১৮ বছর বয়সে মুম্বইয়েও যান রাজ্জাক।

রাজ্জাক ১৯৬২ সালে লক্ষ্মীকে বিয়ে করেন। টালিগঞ্জে রাজ্জাকের এক আত্মীয়ের বাড়ির পাশে ছিল লক্ষ্মীদের বাড়ি। সেই আত্মীয়দের একজন লক্ষ্মীকে বাড়ির সামনে দেখে পছন্দ করে এবং বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায়। সেদিন রাজ্জাক আর লক্ষ্মীর আংটিবদল হয়। এর দুই বছর পরে তাদের বিয়ে হয়। নিজের নাম প্রসঙ্গে লক্ষ্মী দৈনিক প্রথম আলোকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “অনেকেই আমাকে হিন্দু মনে করেন। আমার পুরো নাম খায়রুন্নেসা। আমার আব্বা আমাকে আদর করে ডাকতেন ‘লক্ষ্মী’ বলে।”

১৯৬৪ সালে কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে এক রাতে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এক হিন্দু পরিবারের বাড়িতে আশ্রয় নেন। পরের দিন ২৬ এপ্রিল পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। তার সাথে ছিল তার স্ত্রী লক্ষ্মী ও পুত্র বাপ্পারাজ এবং পীযূষ বসুর দেওয়া একটি চিঠি ও পরিচালক আব্দুল জব্বার খান ও শব্দগ্রাহক মণি বোসের ঠিকানা। স্ত্রী পুত্রকে শরণার্থী শিবিরে রেখে তিনি আব্দুল জব্বার খানের সাথে সাক্ষাৎ করলে খান তাকে আশ্বাস দেন। তখন রাজ্জাক ৮০ টাকা মাসিক ভাড়ায় স্ত্রী-পুত্র নিয়ে কমলাপুরে এক বাসা ভাড়া করেন। পরে তিনি সুভাষ দত্ত, সৈয়দ আওয়াল, এহতেশামসহ আরও চলচ্চিত্রকারদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। আব্দুল জব্বার খানই তাকে ইকবাল ফিল্মসে কাজ করার সুযোগ দেন। ১৯৬৪ সালে তিনি কামাল আহমেদের সাথে সহকারী পরিচালক হিসেবে উজালা চলচ্চিত্রে কাজ করার সুযোগ পান। সহকারী পরিচালক হিসেবে তার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ছিল পরওয়ানা। কিন্তু ৮০ ভাগ কাজ হওয়ার পর তিনি এই ছবির কাজ ছেড়ে দেন।

অভিনয় জীবন
চলচ্চিত্রে আগমন (১৯৬৬-১৯৬৯)
প্রথমদিকে রাজ্জাক তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে “ঘরোয়া” নামের ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে দর্শকদের কাছে জনপ্রিয়তা পান। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি সালাউদ্দিন প্রোডাকশন্সের ১৩ নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন এবং কার বউ, ডাক বাবু, আখেরী স্টেশন-সহ আরও বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন।

১৯৬৬ সালে জহির রায়হান পরিচালিত বেহুলা চলচ্চিত্রে সুচন্দার বিপরীতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন। এতে লখিন্দর চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্রে অভিনেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। পৌরাণিক কাহিনীধর্মী এই চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে একটি মাইলফলক হয়ে আছে। এই ছবির সফলতার পরে জহির রায়হান রাজ্জাক-সুচন্দাকে নিয়ে নির্মাণ করেন আনোয়ারা (১৯৬৭) এবং সুয়োরাণী দুয়োরাণী (১৯৬৮)। সাহিত্যিক মোহাম্মদ নজিবর রহমান রচিত আনোয়ারা উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত আনোয়ারা চলচ্চিত্রটিতে তিনি আনোয়ারা চরিত্রের স্বামীর ভূমিকায় অভিনয় করেন। লোককাহিনীধর্মী সুয়োরাণী দুয়োরাণী ছবিতে তাকে রাখালের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানো এক শাহজাদার চরিত্রে দেখা যায়। ১৯৬৭ সালে তিনি সুজাতার বিপরীতে আমজাদ হোসেন ও নুরুল হক বাচ্চু পরিচালিত আগুন নিয়ে খেলা এবং ম. হামিদ পরিচালিত অপরাজেয় ছবিতে। এই সময়ে সুচন্দার বিপরীতে তিনি আমজাদ হোসেন পরিচালিত জুলেখা (১৯৬৭) ও সংসার (১৯৬৮), রহিম নেওয়াজ ও নূরুল হক পরিচালিত দুই ভাই (১৯৬৮), নুরুল হক বাচ্চু পরিচালিত কুচবরণ কন্যা (১৯৬৮), রহিম নেওয়াজ পরিচালিত মনের মত বউ (১৯৬৯) এবং আমির হোসেন পরিচালিত রোম্যান্টিকধর্মী যে আগুনে পুড়ি (১৯৭০) চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।

রাজ্জাক ১৯৬৮ সালে সুভাষ দত্ত পরিচালিত আবির্ভাব চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জুটি গড়েন কবরীর সাথে।এই জুটিকে একই বছর দেখা যায় আব্দুল জব্বার খানের বাঁশরী ছবিতে। এছাড়া তিনি মোহসীন পরিচালিত গৌরী ছবিতে অভিনয় করেন। পরের বছর তিনি নারায়ণ ঘোষ মিতার রোম্যান্টিকধর্মী নীল আকাশের নিচে ছবিতে মামুন চরিত্রে অভিনয় করেন। এতে তার বিপরীতে ছিলেন কবরী এবং এই ছবি দিয়ে রাজ্জাক-কবরী জুটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। একই বছর তাদের কাজী জহিরের বিয়োগাত্মক ময়নামতি (১৯৬৯) চলচ্চিত্রে দেখা যায়।

প্রতিষ্ঠা লাভ (১৯৭০-১৯৭৫)
১৯৭০ সালে রাজ্জাক প্রখ্যাত পরিচালক জহির রায়হান পরিচালিত রাজনৈতিক-ব্যঙ্গধর্মী জীবন থেকে নেয়া ছবিতে অভিনয় করেন। গণঅভ্যুত্থান এবং আইয়ুবের সামরিক শাসন নিয়ে রাজনৈতিক-ব্যঙ্গধর্মী এই ছবিতে রাজ্জাককে পরাধীন দেশের একজন সচেতন নাগরিক ফারুক চরিত্রে দেখা যায়। এতে তার বিপরীতে ছিলেন সুচন্দা।একই সালে মধ্যবিত্ত ঢাকার নাগরিক সমস্যা ও যাপিত জীবনের গল্প নিয়ে এহতেশাম পরিচালিত রোম্যান্টিক-নাট্যধর্মী পীচ ঢালা পথ ছবিতে তার বিপরীতে প্রথমবার দেখা যায় ববিতাকে। ববিতা এর পূর্বে তার এবং সুচন্দার মেয়ের ভূমিকায় সংসার ছবিতে অভিনয় করেন। এই ছবির সফলতার ধারাবাহিকতায় রাজ্জাকার ববিতা জুটিকে নিয়ে বাবুল চৌধুরী নির্মাণ করেন টাকা আনা পাই (১৯৭০) এবং নজরুল ইসলাম নির্মাণ করেন স্বরলিপি (১৯৭০)।পিতা-পুত্রের সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে নির্মিত টাকা আনা পাই ছবিতে অভিনয় করেন। এতে তার পিতার চরিত্রে দেখা যায় শওকত আকবরকে। ছবিতে তাকে উচ্চ শিক্ষিত দরিদ্র পরিবারের সন্তান শহীদ চরিত্রে দেখা যায়, যে পরবর্তীতে বড়লোকের মেয়ের জামাই হয়ে পিতৃঋণ শোধ করার বাস্তবতার মুখোমুখি হয়।

রাজ্জাক-কবরী জুটি জনপ্রিয়তার ধারাবাহিকতায় এই জুটিকে নারায়ণ ঘোষ মিতার ক খ গ ঘ ঙ (১৯৭০) ও দীপ নেভে নাই (১৯৭০), নজরুল ইসলামের দর্পচূর্ণ, নূরুল হক বাচ্চুর যোগ বিয়োগ (১৯৭০), আব্দুল জব্বার খানের কাঁচ কাটা হীরে (১৯৭০), কামাল আহমেদের অধিকার (১৯৭০), বাবুল চৌধুরীর আঁকা বাকা (১৯৭০), আলমগীর কুমকুমের স্মৃতিটুকু থাক (১৯৭১) এবং আলী কাউসারের গাঁয়ের বধূ (১৯৭১) চলচ্চিত্রে দেখা যায়। ক খ গ ঘ ঙ ছবিতে তাকে দেখা যায় এক দুরন্ত যুবক মন্টু চরিত্রে, যে তার পরিবারকে প্রচন্ড ভালোবাসে।

১৯৭১ সালে তিনি অশোক ঘোষ পরিচালিত নাচের পুতুল ছবিতে অভিনয় করেন। এতে তার বিপরীতে অভিনয় করেন শবনম। বাংলাদেশের স্বাধীনতার লাভের পর ১৯৭২ সালে প্রথম মুক্তি পায় রাজ্জাক অভিনীত মানুষের মন ছবিটি। মোস্তফা মেহমুদ পরিচালিত এই ছবির ব্যবসায়িক সফলতার মধ্য দিয়ে রাজ্জাকের যুগের সূচনা হয়।এতে তার বিপরীতে অভিনয় করেন ববিতা। এই ছবির সাফল্যের ধারাবাহিকতায় পরের বছর রাজ্জাক আর ববিতা জুটিকে নিয়ে অশোক ঘোষ নির্মাণ করেন প্রিয়তমা (১৯৭৩) এবং কবীর আনোয়ার নির্মাণ করেন স্লোগান (১৯৭৩)। প্রিয়তমা চলচ্চিত্রে খুরশিদ আলমের কণ্ঠে এবং রাজ্জাকের ঠোঁটে “আমার এই কলজেটায় চাক্কু মেরে” গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং ছবিটিও জনপ্রিয়তা লাভ করে।

১৯৭২ সালে অবুঝ মন চলচ্চিত্র দিয়ে রাজ্জাকের জুটি গড়ে ওঠে শাবানার সাথে। পরে তিনি শাবানার বিপরীতে সর্বাধিক ৪০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। কাজী জহির পরিচালিত অবুঝ মন ছবিতে রাজ্জাক সদ্য পাস করা এক ডাক্তারের চরিত্রে অভিনয় করেন, যে ধর্ম ও সমাজের খাতিরে তার প্রেমকে বিসর্জন দেয়। এছাড়া একই বছর তাকে শাবানার বিপরীতে দেখা যায় ওরা ১১ জন এবং চৌধুরী বাড়ি ছবিতে। মাসুদ পারভেজ প্রযোজিত এবং চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ওরা ১১ জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভিত্তিক প্রথম চলচ্চিত্র। এছাড়া ১৯৭২ সালে তিনি কামাল আহমেদের অশ্রু দিয়ে লেখা, বাবুল চৌধুরীর প্রতিশোধ, ইবনে মিজানের কমলা রাণীর দীঘি, এস এম শফির ছন্দ হারিয়ে গেল এবং নারায়ণ ঘোষ মিতার এরাও মানুষ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।

সাফল্য ও পুরস্কারপ্রাপ্তি (১৯৭৬-১৯৮৮)
১৯৭৬ সালে রাজ্জাক জহিরুল হক পরিচালিত কি যে করি ছবিতে বাদশাহ চরিত্রে অভিনয় করেন। এক ধনী ব্যক্তির নাতনী শাহানা তার দাদুর সম্পত্তি ভোগ করার জন্য ফাঁসির আসামী বাদশাহকে বিয়ে করে কিন্তু ভাগ্যক্রমে সে খালাস পেলে তাকে গ্রহণ করে শাহানা। ছবিতে তার বিপরীতে শাহানা চরিত্রে ছিলেন ববিতা। রাজ্জাক এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তার প্রথম শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। একই বছর তিনি আলমগীর কুমকুম পরিচালিত গুন্ডা ছবিতে বাহাদুর চরিত্রে অভিনয় করেন। এতে দেখা যায় তিনি একজন রাস্তার গুন্ডা থেকে ভালো মানুষে রূপান্তরিত হন। ১৯৭৭ সালে তিনি আজিজুর রহমান পরিচালিত অমর প্রেম, অশোক ঘোষ পরিচালিত মতি মহল এবং আব্দুল লতিফ বাচ্চুর যাদুর বাঁশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।

১৯৭৭ সালে তিনি পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র অনন্ত প্রেম। পথ-রোমাঞ্চধর্মী রোম্যান্টিক এই চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রায়িত হয়েছিল বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের প্রথম চুম্বন দৃশ্য। চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যের জন্য রাজ্জাক ববিতার মধ্যে চুম্বন দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তা মূল ছবি থেকে বাদ পড়ে।

১৯৭৮ সালে রাজ্জাক আজিজুর রহমান পরিচালিত অশিক্ষিত চলচ্চিত্রে গ্রামের একজন পাহারাদার চরিত্রে অভিনয় করেন। অশিক্ষিত পাহারাদার গ্রামের এক অনাথ কিশোরের নিকট লেখাপড়া শিখে এবং পরে সেই কিশোরের খুনের সাক্ষী হিসেবে নিজ হাতে দস্তখত করে। ছবিটি ব্যবসায়িকভাবে সফল হয় এবং এই ছবিতে রহমত চরিত্রে অভিনয়ের জন্য রাজ্জাক শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে (বুলবুল আহমেদের সাথে যৌথভাবে) তার দ্বিতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। দিলীপ বিশ্বাস পরিচালিত জিঞ্জির ছবিতে তিনি প্রথমে কলেজ ছাত্র রাজন চরিত্রে এবং তার স্ত্রীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে ডাকু ফরহাদে পরিণত হন। এতে তার সহশিল্পী ছিলেন সোহেল রানা ও আলমগীর।

রাজ্জাক ১৯৮২ সালে বড় ভাল লোক ছিল ছবিতে অভিনয় করেন। মহিউদ্দিন পরিচালিত ছবিটির রচনা করেন কথাসাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক। এই ছবিতে রাজ্জাককে একজন পীরের সন্তান চরিত্রে দেখা যায়, যার নিজের মধ্যে আধ্যাত্মিক শক্তি রয়েছে। কিন্তু তার বাবার বন্ধুর মেয়ের (অঞ্জু ঘোষ) প্রতি তার মোহ জাগলে তার সেই ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকলে সে এই পথ থেকে ফিরে এসে মানবসেবায় ব্রতী হয়। এই ছবিতে ইয়াসিন চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে তার তৃতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।

১৯৮৩ সালে মুক্তি পায় রাজ্জাক পরিচালিত দ্বিতীয় চলচ্চিত্র বদনাম। পরিচালনার পাশাপাশি তিনি এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেন। পরের বছর তিনি পরিচালনা করেন অভিযান। সৈয়দ শামসুল হকের কাহিনী অবলম্বনে তিন বন্ধুর ব্যবসায়িক যাত্রা নিয়ে নির্মিত রোমাঞ্চকর এই চলচ্চিত্রে তিনি রাজু চরিত্রে অভিনয় করেন। তার অপর দুই বন্ধু চরিত্রে ছিলেন জসিম ও ইলিয়াস কাঞ্চন। ছবিটি ৯ম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে একটি বিভাগে পুরস্কার লাভ করে। এই বছর তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত উপন্যাস চন্দ্রনাথ অবলম্বনে নির্মিত একই নামের চলচ্চিত্রে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন। চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত চলচ্চিত্রটি বাণিজ্যিকভাবে সফল হয় এবং সমালোচকদের দ্বারা প্রশংসিত হয়। রাজ্জাক এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তার চতুর্থ শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।

পরিচালনায় সাফল্য (১৯৮৯-১৯৯৭)
১৯৮৯ সালে রাজ্জাক জ্বীনের বাদশা চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। এই ছবিতে অভিনয় করেন তার বড় পুত্র বাপ্পারাজ। ছবিটি একটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। এই দশকে তার পরিচালিত অন্যান্য চলচ্চিত্রগুলো হল প্রফেসর (১৯৯২), বাবা কেন চাকর (১৯৯৭), উত্তর ফাল্গুনী (১৯৯৭)। বাবা কেন চাকর ছবিতে রাজ্জাক বাবার চরিত্রে অভিনয় করেন। তার দুই সন্তান চরিত্রে অভিনয় করেন আবুল কাশেম মিঠুন এবং বাপ্পারাজ।

পরিচালনার পাশাপাশি রাজ্জাক ১৯৮৯ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত বিষবৃক্ষ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত বিরহ ব্যথা চলচ্চিত্রে নগেন্দ্রনাথ চরিত্রে অভিনয় করেন। ছবিটি পরিচালনা করেন চাষী নজরুল ইসলাম। এতে তার বিপরীতে ছিলেন ববিতা ও চম্পা। এছাড়া এই বছর তার অভিনীত অন্যান্য চলচ্চিত্রগুলো হল সত্য সাহার রাম রহিম জন, শেখ নজরুল ইসলামের বিধাতা, শিবলি সাদিকের দুর্নাম, শফিকুর রহমানের রাজা মিস্ত্রী, সুভাষ দত্তের সহধর্মিণী, গাজী মাজহারুল আনোয়ারের শর্ত, এবং আজিমের দেবর ভাবী।

টালিউড ও অন্যান্য (১৯৯৮-২০১০)
১৯৯৮ সালে অঞ্জলি ফিল্মসের ব্যানারে বাবা কেন চাকর ছবিটি টালিউডে পুনঃনির্মিত হয়। এতে রাজ্জাকের অভিনীত চরিত্রের ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও তার বিপরীতে ছিলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। ছবিটি কলকাতায়ও ব্যবসাসফল হয়।পরে তিনি স্বপন সাহা পরিচালিত স্বার্থপর, রবি কিনাগী পরিচালিত অন্নদাতা (২০০২), সৃজিত গুহা পরিচালিত নায়ক, এবং স্বপন সাহা পরিচালিত দেবদূত (২০০৪), অন্যায় অত্যাচার (২০০৪) ও জন্মদাতা (২০০৮) ছবিতে অভিনয় করেন। এই ছবি দুটিতে তাকে বাড়ির প্রভাবশালী গৃহকর্তারূপে দেখা যায়। এছাড়া তিনি ২০০৬ সালে হিরো ও এরই নাম প্রেম ছবিতে অভিনয় করেন। হিরো ছবিতে তিনি পুলিশ কনস্টেবল ভবানী শঙ্কর চরিত্রে অভিনয় করেন।

পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় (২০১০-২০১৬)
রাজ্জাক এই দশকের শুরুতে অনন্ত জলিল-বর্ষা অভিনীত হৃদয় ভাঙ্গা ঢেউ (২০১১) এবং মোস্ট ওয়েলকাম (২০১২) ছবিতে অভিনয় করেন। পরের বছরগুলোতে রাজ্জাক পরিচালক জুটি শাহীন-সুমন পরিচালিত এবং মাহিয়া মাহি ও বাপ্পি চৌধুরী জুটির ভালোবাসার রঙ (২০১২) ছবিতে শামসুদ্দীন চৌধুরী চরিত্রে এবং অন্যরকম ভালোবাসা (২০১৩) ছবিতে অভিনয় করেন। ২০১৩ সালে দীর্ঘ ৩৫ বছর পর রাজ্জাক, সোহেল রানা ও আলমগীরকে একসাথে দেখা যায় জজ ব্যারিস্টার পুলিশ কমিশনার চলচ্চিত্রে। এফ আই মানিক পরিচালিত এই চলচ্চিত্রে রাজ্জাককে জজের ভূমিকায় দেখা যায়।একই বছর তিনি তার পুত্র সম্রাটকে নিয়ে নির্মাণ করেন আয়না কাহিনী। ইমদাদুল হক মিলন রচিত কাহিনী অবলম্বনে ছবিটির চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনা করেছেন রাজ্জাক নিজেই। এটি তার পরিচালিত সর্বশেষ চলচ্চিত্র। ছবিতে সামাজিক ব্যধি হিসেবে যৌতুক প্রথার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। এই বছর তিনি পার্শ্বচরিত্রে শফি উদ্দিন শফি পরিচালিত পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী ছবিতে সামাদ শিকদার এবং অনন্ত জলিল পরিচালিত নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বর্ষার দাদুর ভূমিকায় অভিনয় করেন।

২০১৪ সালে তিনি নঈম ইমতিয়াজ নেয়ামুল পরিচালিত এবং ফেরদৌস আহমেদ প্রযোজিত এক কাপ চা চলচ্চিত্রে অতিথি চরিত্রে এবং সামিয়া জামান পরিচালিত আকাশ কত দূরে ছবিতে অভিনয় করেন। ২০১৫ সালে তার বড়পুত্র বাপ্পারাজ পরিচালিত কার্তুজ ছবিতে অভিনয় করেন। এতে প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেন তারই ছোট পুত্র সম্রাট।২০১৬ সালে রাজ্জাক চেয়ারম্যানের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র টেলিভিশন চলচ্চিত্রে চেয়ারম্যানের ভূমিকায় অভিনয় করেন। এটি তার নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান রাজলক্ষ্মী প্রডাকশন্স থেকে নির্মিত হয় এবং পরিচালনা করেন তার পুত্র খালিদ হোসেন সম্রাট। এর আগেও রাজ্জাক সম্রাটের পরিচালনায় দায়ভার টেলিভিশন চলচ্চিত্রে কাজ করেন।

মৃত‌্যু
রাজ্জাক ২০১৭ সালের ২১শে আগস্ট সন্ধ্যা ৬:১৩ মিনিটে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপতালে মৃত্যুবরণ করেন। ২৩শে আগস্ট তাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।

চলচ্চিত্রের তালিকা
মূল নিবন্ধ: রাজ্জাক অভিনীত চলচ্চিত্রের তালিকা
পরিচালিত চলচ্চিত্র
অনন্ত প্রেম (১৯৭৭)
মৌচোর
পুত্রবধূ (১৯৮১)
বদনাম (১৯৮৩)
অভিযান (১৯৮৪)
সৎ ভাই (১৯৮৫)
ঢাকা ৮৬
চাঁপা ডাঙ্গার বউ
জ্বীনের বাদশা (১৯৮৯)
প্রফেসর (১৯৯২)
প্রেমশক্তি (১৯৯৩)
উত্তর ফাল্গুনী (১৯৯৭)
বাবা কেন চাকর (১৯৯৭)
সন্তান যখন শত্রু (১৯৯৭)
মরণ নিয়ে খেলা (২০০১)
প্রেমের নাম বেদনা
আমি বাঁচতে চাই (২০০৭)
কোটি টাকার ফকির (২০০৮)
মন দিয়েছি তোমাকে (২০০৯)
আয়না কাহিনী (২০১৩)
পুরস্কার ও সম্মাননা
১৯৯০ সাল পর্যন্ত দাপটের সাথেই ঢালিউডে সেরা নায়ক হয়ে অভিনয় করেন রাজ্জাক। এর মধ্য দিয়েই তিনি অর্জন করেন নায়করাজ রাজ্জাক খেতাব। অর্জন করেন একাধিক সম্মাননা। এছাড়াও, রাজ্জাক জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করছেন।

পুরস্কার আয়োজনের বছর পুরস্কারের বিভাগ মনোনীত চলচ্চিত্র ফলাফল
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ১৯৭৭ শ্রেষ্ঠ অভিনেতা কি যে করি বিজয়ী
১৯৭৯ শ্রেষ্ঠ অভিনেতা অশিক্ষিত বিজয়ী
১৯৮৩ শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বড় ভালো লোক ছিল বিজয়ী
১৯৮৫ শ্রেষ্ঠ অভিনেতা চন্দ্রনাথ বিজয়ী
১৯৮৯ শ্রেষ্ঠ অভিনেতা যোগাযোগ বিজয়ী
২০১৩ আজীবন সম্মাননা সামগ্রিক অবদান বিজয়ী
বাচসাস পুরস্কার ২০০৪পার্শ্ব অভিনেতা (চলচ্চিত্র) কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি বিজয়ী
২০০৯ আজীবন সম্মাননা (চলচ্চিত্র) সামগ্রিক অবদান বিজয়ী
ইন্দো-বাংলা কলা মিউজিক পুরস্কার ২০০৪ খান আতাউর রহমান আজীবন সম্মাননা সামগ্রিক অবদান বিজয়ী
ইফাদ ফিল্ম ক্লাব পুরস্কার ২০১২ আজীবন সম্মাননা সামগ্রিক অবদান বিজয়ী
বাবিসাস পুরস্কার ২০১২ আজীবন সম্মাননা সামগ্রিক অবদান বিজয়ী
মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার ২০১৩ আজীবন সম্মাননা সামগ্রিক অবদান বিজয়ী
টেলিভিশন রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ট্রাব) পুরস্কার ২০১৮ আজীবন সম্মাননা সামগ্রিক অবদান বিজয়ী

তথ্যসূত্র ঃ উইকিপিডিয়া