ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব (জীবনী)

প্রথম পাতা » জীবনী » ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব (জীবনী)


ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব
মুক্তিযুদ্ধের শহীদ, বরেণ্য দার্শনিক
অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব। একজন আলোকিত মানুষ, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তিনি ছিলেন আলোকবর্তিকা। আন্তজার্তিক খ্যাতিসম্পন্ন মানবতা বাদী দার্শনিক ছিলেন তিনি, ছিলেন এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন। জিসি দেব হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত তিনি। তিনি শুধু একজন ব্যক্তি নন, তিনি ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান, অসাম্প্রদায়িক জীবন- আদর্শ ও মানুষের কল্যাণকামী দর্শনের প্রবক্তা তিনি। তিনি এমনই একজন যাকে নিয়ে বাংলাদেশ গর্ব করতে পারে। বাংলাদেশের এ গর্বিত সন্তানের জন্ম তৎকালীন বৃহত্তর সিলেট জেলার পঞ্চখণ্ড পরগনার বিয়ানীবাজার উপজেলার লাউতা গ্রামে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি। ড. গোবিন্দ চত্তর পুরো নাম গোবিন্দ চন্দ্র দেব পুরকায়স্থ। তার পিতার নাম ঈশ্বরচন্দ্র দেব পুরোকায়স্থ, মাতার নাম শরৎ সুন্দরী দেবী। লাউতা বয়েজ স্কুলে তার প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চখণ্ড হরগোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয় থকে সংস্কৃত ও অংকে লেটারসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক, ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ( স্যার সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) যুক্তিবিদ্যায় লেটারমার্কসহ আই.এ., ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার সংস্কৃত কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে বি.এ. (সম্মানসহ) ডিগ্রি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করে দর্শনশাস্ত্রে এম.এ. পাস করেন। কৃতিত্বপূর্ণ ফলের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘স্বর্ণপদক’ এবং ‘হেমেন্দ্র মুখার্জী রৌপ্য পদক’ প্রদান করে। রিজন ইনস্টিটিউশন এ্যান্ড রিয়েলিটি’ শিরোনামের একটি অভিন্দর্ভ রচনা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা রিপন (স্যার সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) কলেজে দর্শন ও ন্যায়শাস্ত্রের লেকচারার হিসেবে। ১৯৩৪-এ তিনি ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশের জালগাঁও জেলার অন্তর্গত আমলনারের বিখ্যাত প্রতাপ সেন্টার অব ফিরোসপিতে গবেষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২২ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে রিডার হিসেবে পদোন্নতি পান (১ আগস্ট) এবং দেড় মাস পরই বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রফেসর হিসেবে আমেরিকার পেনসিলভানিয়া উইলকিন্স ব্যারে কলেজে যোগ দেন। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় বিভাগ প্রধান ও জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সুদীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি যে শুধু শিক্ষকতাই করেছেন, তা কিন্তু নয়। তিনি নিজেকে ব্যাপ্ত রেখেছিলেন বিভিন্ন রাষ্ট্রীয়, সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান দর্শন কংগ্রেস (পূর্ব পাকিস্তান শাখা)- এর সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার কর্তৃক বাংলা একাডেমীর কার্যকরী সংসদের সদস্য মনোনীত হন। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সংস্কার কমিশনের সদস্য মনোনীত হন। এ বছরই পূর্ব পাকিস্তান পালি ও সংস্কৃত বোর্ডে সচিব পদে মনোনীত হন তিনি। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সম্পাদক নিযুক্ত হন। এ দেশের দর্শনচর্চার প্রচার ও প্রসারকল্পে ‘পাকিস্তান দৰ্শন ভবন’ প্রতিষ্ঠা করেন, ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে ১২ কে এম. দাস লেনে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভ্রাতৃত্বের বন্ধনের দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমেরিকায় ‘দ্যা গোবিন্দ দেব ফাউন্ডেশন ফর ওয়ার্ল্ড ব্রাদার্সহুড’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে যুক্তাজ্যের দ্য ইউনিয়ন অব দ্য স্টাডি অব গ্রেট রিলিজিয়াস’ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিশিনগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলোসফি অব সায়েন্স এসোসিয়েশনের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি একজন সুদক্ষ লেখক। তার প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ হচ্ছে- আইডিয়ালিজম এ্যান্ড প্রগ্রেস, এ নিউ ডিফেন্স এ্যান্ড এ নিউ এ্যাপি[]কেশন, আমার জীবন-দর্শন, এসপিরেসনস্ অব দ্যা কমোন ম্যান, বুদ্ধ: দ্যা হিউম্যানিস্ট, তত্ত্ববিদ্যা- মার, মাই আমেরিকান এক্সপেরিয়েন্স ইত্যাদি। শিক্ষা, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তান স্বারসত সমাজ তাকে সম্মানসূচক ‘দর্শন সাগর’ উপাধিতে ভূষিত করে।অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী দর্শনের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে ‘একুশে পদক’ (মরণোত্তর) প্রদান করে। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকেটমালায় ড. দেবের ছবি সম্বলিত ডাকটিকেট প্রকাশ করা হয়। ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’- এ ভূষিত হন তিনি। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান গোবিন্দ দেবের অধ্যাপক ড. আমিনুল ইসলামের উদ্যোগে এবং শহীদ ড. গোবিন্দ দেবের অর্থানকূল্যে দর্শন বিভাগে ‘দেব সেন্টার ফর ফিলোসোফিক্যাল স্টাডিজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে তার বাংলা নামকরণ করা হয় গোবিন্দ দেব বিষয় যেমন- মানবতাবাদ, প্রয়োগবাদ, নৈতিক দর্শন, ধর্ম ও সামাজিক দর্শনচর্চা, আন্তধর্মীয় সম্প্রতি প্রচার- প্রসার, গবেষণা বৃত্তি/ ফেলোশিপ প্রদান, স্মারক বক্তৃতামালার আয়োজনই হচ্ছে এ সংগঠনের উদ্দেশ্য। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মার্চ পাকিস্তানি বর্বর হানাদার সৈন্যের গুলি ও বেয়োনেট বিদ্ধ হয়ে মারা যান।