মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী

প্রথম পাতা » জীবনী » মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী


 মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী

আফ্রো-এশিয়ার ল্যাটিন আমেরিকার অবিসংবাদিত মজলুম জননেতা, বাংলার মুকুটহীন সম্রাট, অসহায়, শোষিত, বঞ্চিত মানুষের পক্ষে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার সয়া ধানগড়া গ্রামের এক বনেদী মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ বৎসর বয়সে ওস্তাদের কাছে তাঁর মক্তবের পড়াশোনার হাতেখড়ি হয়। বাবা- মায়ের আদর তিনি বেশি দিন পাননি। মাত্র ছয় বৎসর বয়সে বাবা এবং বারো বৎসর বয়সে মাকে হারান। তাঁর আরও দুই ভাই আমীর খান ও ইসলাম খান অকালে মৃত্যুবরণ করেন। জীবিত রইলেন তিনি এবং এক বোন। বাবা-মার মৃত্যুর পর মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী চাচা ইব্রাহীম খানের বাড়িতে আশ্রয় নেন। চাচা তাঁকে সিরাজগঞ্জ শহরের এক মাদ্রাসায় ভর্তি করে। দেন। কিন্তু পড়ালেখায় মন বসেনি তাঁর। ক্লাসের বাধ্যবাধকতা তাঁর ভালো লাগতো না। একদিন চাচার সঙ্গে অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে শাহজাদপুরে চলে যান। সেখানে এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এখানে পড়ালেখা ছেড়ে খেতমজুরের কাজে যোগ দেন। এ সময় এলাকায় বাগদাদ থেকে আগত পীর নাসির উদ্দিন বোগদাদীর আগমন ঘটে। সুদূর বাগদাদ থেকে এসে বোগদাদী পীর তাঁকে দেখে খুশি হলেন। ভাসানীকে তিনি সঙ্গে করে ময়মনসিংহের বল্লা গ্রামে নিয়ে যান। ময়মনসিংহে তিনি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন। মক্তবের পড়া শেষ করে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী শিক্ষকতা শুরু করেন। মাদ্রাসার শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে তিনি টাঙ্গাইলে চলে আসেন এবং কাগমারীতে অবস্থান নেন। এখানে এক বৎসরকাল থাকার পর পীর সাহেবের সঙ্গে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে আসাম চলে যান। তখন সারা ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী তান্দোলন চলছিলো। ভাসানী ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। পীর সাহেবের অনুমতিক্রমে তিনি দেওবন্দে চলে যান। দেওবন্দ ইসলামিয়া মাদ্রাসায় সেখানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চলতে থাকে। এখান থেকেই সম্পূর্ণরূপে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়। দেওবন্দে শিক্ষা জীবনশেষ করে মওলানা ভাসানী আবার আসামে ফিরে আসেন। মানুষকে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্যে পীর সাহেব আসামের বন-জঙ্গল পরিস্কার করে ইসলাম প্রচার মিশন স্থাপন করেন। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে বোগদাদী সাহেবের মোসাফিরখানায় ‘হককুল্লাহ ও হককুল ইবাদ’মিশনের কাজ জোরেসোরে চলতে থাকে। ভাসানী ছিলেন তাঁর যোগ্য সাগরেদ। বোগদাদী ‘বড় হুজুর’ এবং ভাসানী ‘ছোট হুজুর’ নামে পরিচিতি পান। তখন থেকেই তিনি মাথায় তালের টুপি ব্যবহার করতে থাকেন। তিনি মিশনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন এবং মিশনের কাজ নিয়ে বগুড়ার পাঁচবিবিতে চলে আসেন। এখানে জমিদার শামসুদ্দিন আহমদ চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ভাসানী জমিদার সাহেবের ছেলে-মেয়েদের গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন এবং পরবর্তীতে গৃহশিক্ষকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তাঁর জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব পান। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে আসাম আঞ্জুমানে ওলামার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে আসাম কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি বৃহত্তর রাজনৈতিক অঙ্গনে পা বাড়ান। চিত্তরঞ্জন দাস, মাওলানা আবুল কালাম আজাদের সংস্পর্শে আসেন। খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়ে দশ মাস কারাভোগ করেন। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি মওলানা মোহাম্মদ আলী ও মাওলানা শওকত আলীর ডাকে খেলাফত আন্দোলনে এবং একই সময়ে দেশবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেন। আবার গ্রেফতার হন তিনি এবং সাত দিন পর মুক্তি লাভ করেন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে উত্তরবঙ্গ ও আসামে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। সেখানে বিপন্ন মানুষের সেবায় এগিয়ে গেলেন মওলানা ভাসানী। কলকাতা থেকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, সুভাষচন্দ্র বসুসহ আরও অনেকেই বন্যা পীড়িত মানুষের সেবায় এগিয়ে আসেন। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দিনরাত দুঃস্থদের সেবা করতে থাকেন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিরাজগঞ্জে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের আয়োজন করেন। এই সম্মেলনে তিনি কংগ্রেসের জাতীয় নেতাদের কাছে দেশের নিরীহ প্রজাদের উপর জমিদারদের জুলুম আর অত্যাচারের কথা তুলে ধরেন। এতে দেশের সকল জমিদারের কাছে বিরাগভাজন হন। আত্মরক্ষার তাগিদে আসামের ধুবড়িতে চলে যান। আসামের ধুবড়ি জেলার ভাসানচরে আশ্রয় নেন। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি। বগুড়ার জমিদার শামসুদ্দিন আহমদ চৌধুরীর কন্যা আলেমা খাতুনের সঙ্গে শুভ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে আসামের ভাসানচরে চলে যান। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে আসামে কৃষক প্রজা আন্দোলন শুরু করেন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ভাসানচরেপথম কৃষক সম্মেলন করেন। সংগ্রামের মাধ্যমে আসমে বিতিস ব্রিটিশ সরকারের লাইন প্রথা ভঙ্গ করেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। বাস্তহারা বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠী তাঁকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করে। ভাসানচরে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ‘ভাসানী’ নামে খ্যাত হন। একদিকে ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে, অন্যদিকে দেশীয় জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে সন্তোষের কাগমারীতে এবং ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে সিরাজগঞ্জের কাওয়াখোলা ময়দানে বঙ্গ-আসাম প্রজা সম্মেলনের আহ্বান করলেন তিনি। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর জীবনে আসাম পর্বের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো-লাইন প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম; বেশ কিছু স্কুল কলেজ, মাদ্রাসা, মক্তব ও মসজিদ নির্মাণ কাজ। আসাম ছিলো এক বিস্তৃত বিরান ও জঙ্গলপূর্ণ অঞ্চল। পূর্ববাংলা থেকে বাঙালি কৃষকগণ সেখানে গিয়ে বন কেটে চাষাবাদ শুরু করে। প্রথম প্রথম আসামী আদিবাসীরা ব্যাপারটাকে স্বাগত জানালেও পরে বাঙালিদের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে উঠে। আসামে বাঙালিদের নিপীড়নের উদ্দেশ্যে লাইন প্রথা নামে এক কালাকানুন জারি করে। আসামীরা ‘বাঙাল খেদা’ আন্দোলন শুরু করে। এই লাইন প্রথা ‘বাঙাল খেদা’ আন্দোলনের বিরুদ্ধে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী রুখে দাঁড়ালেন। তাঁর নেতৃত্বে আসামের বারোটি জেলায় মুসলিম লীগের সংগঠন আরও জোরদার হয়। একই বছর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আসামের ৩৪ টি মুসলিম আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ ৩১টি আসন লাভ করে। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আসাম আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি আসাম থেকে রিলিফ নিয়ে বন্যা প্লাবিত পূর্ব বাংলার টাঙ্গাইলে আসেন এবং পীর হযরত শাহজামান (রহ.)-এর মাজারে ঘাঁটি করেন। শাহজামান (রহ.)-এর মাজারে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু সন্তোষের জমিদারের চক্রান্তে আবার আসাম চলে যান। মুসলিম লীগ মন্ত্রী পরিষদ গঠিত হবার পরও মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী লাইন প্রথা ও ‘বাঙাল খেদা’ আন্দোলনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলেন। ফলে সরকারের সাথে তাঁর সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। কেন্দ্রীয় মুসলিম নেতৃবৃন্দ তাঁকে নিজ দলীয় সরকারের বিরোধিতা না করার জন্য আহ্বান জানান। কিন্তু মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তাঁর আদর্শে অটুট থাকেন। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি রংপুরের গাইবান্ধায় কৃষক প্রজা সম্মেলনের আয়োজন করেন। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে তিনি শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হকের সঙ্গে মুসলিম লীগের লাহোর সম্মেলনে। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে যোগদান করেন। আসামের লাইন প্রথা বিরোধী আন্দোলন থেকে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এক মুহূর্তও সরে যাননি। পুলিশ বাঙালিদের মিছিলের উপর গুলি চালালে একজন নিহত হয় এবং মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে ব্রিটিশ সরকার গ্রেফতার করে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুন ভাসানী গৌহাটি কারাগার থেকে মুক্তি পান। ছাড়া পেয়ে তিনি সিলেট চলে আসেন। পাকিস্তানের পক্ষে আন্দোলন করেন। সিলেটবাসী গণভোটে পাকিস্তানকে রায় দেয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ আগস্ট ভারত নামে দু’টি স্বাধীন দেশের জন্ম হয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে আসাম সরকার মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে গ্রেফতার করে এবং ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে মুক্তি দিয়ে আসাম ছাড়ার নির্দেশ দেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী পূর্ববঙ্গ আইন সভায় টাঙ্গাইল আসন হিসেবে গণ্য হলে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী উপ-নির্বাচনে অংশ নেন এবং খাজা নাজিমুদ্দীনের মনোনীত প্রার্থী জমিদার খুররম খান পন্নীকে পরাজিত করে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু খাজা নাজিমুদ্দীন ষড়যন্ত্র করে এই উপ- নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করেন। শুধু তাই নয় ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যাতে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী কোন নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন সেজন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঢাকায় এলে মুসলিম লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী নতুন আর একটি দল গঠন করার উদ্যোগ নেন। এই উদ্দেশ্যেই ২৩ জুন ঢাকায় রোজ গার্ডেনে তাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়। পরবর্তীকালে যা আওয়ামী লীগে পরিণত হয়। তিনি দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন। ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার দায়ে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অনশন ধর্মঘট পালন করেন এবং মুক্তি লাভ করেন। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি জেলা বার লাইব্রেরি হলে তাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ এবং তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সহযোগিতার জন্য গ্রেফতার হন। ১৬ মাস কারাভোগের পর পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে মোকাবেলা করার জন্য এ.কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। গঠিত হয় ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে বিজয় লাভ করে। যুক্তফ্রন্ট পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা শেরে বাংলা কর্তৃক সরকার গঠন করার পর বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী জার্মানির বার্লিন যাত্রা করেন। এ বছরেই ৩০ মে কেন্দ্রীয় সরকার ৯২-ক ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দিয়ে পূর্ববঙ্গে গভর্নর-এর শাসন ব্যবস্থা চালু করেন এবং তাঁর দেশে ফেরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। দেশে ফিরলে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হবে বলে পূর্ববঙ্গের নবনিযুক্ত গভর্নর ইসকান্দার মির্জা ঘোষণা দেন। ১১ মাস লন্ডন, বার্লিন, দিল্লী ও কলকাতায় অবস্থান শেষে তাঁর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ২৫ এপ্রিল দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী’র রাজনৈতিক জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা কাগমারী সম্মেলন। তাঁর একান্ত উদ্যোগে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৮-১০ ফেব্রুয়ারি এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে পূর্ববঙ্গ, পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারত থেকে বহু বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা এবং বুদ্ধিজীবী অংশগ্রহণ করেন। এ সকল নেতার নামে সুদৃশ্য তোরণ নির্মাণ করা হয়। পূর্ববঙ্গ পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, গণবিরোধী সামরিক চুক্তি বাতিল এবং নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির দাবিতে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এই সম্মেলনে তাঁর অনলবর্ষী বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘দাবি মানা না হলে ভবিষ্যতে অর্থাৎ আজ থেকে দশ বছর পর এমন সময় আসতে পারে, যখন পূর্ব বাংলা পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম বলবে।’ ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের সম্মেলনে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী দাবি প্রত্যাখান করলে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। এ বছরই ২৫ জুলাই তাঁর নেতৃত্বে ঢাকার রূপমহল। সিনেমা হলে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হয়। তিনি ন্যাপের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ অক্টোবর দেশে সামরিক আইন জারি করে জেনারেল আইয়ুব খান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে দেশে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ১২ অক্টোবর মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতাল থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ঢাকায় ৪ বছর ১০ মাস অন্তরীণ ছিলেন। বন্দী অবস্থায় ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ২৬ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত বন্যা দুর্গতদের জন্য সাহায্য, পাটের ন্যায্যমূল্য, মহাজনদের পুনর্বাসন, বন্যা নিয়ন্ত্রণের দাবিতে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। ৩ নভেম্বর তিনি মুক্তি লাভ ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে আইয়ুব বিরোধী কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি বা কপ গঠন হলে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী’র ন্যাপ তাতে যোগদান করে। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ন্যাপ দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী হন চীনপন্থী। ন্যাপের সভাপতি, অন্যদিকে মস্কোপন্থী ন্যাপের সভাপতি হন অধ্যাপক মোজাফফর ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হলে সারাদেশে আন্দোলন গড়ে উঠে। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি সরকার মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়। আওয়ামী লীগ, পিডিপি, ভাসানী ন্যাপ, জামাতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, কাইয়ুম মুসলিম লীগসহ সকল সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকারের জন্য আন্দোলনে মুখর হয়ে উঠে। এ আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে রাজনৈতিক সমঝোতামূলক এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দেশে রাজনৈতিক সংকট মীমাংসার লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান কর্তৃক আহুত গোল টেবিল বৈঠক (১৯৬৯ খ্রি. ১০-১৩ মার্চ) প্রত্যাখান করেন। গণ আন্দোলনের প্রচণ্ডতার মধ্যে আইয়ুব সরকারের পতন হয়। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সরকার দেশে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দিলে ভোটের আগে ভাত চাই, দেশে ইসলামিক সাংস্কৃতিক বিপ্লব, ইসলামী সমাজতন্ত্র কায়েম কর ইত্যাদি দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ৬-৮ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা সমস্যা সমাধানের দাবিতে সন্তোষে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। অতঃপর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য ন্যাপ প্রার্থীর মনোনয়ন পত্র দাখিল করেন। নির্বাচনের কিছুদিন পূর্বে ১২ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের উপকূল অঞ্চলে এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় হলে দুর্গত এলাকার ত্রাণ কাজে অংশ গ্রহণের জন্য নির্বাচন থেকে ন্যাপ প্রার্থীরা সরে দাঁড়ান। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর মাওলানা ভাসানী পল্টনের এক জনসভায় ভাষণ দানকালে ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তা ’ গঠনের দাবি উত্থাপন করেন। সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকলে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বজ্রকণ্ঠে বললেন, ‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া’-তাই বলি, অনেক হইয়াছে, কিন্তু আর নয়, শেখ মুজিবের দাবি অনুসারে পূর্ববাংলার স্বাধিকার মানিয়া লও।’ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ভারত চলে যান। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি মনোনীত হন। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ২২ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এ বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক ‘হককথা’ প্রকাশ করা শুরু করেন। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করেন। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সন্তোষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে। দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে বাস্তবায়নের জন্য শেখ মুজিব সরকারের সহযোগিতা চান। কিন্তু তা না পেয়ে নিজ দায়িত্বে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাজ শুরু করেন। তাঁর স্বপ্ন ছিলো এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা, যেখানে একজন শিশু ভর্তি হবে, সে পর্যায়ক্রমে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করবে, পিএইচডি পর্যন্ত সম্পন্ন করতে পারবে। সুচিন্তিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস পর্যন্ত তিনি প্রণয়ন করেছিলেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদদের নিয়ে কয়েকবার শিক্ষা সম্মেলন ও সেমিনারের আয়োজন করেছেন। শিক্ষার্থীগণ পাঠ্যসূচির পাশাপাশি হাতে-কলমে কারিগরি শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে সে জাতীয় কারিকুলাম লিখেছিলেন। তিনি স্বনির্বাচিত সিলেবাসে লিখেছেন ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীগণ লেখাপড়ার পাশাপাশি বস্ত্রশিল্প, হস্তশিল্প, সুতারের কাজসহ সকল কাজ শিখবে। প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাকালে হোস্টেলে লবণ কেরোসিন বাদে সব নিজেরা তৈরি করে নেবে।’ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শিশু নার্সারি থেকে কলেজ পর্যন্ত করতে পেরেছিলেন। এরপর অসমাপ্ত রেখে চিরবিদায় নেন। দুর্ভাগ্যক্রমে প্রতিষ্ঠানটির কাজ আজ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়নি। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর লক্ষ লক্ষ অনুসারী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তা সফল করার কাজে হাত দেননি। শেখ হাসিনার সরকার মাওলানা ভাসানীর নামে একটি ছোট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন সত্য, কিন্তু তা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর চিন্তাধারা বা স্বপ্নের বাস্তবায়ন নয়। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ৮ এপ্রিল মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী হুকুমতে রব্বানিয়া সমিতি গঠন করেন। এ বছর আইন অমান্য আন্দোলন করলে শেখ মুজিব সরকার তাঁকে সন্তোষে গৃহবন্দী রাখে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সরকার ক্ষমতায় এলে তাঁকে সমর্থন জ্ঞাপন করেন। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫মে গঙ্গা নদীর উপর ভারতের ফারাক্কা বাঁধ তৈরির প্রতিবাদে ‘লংমার্চ’ করেন। এটি ছিলো তাঁর সংগ্রামী জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ এপ্রিল তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২৮মে তাঁকে ঢাকায় পিজি হাসপাতালে নেয়া হয় এবং পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৭ নভেম্বর এখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁকে সন্তোষে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় টেকনিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সাহিত্য ও সংস্কৃতির একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ হচ্ছে দেশের সমস্যা ও সমাধান’ (১৯৬২), ‘মাও সেতুং-এর দেশে’ (১৯৬৩) ইত্যাদি। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে ভাসানীকে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (মরণোত্তর) ২০০২ খ্রিস্টাব্দে একুশে পদক (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়।