সৈয়দ শামসুল হক (সব্যসাচী লেখক ও জাতীয় ব্যক্তিত্ব)

প্রথম পাতা » জীবনী » সৈয়দ শামসুল হক (সব্যসাচী লেখক ও জাতীয় ব্যক্তিত্ব)


সৈয়দ শামসুল হক
সৈয়দ শামসুল হক, এক কথায় বহুমাত্রিক। সাহিত্যের একক কোন শাখা বা অভিধায় তাকে বাঁধা যায় না। তিনি কবি, গল্পকার, ঔপনাস্যিক, গীতিকার, চলচ্চিত্র লেখক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক সব মিলে আমাদের দেশে সব্যসাচী লেখক হিসেবে খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান তাঁর বাবা ড. সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইনের স্বপ্ন ছিল ছেলে বড় হয়ে নামকরা ডাক্তার হবে। কিন্তু সৈয়দ শামসুল হক শৈশবে থেকেই পণ করে বসেছিলেন লেখক হবেন বলে। নিজের সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করতে পেরেছেন সৈয়দ শামসুল হক। সাহিত্যের পথে জীবনের অনেক সংকট ও ঝুঁকির ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে, তবু সংকল্প থেকে একবিন্দু সরে আসেননি। সব্যসাচী লেখক হিসেবে সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই সদর্প বিচরণ তাঁর। সৈয়দ শামসুল হকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ছোট্ট মফস্বল শহর কুড়িগ্রামে। ধরলার খরস্রোতের মুগ্ধতায়, লম্ফে ঝম্ফে কেটে গেছে তাঁর শৈশব-কৈশোরের অনেকটা সময়। তারপর ১৯৪৮ খ্রি. ৯ম শ্রেণিতে পড়াকালীন চলে আসেন ঢাকাতে। ঢাকার লয়াল স্ট্রিটের সওগাত অফিসে পাকিস্তান সাহিত্য সংসদে সমবেত বিশিষ্ট লেখকদের মজলিশে নিজের লেখা গল্প পড়ে শোনালেন ১৭ বছরের সৈয়দ শামসুল হক। এক সমালোচক সেটাকে অপমানিত সৈয়দ শামসুল হকের মন খারাপ। ‘অগত্যা’ পত্রিকার সম্পাদক ফজলে লোহানী তাকে পিঠে সান্ত্বনার পরশ দিয়ে বললেন, ‘ওরা কেউ থাকবে না, তুমিই থাকবে।’ সত্যিই তাই, তিনি আছেন আজ দেশের স্বনামখ্যাত শীর্ষ সারির লেখকদের একজন তিনি। তার লেখা প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫১ খ্রি. ‘অগত্যা’ পত্রিকায়। সেই থেকেই অনেক বিরুদ্ধ বাতাস উজিয়ে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে বিরামহীন ছুটে চলা। দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার অসংখ্য লেখা প্রকাশিত হয়েছে এবং হয়ে আসছে। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কাব্যনাট্য, অনুবাদ, শিশুতোষ রচনা সব মিলে দুইশ’রও বেশি অনন্য বইয়ের লেখক সৈয়দ শামসুল হক। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে- খেলারাম খেলে যা, নূরলদীনের সারাজীবন, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, পরানের গহীন ভিতর, নিষিদ্ধ লোবান অন্যতম। একবার ১৬ বছর বয়সে পাড়িও ভেবেছিলেন চিত্রনির্মাতা হবেন এবং সেই স্বপ্নে পাহাড়, জমিয়েছিলেন বোম্বে। যখন বুঝতে পারলেন যে, তার প্রকৃত প্রকাশমাধ্যম সাহিত্য, তাই ফিরে এলেন বোম্বে থেকে। তাই বলে চলচ্চিত্র থেকে বিচ্ছিন্ন তিনি নন। ৪০টিরও বেশি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য তিনি লিখেছেন। তন্মধ্যে সুতরাং, মাটির নতুন দিগন্ত, কাগজের নৌকা, অবাঞ্ছিত, নয়নতারা, কখগঘঙ, বিনিময়, মানসম্মান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ফির মিলিঙ্গে হামদোনো এই উর্দু চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও তাঁর লেখা। তাকে স্বনামধন্য গীতিকার হিসেবেও আমরা পাই- হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, চাঁদের সথে দেব না তোমার তুলনা, তুমি আসবে বলে কাছে ডাকবে বলে, এমন মজা হয় না, টাকা তুমি সময়মতো আইলা না’র মতো জনপ্রিয় গানের মধ্য দিয়ে। এগুলোসহ প্রায় ২০০টি গান তিনি লিখেছেন। তার লেখা গানে রুনা লায়লা, আব্দুল লতিফ, আবদুল জব্বার, ফেরদৌসী রহমান, এন্ড্রোকিশোর, আবদুল আলীমের মতো বরেণ্য শিল্পীসহ বহু শিল্পী কণ্ঠ দিয়েছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বহুল আলোচিত ‘গেরিলা’ চলচ্চিত্রটিও তার নিষিদ্ধ লোবান নামক উপন্যাসের ছায়ায় আবর্তিত। তিনি এমনই এক লেখক যার প্রতিটি রচনাতেই আমরা পাই অপূর্ব নান্দনিকতার ছোঁয়া-ক্ষুধা দারিদ্র্যক্লিষ্ট বাংলাদেশের মানুষের যাপিত জীবনের এক গল্পরূপ আমরা পাই ‘জলেশ্বরী’ সিরিজে। বাংলাদেশের কাব্যনাট্যের ধারাকে তিনিই সমৃদ্ধ ও জনপ্রিয় করে তুলেছেন। নিজেকে রাষ্ট্রভাষা ও ৫২’র সন্তান মনে করেন তিনি। তাইতো অনেকেই তাকে ইংরেজিতে সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে বিশ্বজোড়া পরিচিতি অর্জনের জন্য উদ্বুদ্ধ করা। সত্ত্বেও তিনি সেটা করেননি। ১৯৬৬ খ্রি. মাত্র ৩০ বছর বয়সে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৪ খ্রি. একুশে পদক, ২০০০ খ্রি. স্বাধীনতা পদকসহ বহু স্বীকৃতি,সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত। ১৯৬৫ খ্রি. নভেম্বর আনোয়ারা সৈয়দ হকের সঙ্গে পরিণয়সূত্রেআবদ্ধ হন। আনোয়ারা সৈয়দ একজন বিশিষ্ট লেখক। সুখময় সংসার জীবনে এক মেয়ে বিদিতা ও এক ছেলে দ্বিতীয়র আদর্শ পিতা তিনি। ছেলে-মেয়ে উভয়েই প্রবাসী। তিনি ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।